আবুল ফাতাহ কাসেমী
প্রকৃতির পেট চিরে কবিতার জন্ম। নদীর দীর্ঘশ্বাস থেকে কবিতার সৃষ্টি। একেকটি স্বার্থক কবিতা উড়ে উড়ে উঠে যায় হৃদয় তরঙ্গের সাথে অচেনা অনন্য অতীন্দ্রীয় উচ্চতায়।
সমাজে যারা কবি তারাই সভ্যতা সৃষ্টি করেন অলৌকিকতার মন্ত্রে। তাদের প্রখর দৃষ্টিতে বাদ পড়ে না কালের বিচিত্র আয়োজন কিংবা সমাজ সংসারের ঘটমান অদেখা কোন অনুষঙ্গ।
কালে কালান্তরে কবিতা হয়ে উঠে গগণভেদি হৃদয়ভেদি। জন্ম-সৃষ্টি থেকে অনন্ত পথের যাত্রা পুরোটাই কবিতার দখলে। আল মাহমুদ কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন—
কবিতা কী?
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস,
ম্লানমুখ বউটির দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নিল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতাতো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার।
এমনই মায়াবী নিসর্গ, রঙিন জীবন ও বৈচিত্রেপূর্ণ জগতের দুর্ভেদ্য রহস্য উন্মোচন করেছেন বহু ধ্রুপদী কবিতার জনক ফয়জুল্লাহ আমান। তিনিও জীবনের বসন্তকে খুঁজে চলেছেন প্রকৃতির পাঠশালায়। ‘চেহেল কাব্য’র সাধারণ কয়েকটি পংক্তির ব্যঞ্জনা দেখুন—
এই কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে আমার চোখে
অনন্য জীবনের ছবি ভাসে
রূপময় ঝলমলে বসন্তের রঙিন দিনের
ধীর পদশব্দ যেন শোনা যায়
অথবা ঝরাপাতার শব্দে যেমন বলেছেন—
পৃথিবীর সান্ধ্যকালে এই গোধূলিতে দাঁড়িয়ে
আমার মন চায় অবিরাম ঝরাপাতার শব্দ শুনি
মন চায় জ্যোৎস্নারাতে চাঁদের আলোয় বৃষ্টিতে ভিজি
মনোরম অন্ধকার, নৈশব্দ আর তারার আলো মাখি অবসন্ন দেহে।
একই কবিতায় একটু পর লিখেছেন—
যেখানে দীর্ঘ হয় কম্পমান ছায়াবীথি—
হে আমার দেশ আমাকে কয়েকটি লহমা দিয়ো
যেখানে আনন্দ আছে লীলাময় স্নায়ুচৈতন্য নিয়ে
বৃষ্টির ফোঁটা এবং অবিরাম ঝরাপাতার শব্দে...
নিত্যদিনের অতি সাধারণ বিষয় নিয়েও যে শক্তিশালী কবিতা রচনা করা যায় তা ফুটে ওঠে বেশ কিছু পৃষ্ঠায়। ‘সকাল’ কবিতায় বলেন—
সত্যি! সকাল বড় মধুময়, প্রাণময়, প্রেমময়।
নির্মল আনন্দের এক ফল্গুধারা
সকরুণ সৌন্দর্যের সীমাহীন হাতছানি
প্রেয়সীর গোলাপি তুলতুলে গালের মতই
বিস্ময়কর কোমল মোহনীয়
রূপমাধুরী।
প্রতিটি সকাল পদ্মপাতার মত
অনিন্দ্য কিছু মুহূর্ত সমষ্টি।
প্রকৃতি পাঠক এমন কবি এই কবিতার দেশে অপ্রতুল নয়। তবে কবি ফয়জুল্লাহ আমানের চিন্তারস, বাক্যচালনা এবং থরে থরে সাজানো শব্দিক গাঁথুনি দিয়ে সভ্যতা নির্মানে তিনি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন বলতেই হয়। কারণ তিনি কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার সংযোগ ঘটান। ভাবেন সাধারণ চিন্তারেখার ঊর্ধ্বে উঠে। একথা বলা চলে চেহেল কাব্যের আদ্যোপান্ত প্রতিটি কবিতার ক্ষেত্রেই।
‘চেহেল কাব্যে’ তিনি ভাবনার উদয় অস্তে লাকোচুরি খেলেছেন। এক রহস্যময় স্বর্ণালী কাব্যজগত রচনা করেছেন সেখানে তার নিজস্ব শৈলীতে। নদীর তরঙ্গের মত গেয়ে চলেছেন অতীত বর্তমান আর বোধের এপিঠ ওপিঠ নিয়ে। নীলাঞ্জনার কথাই বলি—জগতে নর নারী নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই। রুক্ষ পাষাণ আসলে কে? নর না নারী?
নারীকে চিরকাল স্রোতস্বনী নদী অথবা পাখি অথবা ফুলের সঙ্গেই তুলনা করা হয়ে এসেছে। নারীর কোমল রূপের বর্ণনাই কবিরা দিয়ে থাকেন। সর্বংসহা সৌম্য ধরীত্রির প্রতিকৃতি নারী যে শুধু মমতাময়ী তা-ই নয় তার একটি কঠিন রূপও আছে। সেই কাঠিন্য দিয়েই বেধে রেখেছে পৃথিবীকে। সভ্যতার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছে নারী।
পাহাড়ের মত তার ভেতর যে অপরিসীম শক্তিও রয়েছে সেদিকে ইঙ্গিত পাবেন নীলাঞ্জনা কাব্যে। কয়েকটি পঙ্কক্তির পসরা—
সাগর যেমন পাহাড় পানে
যায় ছুটে খুব উছল মনা
তোমার তরে আমার বুকেও
ঢেউ ওঠে হে নীলাঞ্জনা।
সাগর জলের কান্না শুনে
পাষাণ তোমার দিল গলে না;
তোমায় দেখে বুঝতে পারি
সৈকতে কেন জল গো লোনা।
পাহাড় হয়েই থাইক তুমি
আমার পাড়ে রাত্রি দিনে
যুগ যুগান্তর
এমন নীরস উদাস কঠিন
আলিঙ্গনে নীলাঞ্জনা।
কবিকে হতে হয় উদার; উদারতার আহŸান কবিকে মহৎ করে তোলে। যুগে যুগে কবিরা তাদের কাব্যে ঔদার্যের কথা বলে এসেছেন। চেহেলকাব্যে আর্দ্র আদর কবিতা পড়ে মনে হয় কবিদের এত কবিতার পর এখনও এ বিষয়ের কাব্য আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। কবি বলেন—
এই পৃথিবী যত কঠিন হোক
আমি সর্বত্র কোমল মমত্বের অমিয় সুধা বিলিয়ে যাব।
এ কবিতার শেষে প্রেয়সীকে সম্বোধন করে কবি লিখেন—
তুমি যতই হৃদয়হীনা হও প্রিয়তমা
আমি তো আর্দ্র মরমি,
অনবরত কোমল ¯পর্শে তোমার সব ক‚লে
অনন্ত আদর ছড়িয়ে যাব।
কবিরা মানুষকে জাগিয়ে যায়; জাগরণের গান গেয়ে যায়। জাগৃতি কবিতায় কবি লিখেন—
আমি আরেকবার জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখছি
মেঘে ঢাকা অন্ধকার মধ্য রাতের ঝঞ্ঝাবায়ুতে
আজকের এই এলোমেলো সময়ের পাতা উল্টে
আমি মহা জাগরণের রঙিন মখমল স্বপ্ন বুনছি
নবী প্রেমের কথাও এসেছে কয়েকটি কবিতায় যেমন অবিনশ্বর প্রেমের কয়েকটি পংক্তি—
মনের মাঝে লুকিয়ে রাখি
সঙ্গোপনে তোমার ছবি;
তুমি আমার মন গগনে
জ্বলছো চির হৃদয় রবি।
দীপ্ত বদন সূর্যসম
সৃষ্টিকুলের প্রিয়তম;
তাইতো তোমায় নিত্য নাতের
ফুল মালাতে সাজাই নবী।
সবুজ গম্বুজ কবিতায় লিখেন—
আমি আকাশে আকাশে সিদরাতুল মুন্তাহায়
রফরফের সবুজ মখমল গালিচায়
হাঁটছি.. কোন অনাদি আযাল থেকে..
চির সুন্দর সবুজ গম্বুজের পানে
দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রেমে আহ্লাদে কাতর উম্মতি।
পৃথিবীর নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের জন্য কেঁদে ওঠে কবির মন। কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থী রোহিঙ্গাদের নিয়ে লেখা কবিতায় তিনি পাঠককেও ক্রন্দন সিক্ত করে ফেলেন—
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ভেতর হাঁটছি উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে
সারি সারি পলিথিন তাঁবু, কাদাভরা উঁচু নিচু উপত্যকা,
সীমান্তজোড়া অসমতল রাবার বাগান
রোহিংগা ছেলে বুড়ো নারী পুরুষের অসহায় মিছিল
নাইখ্যাংছড়ি তম্বুরা হ্নীলা পর্বতে পাহাড়ে নাফ নদের
তীর ধরে হাঁটছি দেড়শ কোটি মুসলিম
ব্যথিত শোকাহত নির্বাক কষ্টের অনলে জ্বলে...
কবি যে শুধু প্রেমের কথাই শোনায় তা নয় কবির এক হাতে বাকা বাঁশের বাঁশরী তো অন্য হাতে অবশ্যই রণত‚র্য রাখতে হয়। বর্বর মানবরূপি দানবদের উদ্দেশে তাই কবি লেখেন—
হায়েনার দল আগে তোরা
মানুষ হ
পরম প্রেমের গল্প তারপরে
মুখে আন।
খৈয়ামের অনুকরণে লেখা বারোটি রুবাইয়াতও আছে এ সঙ্কলনে। পাঠকের জন্য একটি রুবাইয়াত তুলে ধরা হলো—
হৃদয় আমার তোমার প্রেমের
নীল অনলে হচ্ছে ভুনা।
এই চিৎকার তোমার কানে যায় কি শুনা?
চুপ থাকাটাই শ্রেয় প্রিয় বলবে জানি;
আচ্ছা ওগো মানছি তবে
সব কিছুতেই আমার গুনাহ।
এভাবেই কবি ফয়জুল্লাহ আমান এঁকেছেন প্রেম-বিরহ, সমাজ-জীবন, আনন্দ-বেদনা, বাস্তবতা ও বিশ্বাসের আল্পনা। অতলান্ত, স্মৃতির উঠোন, নিদ্রাহারা, হীরন্ময় নীরবতা, কুহক, মানুষ হ, ভালবাসা, একজন মা, নিদ্রাহারা, কি?, এই লাশের শহরে, আমার কেবল দুখ ছিল, বৃদ্ধাঙ্গুলি, পয়মন্ত বেলাসহ চল্লিশটি কাব্যের আসর আছে ‘চেহেল কাব্যে’।
গতানুগতিক কাব্যিকতার রেহালে কবিতা না সাজিয়ে ভিন্নধর্মী এক স্বাদ নিয়ে এসেছেন এ বইয়ে। সমৃদ্ধ একটি ভ‚মিকাও লিখেছেন কবি ও কবিতা সম্বন্ধে ইতিহাসের হাজার পৃষ্ঠা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। পেশায় তিনি একজন মুফতী, মুহাদ্দিস ও খতীব হওয়া সত্তে¡ও তার কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টির অনন্য নজীর আমাদের সমাজে অন্য আলো বিকিরণ করবে। দূর করবে কাব্যাঙ্গনে ভেসে আসা অযাচিত সব অপাঙ্কতেয়তাকে।
চৈতন্য প্রকাশ করেছে সময়ের সেরা এ কাব্য সঙ্কলন ‘চেহেল কাব্য’ তথা চল্লিশ কবিতা। শাকীর এহসানুল্লাহর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ আর চৈতন্যের সুন্দর বাঁধাই ও অফসেট পেপারে এ কাব্যগ্রন্থ ইতোমধ্যেই নজর কেড়েছে পাঠকের। কবিতা প্রেমীদের কবি ফয়জুল্লাহ আমানের এ কবিতার বারান্দায় স্বাগতম।
বই: চেহেল কাব্য। প্রচ্ছদ : শাকীর এহসানুল্লাহ
প্রকাশনা : চৈতন্য মুদ্রিত মূল্য : ১৫০
স্টল নং: ৬০৪-৬০৫ স্টল নং: ৫৬ (লিটল ম্যাগ চত্তর)
শহিদ মিনার চত্তর (সিলেট)
ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