শাহনাজ শারমিন : ছোট্ট এই জীবনে সবাই সুখী হতে চাই। আর জীবনে সুখ যেন একটি অলীক বিষয়। অলীক বলার কারণ হল, সুখী সবাই হতে চায় কিন্তু বাস্তবে কয়জন সুখী মানুষ আমরা দেখতে পাই? তবে হ্যাঁ, সুখী মানুষও আছে। আর খারাপ-ভালো, সুখ-দুঃখ নিয়েই তো আমাদের জীবন। মানুষের জীবন এক চমৎকার উপভোগ্য উপকথা, যা সৃষ্টিকর্তা নিজে লিখেছেন।
প্রতিনিয়তই জীবন সংগ্রামের যেন শেষ নেই। মূলত জীবন হচ্ছে সাদা কাগজের পাতার মতো। যে যেভাবে লিখে জীবন তার কাছে দুঃখের সুখের কিংবা উপভোগের হয়ে ওঠে।
আমাদের পছন্দগুলো হচ্ছে, আমাদের নিজস্বতা। তাই নিজস্ব পছন্দে কারো কাছে ব্যাখ্যা নয় বরং আত্মবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে চলা উচিত। অন্ধকার আছে বলেই আমরা আলোর মূল্য বুঝি। প্রকৃতপক্ষে আলো-অন্ধকার একে অপরের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত। রাতে শেষে যেমন সূর্যের হাসির ঝলমলে দিন আসে, তেমনি দুখের কালো বাদল সরে গেলে আপনি ঠিকই পরিষ্কার আকাশের দেখা মেলে।
জীবনে চলার পথে যেমন বাধাঁ আসবে তেমন তার মোকাবেলাও করতে হবে। ধরুন আপনার চোখে আপনার দুনিয়া এক রকম। আবার অন্যদের চোখে আপনার মতো না, ভিন্ন। আপনার মতের সঙ্গে অন্যের মত নাও মিলতে পারে। আর এটাই স্বভাবিক। আমরা কম-বেশি সবাই জানি খুব বেশি আশা করা ঠিক না। যদি আশাহত হতে হয়! আর যখনই এর উল্টোটা হবে তখনই আসবে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয় অনেকে। যা একেবারেই ঠিক না।
তবে জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু বিষয় যা আপনি কারো কাছে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য না, তারপরও অনেকে করে ফেলে নানান প্রশ্ন।
ক্ষমা না চাওয়ার জন্য
আপনি যদি মন থেকে অনুতপ্ত বোধ না করেন তাহলে কাউকে স্যরি বলার কোনো মানে নেই। আপনি যদি লোক দেখানোর জন্য কাউকে অনুতপ্ত না হয়েও স্যরি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন, তাহলে আপনি নিজেকেই ধোকা দিচ্ছেন এবং মানুষও আপনার সম্পর্কে ভুল ধারণা পাবে। তাই মন থেকে অনুতপ্ত না হলে আপনি কারো কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য নন।
মতের মিল না হওয়ার জন্য
আপনার বন্ধুদের মধ্যে হয়তো এমন একজন আছে যে সবসময় ভাবে সে নিজেই সঠিক এবং চাওয়া হোক বা না হোক সব বিষয়েই সে তার নিজের মতামত জাহির করতে উদগ্রীব থাকে। তবে সবসময় তার মতের সঙ্গে একমত না হওয়ার অধিকার আপনার অবশ্যই আছে। যেকোনো বিষয়ে নিজের মতামত জানাতে কখনোই দ্বিধা বোধ করবেন না।
খোশগল্প করতে না চাওয়ার জন্য
আড্ডা বা খোশগল্প আমাদের জীবনের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। কিন্তু দেখা যায় বেশিরভাগ আড্ডায় প্রায়ই আমরা কাউকে না কাউকে নিয়ে তার অগোচরে, এটা-সেটা অনেক কথাই বলে থাকি। যদি কখনো এরকম কোনো আড্ডা চলতে দেখেন অথবা দাওয়াত পান তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই না করে দিন। কেননা অগোচরে যে মানুষটিকে হেয় করা হচ্ছে, এ ধরনের আড্ডা থেকে আপনার সম্মানেরও ক্ষতি হতে পারে। তাই এ ধরনের আড্ডা থেকে চলে আসতে দ্বিধা বোধ করবেন না।
বেশভূষার জন্য
নিজের যেটায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয় সেই পোশাকটাই পরুন। যেই মেকআপটায় ভালো লাগে সেটাই করুন। নিজের ওজন নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকুন। আপনি দেখতে কেমন সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত বিষয় আর যখনি আপনি এটা নিয়ে মানুষকে কোনো ব্যাখা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করবেন না, তখনই আপনি আপনার নিজের সম্পূর্ণ অনন্য এক অবয়ব নিয়ে গর্ব করতে পারবেন।
ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক আদর্শের জন্য
আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বেই ইদানীং ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতাদর্শের জন্য খুব অস্থিতিশীল এবং অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কিন্তু আপনি কোন আদর্শে চলবেন সেটা ঠিক করার অধিকার শুধুমাত্র আপনারই, কারণ এটা আপনার ব্যক্তিত্বের পরিচয়। তাই মনে রাখবেন, আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা ধর্মীয় বিশ্বাস এর জন্য আপনি কারো কাছে ব্যাখা দিতে বাধ্য নন।
আপনার ক্যারিয়ার নিয়ে
আপনি যদি আপনার স্বপ্নের চাকরি পেয়ে থাকেন, তাহলে ভালো। যদি পেয়ে না থাকেন তাহলে আপনাকে কোনো প্রফেশনে ঢোকার আগে সেটা নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা ভাবনা করতে হবে, সব কিছু ভেবে নিয়ে তারপর কোনো একটা প্রফেশনে ঢুকবেন। হতে পারে আপনি অনেক টাকা কামান না, কিন্তু নিজের কাজ নিয়ে আপনি খুশি।
অথবা আপনি আপনার কাজে বোর ফিল করেন কিন্তু স্যালারিতে আপনার পরিবার বেশ ভালো আছে। তবে ঘটনা যেটাই হোক অন্য কারো কথায় নিজের পেশা পরিবর্তন করবেন না। যদি নিজের ভেতর থেকে তাগিদ আসে তবেই তা করতে পারেন। এটা নিয়ে কাউকে জবাবদিহি করতে আপনি বাধ্য নন।
আর্থিক অবস্থার জন্য
হতে পারে আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স বেশ ভালো অথবা আপনি সঞ্চয় ছাড়াই দিনযাপন করছেন। কিন্তু এটা নিয়ে আপনাকে কেউ জেরা করার অধিকার রাখে না, আর আপনিও কাউকে এসব ব্যাপারে জানাতে বাধ্য নন। একজন মানুষের মূল্য তার অর্জিত টাকার চেয়ে অনেক বেশি। নিজের আর্থিক অবস্থা নিয়ে তাই কখনো হীনমন্যতায় ভুগবেন না।
দাম্পত্য জীবন নিয়ে
আপনার যৌন জীবন নিয়ে শুধুমাত্র ডাক্তার এবং থেরাপিস্টরাই আপনাকে সাজেশন দিতে পারে, অন্য কেউ এ ব্যাপারে কিছু বললে তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
সন্তানের বেড়ে ওঠা নিয়ে
দুটো ভিন্ন পরিবারের সন্তান কখনো একই ভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো মিল থাকে কিন্তু প্রত্যেক বাবা-মাই একেকটি ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন এবং তারা তাদের সন্তানদের নিজেদের মতো করেই বড় করে তোলেন। আপনার সন্তানকে কিভাবে বড় করছেন সে ব্যাপারে যে কারো কথায় চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। হতে পারে তারাই আপনাকে ভুল কোনো পরামর্শ দিয়ে প্রভাবিত করছে।
আপনার সম্পর্কের জন্য
আপনার সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ সব সময় নিজের হাতেই রাখুন। কোন সম্পর্ক আপনাকে সুখী করবে, কোথায় আপনি অসুখী তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার একান্তই আপনার। নতুন কাউকে ভালো লাগলে, তার সঙ্গে সম্পর্কটা কতদূর নিয়ে যাবেন তার সিদ্ধান্ত নিতে বন্ধুদের ওপর বা অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। কারণ, আপনি মানুষটাকে যা দেখে পছন্দ করেছেন তারা হয়তো সেটা নাও দেখতে পারে। তাই সম্পর্কের বেলায় অন্য কারো না, নিজের সিদ্ধান্তকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিন।
