আওয়ার ইসলাম
আপাতত বিএনপির ব্যাপারে কঠোর মনোভাব না দেখালেও দলটিকে চাপে রাখার অবস্থান থেকে সরছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং দলীয়ভাবে বিএনপিকে ছাড় না দেওয়ার অবস্থানেই থাকছে শাসক দল।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে দল ও সরকারের এমন মনোভাবের কথাই জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর থেকে বিএনপির ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকার কারণে সরকার পরিচালনায় ‘অহেতুক’ সমস্যা এড়ানো গেছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ ও সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণেই বিএনপির চেয়ারপারসনের কারাগার যাওয়ার মতো বড় ঘটনার পরও বিএনপি নমনীয় অবস্থানে রয়েছে। সহিংস ও নাশকতা থেকে দূরে রয়েছে।
বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন হলো, দলটি এখন ভেতর-বাইরে চাপে আছে। এ কারণে কঠোর অবস্থান না নিয়ে দলটি ‘ধীরে চলো নীতি’ নিয়েছে। এই নীতি নেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির যেসব বিবেচনা কাজ করেছে তা হলো, বিএনপি বুঝতে পেরেছে তারা গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছে, সেই নির্বাচন ঠেকাতে এবং পরে সরকার পতনে সহিংসতার পথে গিয়ে অযথা শক্তিক্ষয় হয়েছে, দলের ক্ষতি হয়েছে। এবার যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, দলটি নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ কোনোমতেই ছাড়বে না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে অযথা সহিংসতার পথে গিয়ে শক্তিক্ষয় তাদের লক্ষ নয়।
বিএনপি সম্পর্কে এখনকার মূল্যায়ন এমন হলেও আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপি সময় বুঝে কঠোর হতে পারে। আর আওয়ামী লীগের ‘ন্যূনতম নমনীয়’ অবস্থানকে ‘দুর্বলতা’ দেখিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে।
আওয়ামী লীগ কি বিএনপির ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে থাকবে? এই প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে শক্ত বা নরম পথ বলে কিছু নেই। বিএনপি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছে, তারা সন্ত্রাসী সংগঠন।
তারা ২০১৫ সাল পর্যন্তও জ্বালাও-পোড়াও করেছে, পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে। সেখানে একটি সরকার জনগণের জন্য যা প্রয়োজন, তা-ই করবে। ফরুক খানের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘আপনি ভাঙচুর করবেন, মানুষ মারবেন আর বুক ফুলিয়ে চলবেন, তা হবে না। আওয়ামী লীগ বা সরকার সেটা হতে দেবে না।’
ফারুক খান বলেন, যেসব মামলা খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আছে, সেগুলো তাদের গতিতে চলবে। এসব আদালতের বিষয়। আর পৃথিবীর সব দেশের প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব কাজ করে, তা-ই করবে আওয়ামী লীগ সরকার।
গত বৃহস্পতিবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন। খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর সাজার ক্ষেত্রে তাঁর বয়স ও সামাজিক মর্যাদাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে আদালত জানান।
এই রায়কে কেন্দ্র করে সরকার তার কঠোর অবস্থানই জানান দিয়েছে। একাধিক মন্ত্রীর কথায়ও সেই বিষয়টি ফুটে ওঠে। রায়ের পরপরই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতেই হবে। আপিলের জন্য ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেতে যে দেরি হবে, তাও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। আইনমন্ত্রী গতকাল বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জঙ্গিবাদে ওস্তাদ। তাই জানমালের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে।’
আইনি পন্থায় বিএনপিকে চাপে রাখার প্রক্রিয়া শুধু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাতেই শেষ হচ্ছে না; খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানিও শেষ পথে। এরপর আছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা। সেই মামলার অন্যতম আসামি তারেক রহমান।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দলকে আরও সংগঠিত করে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্য শিগগিরই দলকে সুসংগঠিত করার ওপর জোর দিচ্ছে দলটি। খালেদা জিয়া কারাগারে, তারেক রহমান লন্ডনে—এমন পরিস্থিতি কি শাসক দলের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে? প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাড়তি কোনো সুবিধা নেওয়ার অভিপ্রায় নেই।
তবে দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড পাওয়া কোনো দলীয় প্রধানকে নিশ্চয়ই জনগণ পছন্দ করবে না। জনগণ আমাদের কাজকেও মূল্যায়ন করবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার। তিনি আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে পিএইচডি করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর মতে, এখনই আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে যাবে না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো একটি অভিজ্ঞ দল এখনই কঠোর হওয়ার মতো অবস্থান নেবে বলে আমার মনে হয় না। এর কারণ, দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তার ঘাটতি এমনিতেই দেখা দেয়। নির্বাচন হতে আরও আট থেকে নয় মাস বাকি। এখন কঠোর হলে তা বিএনপির জন্য সুফল বয়ে আনবে।’