মাওলানা লাবীব আবদুল্লাহ
শিক্ষক, খতিব ও কলামিস্ট
ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, উত্তারাঞ্চল, কিশোরগঞ্জ, বি বাড়িয়াসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলকেন্দ্রিক কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড দেখার সুযোগ হয়েছে আমার৷ ব্যাক্তিগতভাবে গত দুই যুগ থেকে আমি নাযেমে তালীমাতের কাজে জড়িত৷
তাছাড়া ইত্তেফাকুল উলামা বৃহত্তর মোমেনশাহীর কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্পাদক হিসেবে কিছুদিন সরাসরি বর্তামানে সহযোগীদের সহযোগিতায় বৃত্তিপরীক্ষার সঙ্গে জড়িত৷ ব্যক্তিগতভাবে বেফাকের সকল মারহালায় পরীক্ষা দিয়েছি তালেবে ইলমের যামানায়৷
আমাদের সময় পরীক্ষাগুলোর উত্তরপত্র অনেকেই আরবিতে লিখতেন৷ আমিও তাকমিলের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা আরবিতে দিয়েছিলাম৷ হস্তাক্ষর সুন্দরের জন্য পৃথক নম্বর দেওয়া হতো৷ সুন্দর উপস্থাপনার জন্যও পৃথক নম্বর থাকতো৷
১৯৯২ সালে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা দেই তাকমিলে৷ তখন কল্পনাও করা যেতো না বাংলা নোট গাইডের৷ সাজেশনের৷ ফজিলত পরীক্ষায় তাহরিকে দারুল উলূম দেওবন্দ বিষয়টি পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিলো৷
তখনও মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ রচিত দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান বইটি রচিত হয়নি৷ নানা উপায়ে দেওবন্দ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এই বিষয়ে পরীক্ষা দেই৷ ১০০ মার্কের ৯৬ নম্বর পেয়েছিলাম আমি৷
এই উত্তরপত্রে বাংলায় লিখেছিলাম৷ আমাদের সময় কেউ কেউ উত্তরপত্র উর্দুতে লিখতো৷ এখন আগের মতো নেই৷
পরীক্ষাকেন্দ্রিক নানা আয়োজন৷ আমার জানামতে কোথাও কোথাও কোচিং ও শুরু হয়েছে৷ নোট, গাইড ও সাজেশন বাজারে ছয়লাব৷ যেকোনো মাদরাসায় তালেবে ইলমের পড়ার টেবিল দেখলেই পাওয়া যাবে সকল বাংলা নোট৷ গাইড৷
সাজেশন৷ একটি পরীক্ষা হলে সবাইকে বাংলায় উত্তরপত্র লিখতে দেখলাম৷ একজন শুধু আরবিতে লিখছে৷ উর্দুতে কেউ না৷ চট্রগ্রাম, সিলেট, উত্তারাঞ্চলে এখনও কেউ কেউ উর্দুতে উত্তরপত্র লিখে৷
ঢাকা ও ময়মনসিংহে উর্দু প্রায় বিদায়৷ আমি যদি স্পষ্ট করে হলি তাহলে আমাদের শিক্ষাবোর্ডগুলো পরীক্ষা সর্ববস্ব হয়ে যাচ্ছে৷ শিক্ষার৷ মান উন্নতি করার পদক্ষেপ সীমিত৷ তালিম তরবিয়তের মান বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা ভিশন মিশন অস্পষ্ট৷
তাছাড়া শিক্ষাবোর্ডগুলোর পরীক্ষার সিলেবাসে দীন দুনিয়ার জ্ঞানের সমন্বয়ের অভাব৷ তাকমিলের একজন তালেবে ইলমকে হাদিস ও ফিকহ সম্পর্কে কিছুটা ধারনা রাখে৷
তাফসিরে জালালাইন তো মনে হয় অনেক বোর্ডে পরীক্ষাই হয় না৷ আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বা নিজ দেশ সম্পর্কে বিশেষ কিছু না জেনেও তাকমিল বা মাস্টার্স এর সনদ পেয়ে যাচ্ছে৷ হাইতুল উলইয়ার পরীক্ষার সিলেবাসটি পর্যালোচনা করলেই এই কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে৷
তাছাড়া দেশের ১৮/১৯টি বোর্ড বা হাইআতুল উলইয়ার অন্তরভুক্ত ৬টি বোর্ডের তাকমিল ছাড়া বোর্ডের সিলেবাসে ভয়াবহ অসঙ্গতি৷ খোদ বেফাকের মাননীয় সভাপতির মাদরাসার পরীক্ষার্থীরা সবাই তাকমিলে পরীক্ষা দেয় না এবং বোর্ডের সকল মারহালার পরীক্ষায় অংশ নেয় না মুতরাম সভাপতির প্রাচীনতম ঐতিহ্যাহী মাদরাসা বা জামিয়া৷
বেফাক নূরানী ও কাফিয়ার কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেবে৷ কাফিয়া কিতাবটিই তো বাদ দেওয়া হয়েছে অনেক মাদরাসায়৷ বেফাক শরহে বেকায়া থেকে কুতবী বাদ দিয়েছে৷ বাদ দিয়েছে আরও কিছু কিতাব৷
বোর্ডে মহিলা মাদরাসার সিলেবাস শর্ট৷ ছেলেদেরটা কোথাও কিছুটা দীর্ঘ৷ কিন্তু কোনোটাই মাস্টার্স সনদের অর্জনের ১৭ বছরের নয়৷ কোনো বোর্ড আমার জানা মতে
বিশ্বমনের সিলেবাস রচিত হয় নি৷
সেই পুরনো দরসে নেজামীর আদলে সাজানো৷ দরসে নেজামীও পুরোটা নয় আবার৷ কাটছাট৷ সর্বোপরি কওমী মাদরাসার স্বার্থ রক্ষায় বোর্ডগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে৷
কিছুটা শিক্ষায় প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকলেও বাংলা নটো গাইড অবক্ষয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে শিক্ষার৷ তরবিয়তের নিম্নমান সবার জানা৷ মহিলা মাদরাসার পরিচালনার জন্য আজও নীতিমালা তৈয়ার হয় নি৷ শর্তাবলী পালনযোগ্য আইনে পরিনত করা সম্ভব হয় নি৷
মহিলা মাদরাসার সিলেবাসটি আলিয়া মাদরাসার জন্য রচিত আল ফাতাহর বইগুলো ভালো কাজে দিচ্ছে৷ এতো সমস্যার ভেতরও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে আগামীর৷
আগামী প্রজন্ম যেনো সুন্দর একটি পরিবেশ পায় সেই প্রচেষ্টা করে যেতেই হবে৷
যেনো বিশ্বমানের আলেম হয় এই প্রজন্ম সেই কোশেশ করে যেতে হবে৷ এ ক্ষেত্রে বোর্ডগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবেই৷ তালেবে ইলম ও মাদরাসার বার্ষিক চাঁদা ও ফি দিয়ে পরিচালিত হয় বোর্ডগুলো৷ তালেবে ইলমের আগামী নিয়ে চিন্তা করতেই হবে৷
কিছু প্রস্তাবনা
১. সবগুলো শিক্ষাবোর্ডের মাদরাসার পরিসংখ্যান তৈয়ার৷ তালেবে ইলম ও উস্তাজদের পরিসংখ্যান তৈয়ার৷
২. মারহালা ছানাবিয়ার পরীক্ষা অভিন্ন সিলেবাসে গ্রহণ৷ এই পরীক্ষার সনদধারীরা যেনো আরব বিশ্বের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বা জামিয়াগুলোতে অনার্সের সুযোগ লাভ করে সেই পথ রচনা করা৷
মুআদালা করা৷ এই ক্ষেত্রে মদীনা ইউনিভার্সিটি, আল আযহার, নদওয়ার সিলেবাসটি সামনে রেখে পরীক্ষার সিলেবাস তৈয়ার করা এবং আরবীতে পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা৷
৩. বোর্ডগুলোর প্রাইমারি লেভেলের ও মুতাওয়াসসিতা পরীক্ষাকে সরকারি অনুনোদন নিয়ে নেওয়া৷ প্রয়োজনে সরকারি সিলেবাসের সঙ্গে সমন্বয় করে সেই অনুমোদন নেওয়া৷
পরিবেশ মাদরাসার, কিছু সিলেবাস স্কুলের৷ এতে তালেবে ইলমরা নিজস্ব পথ রচনা করতে পারবে৷ আমলি সমস্যা হবে না এতে৷ মাদরাসার তালেবে ইলমরাও স্কুল বা আলিয়ায় যাবার প্রয়োজন মনে করবে না৷
৪. হাইআতুল উলইয়ার অন্তর্ভুক্ত ছয় বোর্ডে সম্নিলিতভাবে একটি সিলেবাস প্রনয়ণ কমিটি গঠন করবে৷ পুরো কওমী মাদরাসার অভিন্ন বা কাছাকাছি একটি সিলেবাস উপহার দেবে যা হবে পুরনো ঐতিহ্য রক্ষা করে এবং আধুনিতাকার ভালো বিষয়গুলো সমন্বিত৷
চিন্তা চেতনায় দেওবন্দ কিন্তু দেশের চাহিদাও সামনে রেখে রচিত হবে সেই সিলেবাস৷
৫. প্রায় বিশ হাজার তালেবে ইলম মাওলানা হিসেবে বের হচ্ছেন ফি বছর৷ তাদের কর্মসংস্থানের একটি রুপতল্প তৈরি করা৷
৬. আধুনিক সব মেথড মেনেই হাইআতুল উলায়া বা একটি জামেয়া তালেবে ইলমদের এম ফিল, দাকতুরা ডক্টরেট দিতে পারে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং সেই গবেষণাপত্রগুলো প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা৷
৭. বোর্ডের কর্মচারি কর্মকর্তা নিয়োগবিধিতে বোর্ডের সেরা মেধাবীদের জন্য কোটা রাখা বা তাদের অগ্রাধিকার৷দেওয়া৷
৮. সরকারি প্রাইমারি স্কুল বা কলেজ ভার্সিটির শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও স্কেলকে সামনে রেখে কওমী মাদরাসার জন্য একটি অভিন্ন বেতন স্কেল তৈয়ার৷ এই স্কেল পালনে তাকাদা দেওয়া বা সুপারিশ করা৷
৯. বোর্ডের সেরা মেধাবীদেরকে শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে উচ্চশিক্ষায় দেশের বাইরে পাঠানো৷ দেশে ফেরার পর ভালো পদে খেদমতের সুযোগ রাখা৷
১০. বোর্ডগুলোর কমিটি গঠন না করে অন্যন্য শিক্ষাবোর্ডের আলোকে পদবিন্যাস করা৷ যদিও কমিটি করতেই হয় তাহলে দেশের খ্যাতিমান আলেমদের সদস্য যেহেতু রাখতেই হবে এটি রেখে বোর্ডে যারা ফলাফলে শীর্ষ থাকবে সেই মাদরাসাগুলো কমিটির সদস্যপদ লাভ করবে৷
অাঞ্চলিকতা, স্বজন হওয়া বর্জনীয় কমিটির সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে৷ কমিটিতে নদভী, মাদানী ও আযহারীদেরও অন্তরভুক্ত রাখা৷
লাবীব আব্দুল্লাহ
পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট
কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব; বেফাক যা করতে পারে