সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রবীণ আলেম ও জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার মুহাদ্দিস মুফতি হিফজুর রহমান-এর ২৩ খণ্ডের বিশাল গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘আল বুদুরুল মুযিয়্যাহ ফি তারাজিমিল হানাফিয়্যাহ’ নামক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে মিসরের বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশনী দারুস সালিহ। একজন বাঙালি আলেমের আরবি ভাষায় এতো বড় কিতাব প্রকাশের ঘটনা খুব বেশি চোখে পড়ে না।
তার উপর মিসর থেকে তা প্রকাশিত হওয়ায় বিষয়টি দৃষ্টি কেড়েছে দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত ও সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকদের।
সুবিশাল এ গ্রন্থের রচনার উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, সময়কালসহ নানা বিষয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলেছেন তার স্নেহভাজন ছাত্র আতাউর রহমান খসরু।
আওয়ার ইসলাম : এতো বড় কাজ করলেন। এ কাজের উদ্দেশ্য কি?
মুফতি হিফজুর রহমান : আমি যখন পাকিস্তানে ইফতা পড়ছিলাম। হজরত মাওলানা আবদুর রশিদ নোমানি রহ. এর অধীনে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করি। আমার শিক্ষক তখন আমাকে বলেন, ‘যদি তোমার সুযোগ হয় তুমি হানাফি মাজহাবের ‘রিজাল’ (স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব) উপর একটি বড় গ্রন্থ রচনা করবে।’ তার এ উপদেশকে আমি ওসিয়ত হিসেবে গ্রহণ করি। বিষয়টি আমার মনের ভেতর লালন করছিলাম। শিক্ষকের ওসিয়ত রক্ষার জন্য এ গ্রন্থ রচনা করি।
আওয়ার ইসলাম : আপনি হানাফি মাজহাবের কৃতী পুরুষদের জীবনী লিখেছেন। তাদের জীবনের কোন দিকটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন?
মুফতি হিফজুর রহমান : আমি হজরত আবু হানিফা রহ. থেকে শুরু করে বর্তমান শতাব্দীর হানাফি ফকিহদের জীবনী তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি, তাদের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্বের উপর। আমি ফিকহ ও হাদিস শাস্ত্রসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞানগত অবদান তুলে ধরতে চেয়েছি।
আওয়ার ইসলাম : অভিযোগ আছে আহনাফের ইমামগণ হাদিসশাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন নি এবং তাদের রচনাবলীও কম …
মুফতি হিফজুর রহমান : আমার এ বই পড়লে আশা করি, অভিযোগকারীদের অভিযোগ যে সত্য নয় তা বোঝা যাবে। আমি হাদিসশাস্ত্রে তাদের অবদান ফুটিয়ে তুলেছি এবং তাদের রচনাবলীরও দীর্ঘ তালিকা উল্লেখ করেছি।
আওয়ার ইসলাম : প্রত্যেক যুগ ও শতাব্দী থেকে আপনি রিজাল বা কৃতীপুরুষদের নির্বাচন করে আপনার কিতাবে স্থান দিয়েছেন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনার মাপকাঠি কি ছিলো?
মুফতি হিফজুর রহমান : প্রথম মাপকাঠি ছিলো রিজালশাস্ত্রের মনীষীগণ। অধিকাংশ মনীষী যাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং নিজ নিজ গ্রন্থে তাদের স্থান করে দিয়েছেন আমি তাদেরকে প্রাধান্য দিয়েছি।
আমার দ্বিতীয় মাপকাঠি হানাফি মাজহাবের রচনাবলী। এসব রচনাবলীতে যাদের অবদানের কথা জানা যায় তাদেরও আমি খুঁজে খুজে বের করেছি। অর্থাৎ এমন ইমাম যার মতামত হানাফি মাজহাবের বিভিন্ন কিতাবে এসেছে কিন্তু তার জীবনী অনেক জীবনী গ্রন্থেও নেই আমি তাদেরকেও উল্লেখ করেছি।
আওয়ার ইসলাম : ‘আল বুদুরুল মুযিয়্যাহ ফি তারাজিমিল হানাফিয়্যাহ’ গ্রন্থটি কিভাবে সাজানো হয়েছে?
মুফতি হিফজুর রহমান : লুগাতের অনুসৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হুরুফে ‘হিজা’ আরবি হরফের সাধারণ বিন্যাস অনুসারে সাজানো হয়েছে। তবে অনেকে জীবনকাল, অবদান, জন্মস্থান ইত্যাদির বিচারে বিন্যাস করেন।
আওয়ার ইসলাম : আপনাদের এ বইটি সংকলনধর্মী। এ বই সংকলনে আপনি সবচেয়ে উপকৃত হয়েছেন কোন কোন বই থেকে?
মুফতি হিফজুর রহমান : হানাফি মাজহাবের রিজালদের প্রতি আমার আগ্রহ ছিলো ছাত্রজীবন থেকেই। ছাত্রজীবন থেকেই আমি তা সংগ্রহ করতে শুরু করি। প্রধানত আমার সংগ্রহে থাকা হানাফি মাজহাবের রিজালদের উপর লেখা গ্রন্থাবলী থেকেই উপকৃত হয়েছি। এছাড়াও বাজারে পাওয়া যায় এমন রিজালশাস্ত্রের গ্রন্থাবলী থেকে আমি উপকৃত হয়েছি।
আর ভারতবর্ষের হানাফি আলেমদের জীবনী বাংলা, উর্দু ও ফারসি ভাষায় রচিত গ্রন্থাবলী থেকে গ্রহণ করেছি। অনেকের জীবনী পত্রিকা থেকে নিয়েছি। কারো জীবনী তার পরিবার কাছ থেকে উদ্ধার করেছি।
আওয়ার ইসলাম : আপনার মাতৃভাষা বাংলা। বাংলায় না লিখে আরবিতে কেনো লিখলেন?
মুফতি হিফজুর রহমান : আরবি ভাষাভাষী মানুষ মনে করে এদেশের মানুষ মিসকিন। এখানে জ্ঞানের কোনো চর্চা হয় না। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্ববরেণ্য অনেক আলেমের জন্মেছেন। শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা থেকে শুরু করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভি, কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব, মুফতি মুহাম্মদ শফী, আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ. এর মতো মনীষীদের জন্ম এ ভারতের মাটিতে।
আরবরা তাদের সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না। আরব ভাষাভাষী মানুষ যেনো উপমহাদেশের আলেমদের সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্যই বাংলা ভাষায় না লিখে আরবি ভাষায় লিখেছি।
এ ক্ষেত্রে শায়খ আবুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ও তার শিষ্য শায়খ আওয়ামার কথা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তারা বার বার দুঃখ করে বলেছেন, যদি আরবি ভাষায় ভারতীয় আলেমদের জীবনী লেখা থাকতো তবে আরবদের ধারণা পাল্টে যেতো। তারা বলেছিলেন, কারণ ভারতে তাদের যাতায়াত ছিলো।
বিখ্যাত একটি প্রবাদ হলো, ‘কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবে, পঠিত হয়েছে মিসরে আর বুঝেছে ভারতীয়রা।’ যারা বুঝলো কুরআন তাদের জীবনী ইসলামি বিশ্বের লোকেরা জানে না।
আওয়ার ইসলাম : বাংলা করার ইচ্ছে আছে কি?
মুফতি হিফজুর রহমান : বাংলা ভাষায় লিখতে তো ইচ্ছে করেই কিন্তু আমার জীবনের দীর্ঘ সময় কেটে গেছে আরবি রচনাটা প্রস্তুত করতেই। এখন সম্ভব হয়ে উঠবে কিনা জানি না। হয়তো পরবর্তীতে কোনো অনুজ এ বিশাল বইয়ের বাংলা করার সাহস করবে।
আওয়ার ইসলাম : এই বই নিয়ে আর কোনো কাজ করার ইচ্ছে আছে?
মুফতি হিফজুর রহমান : হ্যা, ইচ্ছে আছে শুধু তাই না। ২৩ খণ্ডের এ বই লেখার পর আমি দেখলাম যে এখনও অনেক মনীষী বাইরে থেকে গেছেন। তাই এ বইয়ের একটি তাকমিলা বা সংযুক্তি গ্রন্থ রচনা করছি। ৩-৪ খণ্ড হয়ে আছে। আরও কয়েক বছর পর হয়তো তা প্রকাশ পাবে।
আওয়ার ইসলাম : কতো বছর সময় প্রয়োজন হলো?
মুফতি হিফজুর রহমান : সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে ছাত্র জীবন থেকে। তবে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছি প্রায় ১০ বছর। এ ১০ বছরে আমার আরবি বা বাংলা অন্য কোনো বই প্রকাশ পায় নি।
আওয়ার ইসলাম : এই বিশাল কর্মযজ্ঞে আপনাকে অনুপ্রেরণা ও সাহস দিয়েছেন কারা?
মুফতি হিফজুর রহমান : এ কাজের সময় আমি বড় বড় আলেমদের পরামর্শ নিয়েছি। তারা সবাই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। বিশেষত আমার শায়খ মালিক আবদুল হাফিজ মক্কি রহ. –যিনি শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ. এর খলিফা ছিলেন- বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। কাজ শুরু করেছিলাম তার দোয়া নিয়ে। কাজ শুরু হওয়ার পর যতোবার তিনি এসেছেন আমি তাকে কাজের অবস্থা জানিয়েছি এবং তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন।
বইটি প্রকাশের পর হজরত আবদুল হাফিজ মক্কি রহ. এর কাছে প্রথম পাঠিয়েছি। তিনি খুব খুশি হন এবং আশপাশের বড় বড় আলেমদের তা দেখান। তারাও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এর দশদিন পর হজরতের ইন্তেকাল হয়।
আওয়ার ইসলাম : প্রকাশের পর কেউ অভিনন্দন জানিয়েছেন?
মুফতি হিফজুর রহমান : হ্যা, আমার শায়খের কথা তো বললামই। হাটহাজারীর হজরত আল্লামা আহমদ শফীর নিকট পাঠালে তিনি আশ-পাশের লোকদের দেখে খুশি প্রকাশ করেন। তার জীবনীও এখানে রয়েছে।
শায়খ আওয়ামা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মুফতি তকি উসমানির নিকট একটি খণ্ড পাঠিয়েছি। যাতে তার জীবনী রয়েছে। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এবং পুরো সেট সংগ্রহ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন।
মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরীও আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সাক্ষাৎ হলে তিনি খুশি হয়ে বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি একজন যুবক। আপনি দেখি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।
আওয়ার ইসলাম : মিসর থেকে প্রকাশের পর অনেকেই ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করছেন। আপনার অনুভূতি কি?
মুফতি হিফজুর রহমান : আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমার মতো সামান্য লোকের একটি কিতাবের গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছেন। আরব বিশ্বে সমাদৃত হওয়ায় আমি অত্যন্ত খুশি।
আমার মনে হয়, যেসব মনীষী জীবনী এখানে স্থান পেয়েছে তাদেরই কারামাত যে এ বইটি আরবে ও আজমের বড় বড় ব্যক্তিরা পছন্দ করছেন। মূল্যায়ন করছেন।
আওয়ার ইসলাম : আমাদের মূল্যায়নে এটি আপনার জীবনের সেরা কাজ। আপনার মূল্যায়ন কি?
মুফতি হিফজুর রহমান : সেরা কাজ হওয়া না হওয়া নির্ভর করে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া ও না পাওয়ার উপর। আল্লাহ জানেন আমার কোন খেদমত তিনি কবুল করবেন। এর আগে আরবিতে ১৪টা কিতাব রচনা করেছি। তবে আয়তনে এটা যে সবচেয়ে বড় কাজ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।