আতাউর রহমান খসরু
কোনো এক দরবেশের কাছ থেকে গফরগাঁয়ের জমিদারি পেয়েছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.। জমিদারির সনদ হিসেবে দরবেশ শিশু মুহিউদ্দীন খানের কানে একটা কলম গুজে দিয়েছিলেন।
কলমটি বুঝে পেয়েছিলেন তিনি এবং সাথে বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্যের জমিদারি।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. তার জমিদারির ওয়ারিস হস্তান্তর করে গেছেন এ দেশের অসংখ্য আলেমের হাতে। এখন আলেমদের হাতে হাতে কলম। তারা বাংলায় লেখেন, চর্চা করেন বাংলায় বলেন ইসলামের কথা।
আলেমরা এখন শুধু বাংলা লেখেন না বাংলা ভাষা নিয়েও লেখেন; এবং তা করেন বাংলা ভাষা বিষয়ে কথা বলার অধিকার তাদের হয়েছে বলেই। আজকের আয়োজন বাংলা ভাষার উপর লেখা ৩ আলেমের বই নিয়ে।
১. এসো কলম মেরামত করি
দারুল কলম, পৃষ্ঠা-৩২৯, মূল্য-১৬০
বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষাবিদ আলেম মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ। তিনি একটি শিক্ষাধারার স্রষ্টা। ভালোবাসেন শিশু ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে। তার জীবনের মূল সংগ্রাম আরবি ভাষার বিশুদ্ধ চর্চা হলেও বাংলাভাষার চর্চায় তিনি একজন সিদ্ধ পুরুষ।
তার শিক্ষা মিশনের মূল শ্লোগান ইসলামি শিক্ষার মাধ্যম হবে আরবি এবং তা চর্চা করা হবে বিশুদ্ধ বাংলায়।
কোমল হৃদয় শিশুদের বাংলা শেখাতে তিনি প্রকাশ করেন ‘পুষ্প’ নামের সাহিত্য পত্রিকা।
‘এসো কলম মেরামত করি’ মূলত পুষ্পের একটি পাঠকপ্রিয় বিভাগ। এ বিভাগে মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ শিশুদের নানান প্রশ্নের উত্তর দেন। ছন্দময় গদ্যে ধরিয়ে দেন তাদের ভুল। তারই সংকলিত রূপ ‘এসো কলম মেরামত করি’ বইটি।
মাওলানা আবু তাহের মিছবাহের চিরায়ত মায়াভরা গদ্যে ‘এসো কলম মেরামত করি’। বইয়ের শুরু অংশে লেখক বাংলা ভাষার অনাচার তুলে ধরে বুঝিয়েছেন কেনো আলেমদের কলমচর্চায় মনোযোগ দিতে হবে।
তবে ব্যাকারণ বইয়ের মতো নিরস আলোচনায় না যেয়ে সাহিত্যের সতেজ ঢেলে দিয়েছেন তাতে। মোট দশটি অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন লেখালেখির প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য, বানান, অলঙ্কার, সমালোচনা ও ডায়েরি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।
বইয়ে লেখালেখির বিষয় সমারোহ কম হলেও হৃদয় কল্লোলের কোনো কমতি নেই। যেমন কলমের ভাষ্যে লেখক বলেছেন, আর কতকাল থাকবে অচেতন গাফলাতের ঘুমে?
একদিন তো দাঁড়াতে হবে আল্লাহর সামনে। সেদিন আমি ফরিয়াদ জানাবো আল্লাহর কাছে। সেদিন আমি নালিশ দায়ের করবো তোমাদের নামে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তো কাওমের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছো তাঁর মুখে তাঁর কাওমের ভাষা দিয়ে, যেন তিনি তাদের সামনে প্রচার করতে পারেন হকের দাওয়াত এবং সত্যের বাণী।
কিন্তু এরা আমাকে পরিত্যাগ করেছিলো হে আল্লাহ! ফলে তোমার দুশমনদের হাতে আমার ইজ্জত-আবরু হয়েছে লুণ্ঠিত! আমি হয়েছি জাহেলিয়াতের বাহন। হে আল্লাহ আমি বিচার চাই, আমি ইনছাফ চাই।’
নিশ্চয় এ আবেগ বিবেক জাগানিয়া।
২. সাহিত্যের ক্লাস
মাকতাবাতুল আখতার, মূল্য-১৩০
নন্দিত কথাশিল্পী মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন। সময়ের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। পাঠকপ্রিয়তায় ইসলামি ধারায় শীর্ষ লেখক তিনি। প্রধানত লেখেন প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। তবে রয়েছে প্রচুর অনুবাদ ও একাধিক মৌলিক গ্রন্থ।
আর যখন বলেন, বলেন সাহিত্যের সব বিষয়ে। তার আলোচনা থেকে ধারণা পাওয়া বাংলা সাহিত্যে তার পাঠপরিধি সম্পর্কে। জ্ঞানের বিচ্ছুরণে মুগ্ধ হয় শ্রোতা-দর্শক।
সাহিত্যের ক্লাসে মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীনের সে জ্ঞানেরই বিচ্ছুরণ দেখা মেলে। ব্যাকরণিক কাঠামোতে নয়; তিনি সাহিত্যের পাঠ দিয়েছেন তার বিষয় ধরে ধরে। কথা বলেছেন, রচনা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, কবিতা, ফিচার, পত্রিকায় লেখালেখি সবকিছু নিয়ে।
সাথে সাথে বিষয় ও শব্দ নির্বাচন, অবয়ব ও কাঠামো, পরিধি ও আয়তন নিয়েও ধারণা দিয়েছেন বিজ্ঞ লেখক।
তবে সবকিছুর আগে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সাহিত্যের সঙ্গে। মনে করিয়ে দিয়েছেন, সাহিত্যচর্চার জন্য লেখকের কী কী মূলধনের প্রয়োজন হয়। তার কতোটা ঐশ্বরিক এবং কতোটা শ্রম-চর্চায় উপার্জন করা সম্ভব।
ছন্দময় ঝরঝরে গদ্যে লেখা বইটি পাঠককে টেনে নিয়ে যায় গভীর মগ্নতায়। পাঠক আরও চমৎকৃত হবেন যখন পাতায় উদাহরণ হিসেবে খুঁজে পাবেন আহমদ ছফা, হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ মুজতবা আলী, রবীন্দ্রনাথ, আল মাহমুদ, ফররুখ আহমদ, জীবনানন্দসহ অনেক মূলধারার লেখকদের উদ্ধৃতি।
সাহিত্যের ক্লাসের মনোযোগী পাঠক সাহিত্যের ধারাগুলো সম্পর্কে মৌলিক ধারণা লাভ করবেন এমনই প্রত্যাশা।
৩. ভাষা শিক্ষার আসর
নাদিয়া বুক কর্ণার, পৃষ্ঠা-১০৪, মূল্য-১১০
ইসলামি ধারার বনেদি লেখক মাওলানা আইয়ুব বিন মঈন। প্রচারবিমুখ আত্মমগ্ন এ লেখক যতোটা লেখেন তার চেয়ে বেশি পড়েন। খুব আগ্রহ দেখালে লেখে দেন দুই কলম। সোনাঝরা সে লেখায় থাকে প্রাণের প্রাচুর্য। লেখকের প্রাচুর্যভরা একটি বই ভাষা শিক্ষার আসর।
মাসিক রহমত যখন প্রচার ও খ্যাতির শীর্ষে তখন রহমতের পাঠকপ্রিয় বিভাগ ছিলো ভাষা শিক্ষার আসর। লিখতেন মাওলানা আইয়ুব বিন মঈন। সাবলীল ভাষায় তরুণদের জন্য লিখতেন বাংলা লেখার নিয়ম-কানুন। প্রাধান্য দিতেন লেখকের প্রয়োজনকে। তাই বাংলা ব্যাকারণের নির্বাচিত বিষয়ে লিখতেন মাসিক রহমতে।
পাঠকের অনমনীয় প্রত্যাশার সাড়া দিয়ে লেখক সম্পন্নতা দেন ভাষা শিক্ষার আসরকে।
ভাষা শিক্ষার আসর মূলত একটি ব্যাকরণিক বই। তবে গদবাধা ব্যাকরণ নয় এটি। লেখকের ভাষ্যে ‘লেখকরা সাধারণত যেসব বিষয়ে ভুল করেন আমি সেদিকেই গুরুত্ব দিয়েছি। বলা যায়, বাংলা ব্যাকরণের অবহেলিত অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’
বইটির চমৎকারিত্ব এখানে যে, বইটি ব্যাকরণের দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্ত। গদ্য কাঠামোও অত্যন্ত সাবলীল।
ভাষা শিক্ষার জন্য বইটিতে রয়েছে ৩২টি আসর। সেখানে আলোচিত হয়েছে, বহু বচনে দ্বিত্ব, সমাপিকা ও অসমাপিকা, চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার, উচ্চারণ, যতি চিহ্ন, ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান ইত্যাদি।
বইটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে তরুণ লেখকরা প্রাথমিক ভুল ভ্রান্তি থেকে বাঁচতে পারবে বলে আশা করা যায়।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক ১৬ বছরের এক কিশোরী