সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দুই মামলা রায়ের পর্যায়ে চলে এসেছে।
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৬ জনের রায়ের ঘোষণার দিন ধার্য করেছে আদালত। এতে করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। রায়ের আগে ও পরে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা অজানা থাকলেও এর ভয়াবহতা নিয়ে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে।
বলা যায়, বিএনপির চোখ আদালতের দিকে। রায় খালেদা জিয়ার পক্ষে গেলে নির্বাচন করার যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না। তবে বিরুদ্ধে গেলে আগামী নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারাবেন কি না, এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কেননা, আইন অনুযায়ী দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার দুই বছরের বেশি সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ হারাবেন।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কোন মামলায় যদি কারো দুই বছরের বেশি শাস্তি হয় তাহলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। আমাদের আইন তাই বলে।’
সুনির্দিষ্টভাবে খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একইভাবে উনার যদি দুই বছরের বেশি শাস্তি হয় তাহলে সামনের নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারবেন না।’
উচ্চ আদালতে আপিল করা হলেও কি অযোগ্য থাকবেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আদালত কী বলে সেটার উপর নির্ভর করবে। আমি মনে করি যদি এই মামলায় তার শাস্তি হয় তাহলে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।’
এদিকে বিদেশে অর্থপাচারের এক মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ কোটি টাকা জরিমানার আদেশ এসেছে আপিল বিভাগ থেকে। ফলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে গেছেন। এখন খালেদা জিয়ারও যদি একই পরিণতি হয়, তাহলে বিএনপির জন্য বিষয়টি সুখকর হবে না।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণার তারিখ এত দ্রুত পড়বে, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না বিএনপি। দলটির ধারণা ছিল, মামলার বিচারকাজ আরও এক-দেড় মাস গড়াবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে আগাম চাপে ফেলা এবং দলে বিভক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে এই মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা হয়েছে। কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছিল, রায় ঘোষণার পর বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে সরকার আগাম নির্বাচনে যেতে পারে। যাতে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়া, না যাওয়া নিয়ে বিএনপি দোটানায় পড়ে। প্রার্থিতা নিয়েও দলে বিভক্তি হয়। এই সুযোগে নতুন করে বিএনপি ভাঙার চেষ্টা শুরু করা।
এক্ষেত্রে বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে এবার দলের গঠনতন্ত্রের ধারা ৭ এর ‘ঘ’ সামনে আনা হতে পারে। ওই ধারায় কোনো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির কোনো পর্যায়ের কমিটির সদস্য পদ বা সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার কথা আছে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা : প্রস্তুতি, প্রত্যাশা, প্রস্তাবনা
বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্য পদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’
তাঁরা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮ এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।
আবার এমনও হতে পারে- বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলার রায়-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের দুই চিন্তা ও পরিকল্পনা রয়েছে।
খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের সাজা হলে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি আন্দোলনে নামলে কঠোর হাতে তা দমন করা হবে। আর চুপচাপ থাকলে জিয়া পরিবারকে ‘দুর্নীতিবাজ’ তকমা দিয়ে সারা দেশে প্রচারণা চালানো হবে। এ জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- খালেদা জিয়ার সাজা হলে দেশে আগুন জ্বলবে। আর আওয়ামী লীগ বলছে, দেশে সন্ত্রাসের কার্যকলাপ করা হলে জনগণকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
বিএনপি নেতারা জোর গলায় বলছেন, সরকার প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে এ মামলা রায় তড়িত করেছে। তারা এমনটিও বলছেন, সরকারের হস্তক্ষেপ না হলে এ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও বলছেন, এ মামলায় তিনি সম্পূর্ণভাবে খালাস পাবেন। কেননা, দুদক যেসব যুক্তি ও তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেছে সেসবের কোনো ভিত্তি নেই।
এদিকে, খালেদা জিয়ার রায় নিয়ে আদালতের কর্মকাণ্ডে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই বলে জানিয়েছেন সরকার পক্ষের নেতারা। খালেদা জিয়ার সাজা হলেও তাদের কিছুই করার নেই। এক্ষেত্রে রাজনীতির প্রতিহিংসার কোনো যোগসূত্র নেই।
