সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


বাংলা ভাষার দিবস কেন শুধুই ইংরেজিতে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাহনূর শাহীন

‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এই শ্লোগানকে বুকে ধারন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি  ভাষার জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিলো বাংলার দামাল ছেলেরা। বাংলায় সেই দিনটি ছিল ১৩৫৯ সালের ৮ই ফাল্গুন বৃহস্পতিবার।

সে দিন ছাত্র জনতা ভাষার জন্য ফুলের মত বুকে ধারন করেছিল ঘাতকের বুলেট। পাকিস্তানি ঘাতকের বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিয়েছিলো সালাম, বরকত, রফিক, শফিক জব্বর সহ আরো অনেকে। তারা প্রাণ দিয়েছিলো বাংলা ভাষার জন্য।

অথচ আজ সে ভাষা চরমভাবে অবহেলিত। বাংলা সনে সে দিনটি কত তারিখ ছিল আজকের বাঙ্গালিদের তা জানা নেই বা জানা থাকে না। গৌরবের দিনটি আজকে শুধুমাত্র ২১ ইংরেজিতে উদযাপন করি।

হ্যাঁ, সারা বিশ্বের মানুষ তো আর বাঙ্গালি নয় যে, তারা বাংলায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযান করবে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী বীর শহীদদের মহান আত্মদানের দিনটিকে শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্ববাসিও যে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করে এটাই আমাদের জন্য গর্ব।

সুতরাং ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন নিন্দনীয় নয়, বরং ৮ ফাল্গুনকে অবহেলা করাটা নিন্দনীয়। ভাষার প্রতি অবহেলা করা ভাষার অবমাননা করাটা চরম নিন্দনীয়।

শুধুমাত্র শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে নিরবতা পালন করার জন্য এতোগুলো তাজা প্রাণ নিশ্চয়ই ঝড়ে পড়েনি। সেদিন প্রান ঝড়েছিলো ভাষার স্বাধীনতার জন্য, ভাষাকে মুক্ত করার জন্য। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে আজ বাংলা ভাষা দিবসের কুঠিরে বন্দি হয়ে আছে।

ঘোষণা করা হোক ‘জাতীয় ভাষা শহীদ দিবস’। একসাথে পালন করা হোক ‘জাতীয় ভাষা শহীদ দিবস’ এবং ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে নিরবতা পালন করে বাংলা বর্ণমালা খচিত পোষাক পরে একদিনের জন্য তাও সম্পূর্ণ বিজাতীয়দের অনুকরণে ভাষা শহীদদের স্বরণ করে গান গেয়ে আনন্দ উৎসব করে দিনটিকে উদযাপন করে নিজেদের দায়িত্বকে আমরা শেষ মনে করি।

ভাষার দিনে রাস্তায় আঁলপনা আঁকি। বাংলা বর্ণমালার পসরা সাজিয়ে জুতা পায়ে মাড়িয়ে যাই; আবার শহীদ মিনারে জুতা পায়ে উঠে অনুপস্থিত শহীদদের অবমাননা করি।

এ যেন এক প্রকার তামাশা ছাড়া আর কিছুই না। যেই লোকটা দিনের বেলায় ভাষার জন্য মায়া কান্না করে সেই আবার রাতের বেলায় হিন্দি গানের আসর বসায়। এটা কি মাতৃভাষার অপমান নয়?

ইফোর্ট: টি শার্টে আধুনিকতা ও শালীনতার সমন্বয়

বাংলাদেশের সংবিধানের সবচেয়ে ছোট ধারাটি হলো ‘প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ ভাষা হবে বাংলা’ কিন্তু বাস্তবে আমরা সেটা দেখতে পাই না। এখনো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের অধিকাংশ রায় লেখা হয় ইংরেজিতে।

তবে হ্যাঁ, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় বাংলায় লেখা হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসা যোগ্য।

এছাড়াও দেশের বড় বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেমপ্লেট লেখা হয় ইংরেজিতে। ইংরেজী ব্যাবহার দোষনীয় নয় কিন্তু বাংলার ব্যাবহার তো থাকতে হবে! যেটা অনেকাংশেই হয় না।

৭০ এর দশকে সাংবাদিক এবি এম মূসা গাড়িতে বাংলা নেমপ্লেট ব্যাবহার করার কারনে মামলা খেয়েছেন কিন্তু আজকের বাংলাদেশে ইংরেজি নেমপ্লেটের কারনে কতজন মামলায় পড়েছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই।

বাংলা চর্চার অবহেলা এতোটা চরমে পৌছেছে যে এখনকার যুবক যুবতিরা বাংলা শব্দমালা মুখে আনতে লজ্জা পায়। যতটুকু বাংলার চর্চা করে ইংরেজির মিশ্রণে সেটা হয়ে যায় বাংলিশ।

বাংলা ভাষায় প্রসিদ্ধ এবং স্বীকৃত খ্যাতিমান কোনো সাহিত্যিকের আদরের সন্তান যখন বাংলা সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠানে এসে বলে সে বাংলায় কথা বলতে পারে না অথচ সে বাংলাদেশেই বাস করে একজন বাংলাভাষী সাহিত্যিকের জন্য এরচেয়ে বেশি লজ্জার আর কী হতে পারে?

এক্ষেত্রে বিভিন্ন গণযোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে এফএম রেডিও গুলো ভাষা বিকৃতি চর্চা কেন্দ্ররুপে আবির্ভূত হয়।

ভাষার মিশ্রণ ও বিকৃতিরোধে বারবার আদালতের রুলের পরও সেটা বন্ধ হচ্ছে না। বিশেষ করে বিজাতীয় সংস্কৃতির রাহুগ্রাসে আক্রান্ত তরণ প্রজন্ম যেন ভাষা বিকৃতির প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

এখনকার বাবারা সন্তানকে ইংরেজি শিক্ষা দিতে পারলে আনন্দ পায়। গর্ববোধ করে। হ্যাঁ, আধুনিক বিশ্বে ইংরেজির শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে তাই বলে সেটা শিক্ষার মাধ্যম হতে পারে না। ইংরেজি শিখবে তবে সেটা বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা বাংলা।

বাংলা ভাষায় প্রসিদ্ধ এবং স্বীকৃত খ্যাতিমান কোনো সাহিত্যিকের আদরের সন্তান যখন বাংলা সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠানে এসে বলে সে বাংলায় কথা বলতে পারে না অথচ সে বাংলাদেশেই বাস করে একজন বাংলাভাষী সাহিত্যিকের জন্য এরচেয়ে বেশি লজ্জার আর কী হতে পারে?

পৃথিবীর আর কোনো দেশে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে এমন কোনো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নেই। অথচ আজ সেই গৌরবময় বাংলা ভাষা চর্চায় নিজে যশ-খ্যাতি অর্জন করা সত্ত্বেও নিজের সন্তানকে মায়ের ভাষায় কথা বলা শিখাতে পারি না এরচেয়ে বড় ব্যর্থতা আমাদের জন্য আর কিছুই হতে পারে না।

ভাষা চর্চা নিয়ে তিন আলেমের ৩ বই

কেননা একজন লেখকের নিজের সন্তানই যদি তার লেখা কোনো সাহিত্য পাঠ করতে না পারে(!)  তাহলে তো তার কোনো স্বার্থকতা নেই।

বাংলা ভাষা চর্চা ও বিকৃতি রোধে সচেতন মহলকে আরেকটু সজাগ হতে হবে। এক একটা শিক্ষিত পরিবারকে শুদ্ধ ভাষা চর্চার পাঠশালা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সর্বত্র বাংলার ব্যবহার এবং প্রসারে রাষ্ট্রকে আরো আন্তরিক এবং সচেতন হতে হবে।

সুতরাং বাংলা ভাষাভাষি ও ভাষা প্রেমিদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের প্রতি জোর দাবি ও আহ্বান সর্বত্র বাংলার ব্যাবহার, ভাষার বিকৃতি মিশ্রণ ও ভাষার অবমাননা বন্ধে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

এবং বাংলা প্রেমিদের পক্ষ থেকে এই দাবি জানাচ্ছি শহীদদের মহান আত্মত্যাগের সেই দিনটিকে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় স্মরণ রাখতে ৮ ফালগুনকে বিশেষায়িত করা হোক।

ঘোষণা করা হোক ‘জাতীয় ভাষা শহীদ দিবস’। একসাথে পালন করা হোক ‘জাতীয় ভাষা শহীদ দিবস’ এবং ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

আসুন আমরা সবাই মিলে ভাষার বিকৃতি প্রতিহত করি। নিজেরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি এবং অন্যকে উৎসাহ প্রদান করি। জয় হোক বাংলার, জয় হোক মাতৃভাষার।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক, সহ-সম্পাদক আওয়ার ইসলাম

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