সম্পর্কের অভাবের জন্য
আপনি একজন স্বাধীন, স্বনির্ভর মানুষ যিনি কোনরকম সম্পর্কের বেড়াজাল ছাড়াই বেশ ভালো আছেন। হয়তো আপনি আপাতত একা থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন কিংবা মনের মতো কাউকে খুঁজেই পাননি এখনো। আপনি কেন একা, বয়স হয়ে যাচ্ছে- এসব প্রশ্ন হয়তো শুনতে হয় পরিবার বা বন্ধুদের কাছ থেকে। কিন্তু আপনি কিসে সুখী, কেন সম্পর্কে জড়াচ্ছেন না, এ সিদ্ধান্ত শুধুই আপনার এবং এসব ব্যাপারে কাউকে জবাব দেয়ার জন্য আপনি মোটেই বাধ্য নন।
কোনো বন্ধুত্বে ইতি টানার জন্য
কিছু বন্ধুত্বের শুরুটা হয় ভালো, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে যেতে পারে তিক্ত। আপনার যদি এমন কোনো বন্ধু থাকে যে আপনাকে সম্মান করে না, বন্ধুত্বকে মূল্য দেয় না অথবা তার সঙ্গে থাকলে যদি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে না পারেন, এখনই সময় সম্পর্কটা শেষ করার। অপরদিকে টিকবে না জেনেও কারো সঙ্গে কখনো বন্ধুত্ব করতে যাবেন না, লোকে যাই বলুক।
থাকার জায়গা নিয়ে
আমাদের মধ্যে কেউ শহুরে জীবন পছন্দ করে, কেউ আবার কোলাহল মুক্ত নির্মল সবুজ পরিবেশের স্বপ্ন দেখেন। আপনি শহর থেকে একটু দূরে বা মফস্বল অঞ্চলের দিকে থাকতেই পারেন। আপনার থাকার জায়গা, তার আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে মানুষের অমূলক কথাবার্তায় একেবারেই কান দিবেন না। আপনার পরিস্থিতি না বুঝে যারা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলবে, তাদের কথায় কান না দিলে আপনার খুব একটা ক্ষতি হবে না।
আপনার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে
লক্ষ্যগুলো হতে পারে আপনার জীবনের লক্ষ্য, অথবা ব্যক্তিগত লক্ষ্য, অথবা আপনার ‘বাকেট-লিস্ট’ অথবা এই সবগুলোই। এ লক্ষ্যগুলোই আপনার বেঁচে থাকার শক্তি যোগায় এবং স্বপ্নগুলো সত্যি করার জন্যই আপনি দিনরাত পরিশ্রম করে থাকেন। আপনার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে যাদের সমস্যা, তাদের হয়তো জীবনে কোনো লক্ষ্যই নেই। আপনার আর আপনার স্বপ্নগুলোর মাঝে কাউকেই আসতে দিবেন না।
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য
আপনার দৃষ্টিভঙ্গি দেখেই মানুষের উচিত আপনাকে বিচার করা, বিশেষ করে আপনার যদি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। যদি কখনো কাউকে দেখেন কোনো প্রজেক্ট নিয়ে, সহকর্মী নিয়ে, অথবা খাবারের মেন্যু নিয়ে শুধু অভিযোগই করছেন তাহলে ভুলেও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করবেন না। সবকিছু সহজভাবে দেখতে শিখুন এবং জীবনের প্রতি একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখুন। হয়তো আপনাকে দেখেই তারা তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করবেন।
আখিরাতে প্রতিটি মানুষকে তার জীবনের জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়। এ জবাবদিহিতা থেকে কেউই মুক্ত নয়। না পশু-পাখি, না মানুষ, না যেকোনো প্রাণী।