তবে এমনটিও শোনা যাচ্ছে, রায়ের নেতিবাচক দিক ধরে নিয়েই সারা দেশে নেতা-কর্মীদের কাছে ‘বিশেষ বার্তা’ পাঠানো হয়েছে। বিএনপির হাইকমান্ড থেকে এ বার্তা পাঠানো হয়। তা ছাড়া সিনিয়র নেতাদের জেলা সফরেও এ বিষয়ে নেতা-কর্মীদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
রায়ে নেতিবাচক কিছু হলে তৎক্ষণাৎ বিক্ষোভ মিছিল করার কথা বলা হয়েছে। এরপর কেন্দ্র থেকে ঘোষিত যে কোনো কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এ বার্তা জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে।
বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, রায়ের দিন ধার্য করার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এবং ছাত্রলীগের সাথে আ.লীগের বৈঠক করাকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর এ রায়কে ঘিরেই ফের রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। নেতাদের বক্তব্যে তেমনটাই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কক্সবাজারের চকরিয়ায় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছিলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হবে।
এছাড়া ২১ জানুয়ারি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায় আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে হবে। রায়ে তিনি সাজাও পেতে পারেন আবার বেকসুর খালাসও পেতে পারেন।
তবে আমার ধারণা তার সাজা হবে। খালেদা জিয়ার সাজা হলে একদিনের জন্য হলেও তাকে জেলে যেতে হবে। সাজার পরে বেগম খালেদা জিয়া যদি উচ্চ আদালত আপিল করেন আর হাইকোর্ট যদি বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাহলে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন।
তাদের এমন বক্তব্য নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, তারা যেসব তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন তাতে খালেদা জিয়ার সাজা হবে।
খালেদা জিয়া নিজেও প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গার এ বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ২১ জানুয়ারি এক টুইট বার্তায় খালেদা জিয়া বলেন, শুক্রবার, জানুয়ারি ১৯, পত্রিকায় এসেছে, বিনাভোটের এক প্রতিমন্ত্রী বলেছে, ১৫ দিনের মধ্যে খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে। বিচারাধীন মামলার রায় ঘোষণা আদালত অবমাননা নয়-কি? বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় মাননীয় প্রধানবিচারপতি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, জনগণ সেইদিকে সতর্ক নজর রাখছে।
শুধু কি তা-ই! জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ‘খালেদা জিয়া জেলে যাবেন’ কারো সন্দেহ আছে মনে? ওনাকে জেলে যেতে হবে।
২৩ জানুয়ারি লালমনিরহাট শহরের পূর্বসাপটানায় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের বাসার সামনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি।
যতদূর জানা গেছে, রায়ে বেগম জিয়ার সাজা দেওয়া হতে পারে- এমন আশঙ্কায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপিতে। সাজা হলে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথের সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলের নেতা-কর্মীরা। রাজপথে তাৎক্ষণিক বড় মাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখানোর পাশাপাশি স্বেচ্ছায় কারাবরণ, হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে দলটির মধ্যে চলছে আলোচনা।
সাংগঠনিক, নির্বাচনী প্রস্তুতিসহ যাবতীয় কার্যক্রম আপতত বন্ধ রেখে এখন আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে দলটির ভিতরে। এ নিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ে যেটা আমরা আশঙ্কা করছি, নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে যদি আদালত থেকে প্রকাশ পায়, তাহলে ওইদিন বর্তমান সরকারের পতনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। এ মামলার রায়ে বেগম জিয়ার কিছুই হবে না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠছে, এ মামলাটি স্বাভাবিক গতিতে চলছে কি না? আমি এখনো আশাবাদী, ন্যায়বিচার পাবেন আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কোনো কারণে সাজা দেওয়া হলে বুঝতে হবে, স্বাভাবিক আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে আমরা উচ্চ আদালতে জামিন চাইব। আশা করি, জামিন পাব। সে ক্ষেত্রে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে কোনো সমস্যা হবে না।’
এদিকে, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায়কে ঘিরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে আগের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা চলবে না। তারা জনগণের বন্ধু, তারা পেশাদার পুলিশ। কাজেই বিশৃঙ্খলা কিংবা ধ্বংসাত্মক কিছু ঘটলে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।
আশা করি, খালেদা জিয়ার প্রতি আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচার করা হবে। আমরা চাই না- কোনো ইস্যুতে দেশে কোনো প্রকার নৈরাজ্য সৃষ্টি হোক। আমরা অব্যাহত শান্তিতে বসবাস করতে চাই।
সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন : কবি, কলাম লেখক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম