আতাউর রহমান খসরু
গতকাল ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ১০ম কাউন্সিল।
কাউন্সিলে বেফাকের নতুন নির্বাহী কমিটির সাথে সাথে শিক্ষা ও কাঠামোগত একাধিক পরিবর্তনেরও ঘোষণা এসেছে।
এবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, ৩ স্তরে ৩টি নতুন কেন্দ্রীয় পরীক্ষা গ্রহণ। তাহলো, মক্তব, কাফিয়া ও ইফতা।
পরীক্ষা বিষয়ক বেফাকের নতুন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কওমি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নানামুখী আলোচনা চলছে দেশব্যাপী। আসছে পক্ষে ও বিপক্ষের মতামত।
মক্তব ও কাফিয়া জামাতে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা সরকারি স্বীকৃতি সামনে রেখে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের আলোকে বেফাককে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবেই করা হয়েছে বলে দাবি করছেন বোর্ড কর্মকর্তাগণ।
বেফাকের মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী কাউন্সিলের আগেই এক সাক্ষাৎকারে আওয়ার ইসলামকে এমনটিই বলেছিলেন।
তবে এর সঙ্গে ভিন্নমতও পোষণ করেন অনেকে। তারা মনে করছেন, কওমি শিক্ষাধারার (কিতাব বিভাগের) ৯ বছরে ৬টি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য শুধু বোঝাই হবে না; বরং কেন্দ্রীয় পরীক্ষার গুরুত্বও হ্রাস পাবে।
উত্তরা গাওয়াইর মাদরাসার মুহাদ্দিস ও বাংলাদেশ মাদরাসা কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান মুফতি জহির ইবনে মুসলিম মনে করেন, পরীক্ষার পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত মক্তবের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা শিশুদের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার ক্লাস ফাইভে সমাপণী পরীক্ষার নিয়ম করেছে। কিন্তু শিক্ষাবিদদের মত হলো, এতে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের কেন্দ্রীয় পরীক্ষার চাপে শিশুরা নূন্যতম স্বাধীন ও আনন্দময় জীবনের অধিকার হারাচ্ছে।
মক্তবে পরীক্ষার পরিণতি একই হবে বলে তিনি মনে করেন।
মুফতি জহির ইবনে মুসলিমের এ মতের সঙ্গে একমত হতে পারেন নি দেশের শীর্ষ দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার শিক্ষা সচিব মুফতি আশরাফুজ্জামান।
তিনি মনে করেন, মক্তবে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে দেখেছি, অনেক শিক্ষার্থী তাকমিল সম্পন্ন করে ফেলছে। অথচ তাদের কুরআন তেলাওয়াত কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। মক্তবের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা হলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
অভিজ্ঞ এ শিক্ষা সচিব মনে করেন, কাফিয়া জামাতের পরীক্ষারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তার মতে, হেদায়াতুন্নাহু থেকে শরহে জামি পর্যন্ত গ্যাপটা অনেক বেশি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী এ গ্যাপ লাফিয়ে পার হতে যেয়ে তাদের পা ভেঙ্গে ফেলে। পরবর্তী জামাতগুলোতে তার খেসারত দিচ্ছে।
মুফতি জহির ইবনে মুসলিমও মনে করেন, কেন্দ্রীয় পরীক্ষার অধীনে না হলেও কাফিয়া ও শরহে জামি জামাত মাদরাসায় মাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কারণ, এ জামাতগুলো না থাকায় শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। এছাড়াও জামাত দুটি না থাকলে ১৬ বছরের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে তাল মেলানো যাবে না।
মাদারীপুরের জামিয়াতুস সুন্নাহ মাদরাসার পরিচালক ও বেফাকের শুরা সদস্য মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী মনে করেন, কাফিয়া জামাতের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
তার যুক্তি হলো, এতে পরপর দু’বছর কেন্দ্রীয় পরীক্ষা হবে। কেননা অধিকাংশ মাদরাসায় এখন শরহে জামি জামাত নেই।
মক্তবের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এ পরীক্ষাটি যদি ক্লাস ফাইভের সমাপণীর সমমানের করা যায় তাহলে তা খুবই উপকারী সিদ্ধান্ত হবে। কেননা তখন আলেমরা বলতে পারবে শিশুদের স্কুলে না দিয়ে মক্তবে দেন।
এখন সমাপণী পরীক্ষার জন্য শিশুরা স্কুলমুখী হচ্ছে। কুরআন ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
নিয়মাতান্ত্রিক শিক্ষা কারিকুলামের বাইরে ইফতা বিভাগের পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ছিলো এবারের কাউন্সিলের বিশেষ চমক। বেফাকের চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফী এ সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে অনিয়ন্ত্রিত ইফতা বিভাগের আধিক্যকে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, আগে আমরা দেশে মুফতি হিসেবে কয়েকজনকে চিন্তাম। এখন মক্তবের শিক্ষকও মুফতি!
ইফতা বিভাগের পরীক্ষাগ্রহণের ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন উল্লিখিত ৩জন আলেম শিক্ষাবিদ। তারা বলেন, এর মাধ্যমে যত্রতত্র ইফতা বিভাগ গড়ে ওঠা থামানো যাবে এবং এ বিভাগের একটি মান প্রতিষ্ঠিত হবে।
এ সিদ্ধান্তের জন্য তারা বেফাককে আন্তরিক মোবারকবাদও জানান।
প্রশ্ন হলো, ইফতা তখন কতো বছরের কোর্স হবে? মুফতি আশরাফুজ্জামান ও মুফতি জহির ইবনে মুসলিম উভয়ে মনে করেন ইফতাম বিভাগের নূন্যতম মেয়াদ দু’বছর হতে পারে।
শুধু ইফতা নয় মুফতি আশরাফুজ্জামানের মতে তাকমিল জামাতকেও দু’বছর করা উচিৎ।
এতে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্য তৈরি হবে, তেমনি হাদিসের পাঠদানও উপযুক্ত মানে দেয়া সম্ভব হবে।
বেফাকের ১১৬ সদস্যের নতুন কমিটিতে স্থান পেলেন যারা
তিনি জানান, বেফাকের মিটিংয়ে তিনি তাকমিলকে দুবছর করার প্রস্তাব করেছেন এবং বেফাকের নীতি নির্ধারকগণ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।
বেফাক কাউন্সিলের পূর্বে মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী আওয়ার ইসলামকে বলেছিলেন, বেফাকে যেসব দেশ বরেণ্য উলামায়ে কেরাম যুক্ত হয়েছেন তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিৎ।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে কিনা? নতুন নির্বাহী কমিটি ঘোষণার পর এতো সমালোচনাও বা হচ্ছে কেনো? তিনি বলেন, যা হয়েছে তা মন্দ নয়। তবে সারা দেশ থেকে আগত ডেলিগেটদের সরাসরি ভোটদানের সুযোগ দিলে মূল্যায়নও যেমন যথার্থ হতো, সমালোচনারও সুযোগ বন্ধ হতো।
তিনি আশা করেন, ভবিষ্যতে ডেলিগেটরা সরাসরি ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন।
বেফাকের কাউন্সিল: প্রত্যাশা পূরণ হলো কতটুকু?