মুফতি সালমান আহমাদ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন আলেম। তিনি একাধারে লেখক, দায়ি ও সমাজসেবক। লেখাপড়া করেছেন ঢাকার কাকরাইল ও চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে। ইফতা করেছেন রাজধানী ঢাকার মসজিদে আকবর কমপ্লেক্সে।
বর্তমানে হাদিস পড়ান ঢাকার মেরাজনগর মাদরাসায়। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে সফর করেছেন বিশ্বের বহুদেশ। আছে একাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
মুফতি সালমান আহমাদ বাংলাদেশের সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের জন্য ‘দ্বীনিয়াত’ বিশেষ শিক্ষাধারা পরিচালনা করছেন। বিশ্বের প্রায় ৬০ দেশে চলমান এ বিশেষ শিক্ষা কারিকুলাম তার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
অভিজ্ঞতা চলবে, এ কারিকুলাম অনুসরণ করলে একজন শিক্ষার্থী দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় ইসলামি জ্ঞান লাভ করে; এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমা ও জানাযায় ইমামতি করার যোগ্যতা অর্জন করে।
মুফতি সালমান আহমদের সঙ্গে বিশেষ এ শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কথা বলেন আওয়ার ইসলাম বার্তা সম্পাদক আতাউর রহমান খসরু।
আওয়ার ইসলাম : ‘দ্বীনিয়াত’ কাযক্রমের বিবরণটা যদি তুলে ধরতেন?
মুফতি সালমান আহমাদ : দ্বীনিয়াত হলো সাধারণ মানুষকে দীন শেখানোর একটি কার্যক্রম। সাধারণ মানুষ বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যারা মাদরাসা-মসজিদ-খানকার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দীনি শিক্ষা অর্জন করছে না। বরং তারা সাধারণ শিক্ষায় গ্রহণ করছে বা করেছে। অথবা যারা কোনো প্রকার শিক্ষাই গ্রহণ করে নি।
আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, বর্তমান বিশ্বে মুসলমানের ৯৮ ভাগই এ শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। ৯৮ ভাগ মুসলিমকে দীনি শিক্ষা প্রদানের একটি বিশেষ কারিকুলামের নাম দ্বীনিয়াত। অন্যভাবে বললে, দ্বীনিয়াত শিক্ষা কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। শিক্ষা পরিচালনা, শিক্ষা নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষা উপকরণ (বই-পুস্তক) তৈরি ও প্রকাশ করে থাকে।
আওয়ার ইসলাম : দ্বীনিয়াতের চিন্তা ও যাত্রা কিভাবে শুরু হয়েছিলো?
মুফতি সালমান আহমাদ : দ্বীনিয়াতের যাত্রা শুরু হয় ১৯২৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তখন দক্ষিণ আফ্রিকার আলেমরা দেওবন্দের সাথে যোগাযোগ করে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রিদের দ্বীন শিখার আয়োজন করে। দক্ষিণ আফ্রিকার কারিকুলামটির নাম তাসহিল।
ভারতের একদল মুসলিম দক্ষিণ আফ্রিকায় হিজরত করেন। হিজরত করার পর তারা দেখতে পান সেখানে মুসলিম শিশুদের জন্য ইসলামি শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
তখন তারা সাধারণ শিক্ষা লাভের পাশাপাশি মুসলিম শিশুরা যেনো ইসলামি শিক্ষা লাভ করতে পারে সেজন্য এ কারিকুলাম চালু করেন। ভারতের মুম্বাইয়ে যিম্মাদার হাজী রফিক সাহেব এই বিষয়টির জন্য নিজের জান মাল কুরবান করেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় আলেম উলামা দারুল উলুম দেওবন্দের পরামর্শে এ সিলেবাস প্রণয়ন করেন। যুগে যুগে উলামায়ে কেরামই এ শিক্ষা কারিকুলামের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
অবশ্য এরপর এ শিক্ষা কারিকুলামের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টি দেশে দ্বীনিয়াতের স্বীকৃত কাযক্রম রয়েছে এবং অস্বীকৃতভাবে প্রায় ৭০টি দেশে এ শিক্ষা কারিকুলাম চলছে। দ্বীনিয়াতের সিলেবাসভূক্ত বইগুলো প্রায় 3০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
আওয়ার ইসলাম : দ্বীনিয়াতের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে যদি ধারণা দিতেন?
মুফতি সালমান আহমাদ : দ্বীনিয়াতের শিক্ষা কারিকুলাম ৩ স্তর বিশিষ্ট। ১. প্রাইমারি, ২. সেকেন্ডারি, ৩. এ্যাডভান্স। এ তিন স্তরের শিক্ষা কারিকুলাম দুইভাবে পরিচালিত হয়।
এক. স্কুলের সাধারণ পাঠ্যসূচির সাথে।
দুই. সকাল বেলার মক্তবে। স্কুলের সাথে পারিচালিত হলে সময় লাগে ১৫ বছর। আর মক্তবে পড়ানো হলে সময় লাগে ২ বছর করে ৬ বছর। তবে উভয় ক্ষেত্রে দ্বীনিয়াত প্রতিদিন সময় নেয় ১ ঘণ্টা করে।
দ্বীনিয়াত দুটি প্রতিষ্ঠানকে অনুসরণ করে চলে। শিক্ষা ও সিলেবাসের ক্ষেত্রে দারুল উলুম দেওবন্দকে অনুসরণ করে এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দাওয়াত-তাবলিগের নীতি অনুসরণ করে।
আওয়ার ইসলাম : দ্বীনিয়াতের সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের জন্য কি কি বিষয় রাখা হয়েছে?
মুফতি সালমান আহমাদ : দ্বীনিয়াতের সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের ৫টি বিষয় শেখানো হয়। কুরআন, হাদিস, আকাইদ-মাসায়েল, ইসলামি তরবিয়্যাত ও আরবি ভাষা। আমরা শিক্ষার্থীদের কুরআন শরিফ দেখে পড়ানো শেখানোর পাশাপাশি ২৩ সুরা মুখস্থ করাই।
৪০টি হাদিস মুখস্থ করানোর পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক হাদিস মুখস্থ করানোর হয়।
বিশুদ্ধ আকিদা-বিশ্বাস শেখানো হয়। নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাতসহ মুসলমানের চব্বিশ ঘণ্টার জীবনে প্রয়োজনীয় সব বিষয়ে মাসায়েল ও দোয়াসমূহ শেখানো হয়। ইসলামি তরবিয়্যাত হলো, শিশুদের জীবনে ইসলামি শিক্ষা ও শিষ্টাচার প্রোথিত করে দেয়া। তার মন-মগজে ইসলাম সেট করে দেয়া।
আওয়ার ইসলাম : দ্বীনিয়াতের সঙ্গে আপনি কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন?
মুফতি সালমান আহমাদ : ২০০৯ সালে আমি মদিনার মসজিদে নববিতে বসা ছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনুস সাহেব আমাকে বললেন, মাওলানা! আপনি মক্তবের খেদমতটা করেন।
আমি হাদিস পড়াই। কিতাব ও বড় জামাতের ছাত্রদের পড়াই। তাই সেখানের মক্তব বা ছোট বাচ্চাদের প্রতি তেমন গুরুত্ব দিলাম না। আসরের সময় তিনি আবার আমাকে বললেন। আমি তখন রাজি হলাম।
তিনি বললেন, আমি জোহর থেকে আসর পযন্ত রওজায় বসে আপনার জন্য দোয়া করেছি। যেনো আপনি রাজি হন। এর পর আমি পাকিস্তানের দ্বীনিয়াত প্রধান মাওলানা হানীফ সাহেবের সাথে দেখা করতে যাই।
এরপর আমি দ্বীনিয়াতের কাজ দেখতে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সফর করি। এছাড়াও ব্রাজিল, চিলি ও পানামাসহ বিভিন্ন দেশে দ্বীনিয়াতের কাযক্রম দেখেছি। বেশ কয়টি দেশ সফর করে আমার এই সিলেবাসের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হয়। আমি ভারতের মুম্বাইয়ে যোগাযোগ করে বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ করি।
১ম ও ২য় বর্ষের বইয়ের পড়ানোর বিস্তারিত বিষয়ে জানি। পরে বাংলাদেশে মুফতি নোমান সাহেবকে নিয়ে আমি প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করি ২০১১ সালে। ঢাকার মেরাজ নগর মাদরাসা থেকে।
তারপর ২০১৫ সালে কিশোরগঞ্জের মাওলানা আবদুল কাইয়ূম অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ছিলাম। সম্প্রতি কিছু বিষয় সামনে আসায় তাকে সব কাজ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে।
আওয়ার ইসলাম : দ্বীনিয়াতকে বলা যায় একটি সম্প্রসারিত মক্তব। মক্তবের প্রতি কেনো আপনারা গুরুত্ব দিলেন?
মুফতি সালমান আহমাদ : একটা সময় আমাদের দেশের প্রতিটি মসজিদে একটা করে মক্তব ছিলো। শিশুরা সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে মক্তবে দীন শিখতো। কিন্তু এখন সে মক্তব হারিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেনো শিশুরা সকালে মক্তবে পড়তে না পারে। ফলে মক্তবও থাকছে না আর শিশুরা দীন শিখতে পারছে না।
আমাদের আকাবিরদের সবাই প্রচেষ্টা ছিলো কুরআনি মক্তব ছড়িয়ে দেয়ার। যেনো শিশুরা দীনের মৌলিক শিক্ষা লাভ করতে পারে। হজরত শায়খুল ইসলাম মাহমুদ হাসান, হজরত আবুল হাসান আলি নদভি, হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. সবাই মক্তব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।
হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. ও তার শিষ্য চরমোনাইয়ের মরহুম পির সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার কুরআনি মক্তব প্রতিষ্ঠার কাযক্রম শুরু করেছিলেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি। আকাবিরদের বেদনার জায়গা থেকেই আমাদের এ কার্যক্রম।
আওয়ার ইসলাম : বলছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কুরআনি মক্তব প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী?
মুফতি সালমান আহমাদ : দুটি দিক রয়েছে এখানে। এক. আমাদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের মসজিদভিত্তিক কুরআনি মক্তবগুলোর সিলেবাস, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পাঠদান পদ্ধতি নির্ধারিত নয়। প্রত্যেক শিক্ষক তার মনমতো পড়ান, পরিচালনা করেন।
দুই. পরিবেশের অবনতি। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের অবনতির কারণে শিশুরা মক্তববিমুখ হচ্ছে।
পরিবেশগত কারণেও অনেকে শিশুদের মক্তবে দেয় না। আমরা চাচ্ছি উভয় ধরনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে।
আওয়ার ইসলাম : সেটা কিভাবে?
মুফতি সালমান আহমাদ : আমাদের পরিচালিত দ্বীনিয়াত মক্তবগুলোর নির্ধারিত সিলেবাসে আছে, নির্ধারিত ব্যবস্থপনায় চলে এবং পাঠদান পদ্ধতিও রয়েছে। আমরা শিক্ষকদের আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
এখন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে সকালে শিশুদের মহল্লার মসজিদে যাওয়ার সুযোগ হয় না।
এজন্য আমরা বাচ্চাদের সময়ের সাথে সময় মিলিয়ে পাঠদান করি। শিক্ষকের সময় অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে পাঠদান নয়; শিক্ষার্থীর সময় অনুযায়ী তাকে পাঠদান করা হয়। আর আমরা বলি শিশুকে ঘরের পরিবেশ থেকে উত্তম পরিবেশে শিক্ষা দান করবো।
আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশে দ্বীনিয়াতের কাজ কবে শুরু হয় এবং বর্তমানে কয়টি সেন্টার রয়েছে?
মুফতি সালমান আহমাদ : আমি শ্রীলঙ্কা সফর করে এসেই দ্বীনিয়াতের কাজ শুরু করার চেষ্টা করি। কিন্তু বই ও পাঠদান পদ্ধতি কোনোটি আমার আয়ত্বে ছিলো না।
সব আয়োজন করে দ্বীনিয়াতের কাজ শুরু করতে তিন বছর সময় লেগে যায়। ২০১১ সালে দীনিয়াতের কাজ শুরু করতে পারি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার মিরাজনগর মাদরাসায় দ্বীনিয়াতের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ছয়শো সেন্টারে ১২ হাজার শিশু পড়ছে।
আওয়ার ইসলাম : শিক্ষকদের কিভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে?
মুফতি সালমান আহমাদ : কোথাও যদি ৫০ শিক্ষক এক হতে পারেন। তাহলে আমরা যেয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসি। আর তা না হলে নির্ধারিত সময়ে আমাদের প্রশিক্ষণ সেন্টারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
শিক্ষক প্রশিক্ষণে শিশু মনোবিজ্ঞানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। শিশুদের মনোভব বুঝে যেনো তাদের শিক্ষা দিতে পারে।
আওয়ার ইসলাম : শিশু মনোবিজ্ঞানের বিষয়টি যদি আরেকটু বিশ্লেষণ করে বোঝাতেন?
মুফতি সালমান আহমাদ : শিশুদের মেধা-বুদ্ধি অপরিপক্ক। তারা আনন্দপ্রায়াসী। শিশুদের পাঠদানের সময় তাদের মনের চাহিদা ও মেধার ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে। আমরা জানি শিশুরা সংগিত পছন্দ করে। এজন্য আমাদের বইতে ১০টি সংগিত রাখা হয়েছে। তাদের মুখস্থ করানো হয় এবং সুরও শেখানো হয়।
আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশের আলেমগণ দ্বীনিয়াতকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মুফতি সালমান আহমাদ : মারকাযুদ দাওয়ার আলেম মুফতি আবদুল মালেক দ্বীনিয়াতের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি ভারতের মুম্বাই সফর করে দ্বীনিয়াতের কার্যালয় দেখে এসেছেন। জামিয়া রাহমানিয়ার মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুল হক এ কাজকে উৎসাহিত করেন। ফেনির মাওলানা আবু মুসা লন্ডনি হুজুর বলেছেন, এটি একটি তাজদিদি কাজ। যুগের চাহিদা অনুযায়ী এটি উত্তম ব্যবস্থা।
২০১৬ সালে হাটহাজারি মাদরাসায় গেলে আল্লামা আহমদ শফী বলেন, আমি ৪০ বছর যা খুঁজছি তা দ্বীনিয়াতে পেয়েছি।
আওয়ার ইসলাম : আপনি কতোটা আশাবাদী?
মুফতি সালমান আহমাদ : এ পযন্ত যতোটুকু সাফল্য পেয়েছি। তাতে আমি অনেক আশাবাদী। আমার মনে হয়, আগামী কয়েক বছরে বাংলার ঘরে ঘরে দ্বীনিয়াত পৌঁছে যাবে।
এটি