সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
অমর একুশে গ্রন্থমেলার সময় গণনা শুরু হয়ে গেছে। হাতে আছে আর চারটি দিন। ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমির ও উদ্যানের গায়ে বইমেলার গন্ধ লেগে গেছে। চলছে স্টল, প্যাভিলিয়ন, মঞ্চ তৈরির কাজ। মেলার আমেজ লেগেছে নগরীর বাংলাবাজারসহ রাজধানীর নানা জায়গায়।
আকারে-প্রকারে এবার মেলার বড় হচ্ছে পরিসর। সব মিলে সাড়ে পাঁচ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বসবে একুশে গ্রন্থমেলা। হবে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন, সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন। প্রতিদিন থাকবে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। জমবে লেখক-পাঠকের আড্ডা।
প্রতিবার মেলার উদ্বোধনের দিন থেকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন শুরু হলেও এবার এ সম্মেলন শুরু হবে ২২ ফেব্রুয়ারি। তিন দিনের এ সম্মেলন চলবে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
শুনে ভালো লাগছে, প্রথমবারের মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলায় লেখক, সাহিত্যিক, কবি, বিভিন্ন অঙ্গনের সিনিয়র ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবীসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রবেশের জন্য আলাদা একটি গেট স্থাপন করা হচ্ছে। যে গেইট দিয়ে শুধুমাত্র লেখকদেরই প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।
আরও ভালো লাগল, মেলায় লেখক ও প্রকাশকদের বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। তবে এই তালিকায় পাঠকদেরও যুক্ত করা সময়ের দাবি।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সব মিলিয়ে এবার ৪৬০টি প্রকাশনা সংস্থা মেলায় অংশ নিচ্ছে। যার মধ্যে এবারই প্রথমবারের মতো মেলায় অংশ নেবে অনেকগুলো প্রকাশনা সংস্থা। তবে এ হিসাব বাড়তে বা কমতে পারে।
প্রতি বছরই দেখতে পাই, লেখকদের জন্য কিছু আড্ডার জায়গা থাকলেও তারা সেখানে বসেন না। জায়গাগুলো দখল করে থাকে মিডিয়ার লোকজন এবং মেলায় আসা পাঠক-দর্শনার্থী। আড্ডাস্থলগুলোতে লেখকরা নিয়মিত বসে পাঠকদের সঙ্গে তাদের লেখালেখি সম্পর্কে কথা বললে মেলার পরিবেশ আন্তরিক ও উপভোগ্য হবে।
পানি-বিদ্যুত, হাঁটাপথ, পর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থা, প্যাভিলিয়ন, খাবারদাবার, আড্ডাস্থল সব কিছুর সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ধুলা থেকে বাঁচার সুবন্দোবস্ত থাকা চাই। পাশাপাশি মেলায় পাঠকদের জন্য পাঠাগার তৈরিতে মেলা কর্তৃপক্ষের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কারণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বই সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই পাঠকদের জন্য মেলায় একটি নির্ধারিত পাঠাগার থাকা প্রয়োজন।
বইমেলার কাছাকাছি সময়ে অনেক ধরনের মেলা ও উৎসব হয়। ডিসেম্বরে হয় সংগীত উৎসব, জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলা ও চলচ্চিত্র উৎসব আর ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা। সংগীত উৎসব খোলা থাকে ভোর পর্যন্ত, আর বাণিজ্যমেলা খোলা থাকে রাত দশটা পর্যন্ত। কিন্তু বইমেলায় রাত আটটা বাজতে না বাজতেই বইপত্র গুছিয়ে স্টল বন্ধ করার আয়োজন শুরু করেন বিক্রেতারা। ঢাকা শহরে চাকরিজীবী মাত্রই জানেন অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা সাতটা, আর যানজট ঠেলে মেলায় পৌঁছতে রাত আটটা। ততক্ষণে মেলা শেষ।
আর যদি কোনোভাবে আধঘণ্টা আগে পৌঁছান তো বই দেখে, পাতা উল্টে একটু চা খেয়ে, আয়েশ করে মেলা ঘুরে বই কেনার কোনো সুযোগ নেই। ওই পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যেই হুড়োহুড়ি করে দুই একটা স্টল দেখেই বই কিনে ফেলতে হয়। তাই বলছি, বাণিজ্যমেলা যদি রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকতে পারে, সেখানে বইমেলা থেকেও বেশি মানুষ যায়, তা হলে বইমেলা কেন রাত দশটা পর্যন্ত নয়?
মেলাটা যেন পণ্যের হাটের মতো হয়ে না যায় কর্তৃপক্ষকে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। মেলা যেন মেলা রূপে থাকে এটাই প্রত্যাশা। মেলায় কিছু এনজিও সংস্থা ও কর্পোরেট হাউসগুলোর যেন কোনোভাবে প্রভাব না পড়ে সেদিকে কর্তৃপক্ষকে সচেতন থাকতে হবে। গ্রন্থমেলার মতো জায়গায় আমরা টিস্যু পেপারসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি করতে দেখি, যেটা খুবই হতাশ ও দুঃখজনক ঘটনা।
গ্রন্থমেলায় যাই তারুণ্যের প্রাণপ্রবাহ খুঁজতে। নিজেদের তারুণ্য আবিষ্কার করতে। এক সময় ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে কত শত লিটল ম্যাগাজিন সঙ্কলন প্রকাশিত হতো! এখন যেন...। বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, পুরো মেলাটা একটা নির্দিষ্ট স্থানে হলে ভালো হতো। মূল স্টল ও লিটল ম্যাগাজিন চত্বর একত্রে হলে মেলার সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি।
সবশেষে বলি, মৌসুমি প্রকাশকদের ভিড়ে প্রকৃত প্রকাশকরা যাতে চাপা পড়ে না যায় এবং মেধাবী ও নতুন লেখকরা যেন তাদের বই প্রকাশের সুযোগ পায় এমনটাই প্রত্যাশা করছি।
তবে বলতেই হচ্ছে, বর্তমানে এত বই বের হচ্ছে যার মধ্যে ৫০টি বই পাঠযোগ্য হলেও বাকিগুলো অপাঠ্য বইয়ের তালিকায় চলে যায়। বাংলা একাডেমি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের কিছু নীতিমালা বা নিয়মনীতি তৈরি করা উচিত, যাতে করে প্রকাশক ও লেখকরা অপাঠযোগ্য বই প্রকাশ করতে না পারেন।
প্রতিবছর ইসলামি প্রকাশকদের একটা আক্ষেপ আমরা শুনি, মেলায় তাদের স্থান দেয়া হয় না। তারা যদি সৃষ্টিশীল বই প্রকাশ করে থাকে এবং মেলার শর্ত পূরণ করতে পারে তাহলে তাদেরও অংশগ্রহণের সমান সুযোগ দেয়া উচিত বলেই মনে করি। কারণ এই বইমেলাটা সবার।
বইয়ের লেখার মান যাচাই করে বই প্রকাশ করলে বই-নামক আবর্জনার নিচে প্রকৃত ও ভালো বই চাপা পড়বে না। পাশাপাশি সমাজে বেশি বেশি পাঠক তৈরি হবে ও প্রকাশকরা ভালো মানের সম্পাদিত বই পাঠকদের উপহার দিবেন এটাই প্রত্যাশা।
সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন : কবি, কলাম লেখক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম