মুহাম্মদ এহসানুল হক
আলেম ও লেখক
পৃথিবীজুড়ে ঈমান নিয়ে মেহনত করা মানুষের অন্যতম মিলনকেন্দ্রে পরিণত বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের বিশ্বইজতেমা। ইজতেমাই এখন সবচেয়ে বড় মাধ্যম যেখানে এক কাতারে এসে দাঁড়ায় গোটা বাংলাদেশ। প্রতিবছর ইজতেমা কেন্দ্র করে জেগে উঠে তুরাগের তীর, আছড়ে পড়ে এক আল্লাহতে বিশ্বাসীদের ঢেউ। ইল্লাল্লাহ জিকিরে রব ওঠে ঢাকার ইথারে-পাথারে। নীরবে বয়ে চলা তুরাগের তীর ভারি হয়ে ওঠে আল্লাহওয়ালাদের পদভারে।
১৯৪৬ সন থেকে বাংলাদেশে বিশ্বইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এমন ক্ষুদ্র একটি মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে এত বড় একটি মহাসম্মেলন করার সুযোগ পাওয়া এবং সফলভাবে আঞ্জাম দিতে পারাটা সহজ কথা নয়। এটা আমাদের জন্য বিরাট অর্জন।
এ অজর্ন একদিনে হয়নি। এমনি এমনিই হয়। এর পেছনে আছে হাজরও লক্ষ মানুষের মেহনত ও কুরবানি। তাবলিগের এই মহান কাজ কাকরাইলকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হলেও এর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। দীনের প্রতিটি মারকাজ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতায় দিন দিন এগিয়ে গেছে তাবলিগের এই সুমহান কাজ।
আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানিতে আজ তা এ পযর্ন্ত এসেছে। এক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উলামায়ে কেরাম সরাসরি এই কাজের নেতৃত্বে না থাকলেও নেপথ্যে থেকে এই কাজে সহযোগিতা করেছেন। তারা বয়ানে মানুষকে তাবলিগের কাজে শরিক হওয়ার আহবান করেছেন। কোথাও তাবলিগের কাজ বাধাগ্রস্থ হলে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে গেছেন।
সারা দেশের মাদরাসাগুলো থেকে সারা বছর কমবেশি সময় দিতে ছাত্র পাঠিয়েছেন। কখনও নিজেরাও শরিক হয়েছেন। বিশ্ব ইজতেমায় প্রায় লক্ষাধিক ছাত্র-শিক্ষক প্রতিবছর অংশ নিচ্ছেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ হজরত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমায় শরিক হতেন। একেবারে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি যেতেন। হুইল চেয়ারে করে বহুবার আমরা নিয়ে গেছি।
তিনি মনে করতেন, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এতগুলো মানুষ যেখানে সমবেত, সেখানে আল্লাহর অবারিত রহমত বিরাজমান রয়েছে। লক্ষ মানুষের মাঝে নিশ্চয় আছে আল্লাহর অনেক প্রিয় বান্দা। তাদের সাথে অবস্থান করা। বিশাল জুমার নামাজে শরিক হওয়া। আখেরি মুনাজাতে অংশগ্রহণ করা। প্রতিটি ব্যাপারকেই তিনি সৌভাগ্যের মনে করতেন।
তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বিরাও অত্যন্ত আগ্রহের সাথে প্রতিবছর রাহমানিয়ায় এসে দাওয়াত করতেন। মাওলানা জুবায়ের, মাওলানা ওমর ফারুক, মাওলানা মুজাম্মেলসহ অনেকেই বেশ কয়েকবার এসেছেন দাওয়াত দিতে।
শায়খুল হাদিস রহ. বেশ কয়েকদিন আগ থেকেই ইজতেমার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। এরপর ইজতেমা শুরু হলে শুক্রবার ভোরে আমাদের সবাইকে নিয়ে রওনা হতেন। সঙ্গে অধিকাংশ সময় থাকতেন বড়দের মধ্যে মাওলানা মাহবুবু হক।
আর ছোটদের মধ্যে আমি, মামাতো ভাই নাঈমুল হক, কখনো ছোট মামা মাসরুর। আর খাদেমদের মধ্যে মাওলানা আব্দুর রহমান, গাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ ও মুজাম্মেল ভাই। তাদের মধ্যে মুজাম্মেল ভাই বেশি থাকতেন।
ময়দানে তিনি জুমার নামাজে শরিক হতেন। ইজতেমা ময়দানে দুই দিন অবস্থান করে আখেরি মুনাজাত শেষ করে বাসায় ফিরতেন। তিনি অবস্থান করতেন উলামাদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত উলামা টেন্ডে।
অনেকেই হয়তো জানেন, দেশের শীর্ষস্থানী আলেমদের জন্য সবসময় একটি বিশেষ কামরা করা হয়ে থাকে। শায়খুল হাদিস রহ. এর সাথে বেশ ক’বছর আমার সেই খাস কামরায় থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই বিশেষ কামরাতেও আবার আলাদা করে চারটি রুম করা হতো।
আল্লামা আজিজুল হক রহ., আল্লামা আহমদ শফী, মুফতি আব্দুর রহমান রহ. ও ভারতের মাওলানা হাবিবুর রহমান খায়রাবাদি এই চারজনের জন্য চারটি। ইজতেমার তিনদিন প্রায় দেড়শত আলেম সেখানে অবস্থান করেন। এ চারজন ছাড়াও আরও যাদের নিয়মিত দেখতাম তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি শাইখুল হাদীস আল্লামা আশরাফ আলী, ঢালকানগরের পীর মাওলানা আব্দুল মতিন, মুফতি আব্দুল মালেক, মোমেনশাহীর মাওলানা আব্দুল হক। চট্টগ্রাম থেকে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা জসিমুদ্দীন, মাওলানা কেফায়াতুল্লাহসহ আরও অনেককে।
এক শামিয়ানার নিচে দেশের শীর্ষস্থানীয় এতবড় জামাতকে দেখার সুযোগ আমার মনে হয় আর কোথাও হয় না।
ইজতেমা কর্তৃপক্ষ দেশের এই শীর্ষস্থানীয় আলেমদের যথাযোগ্য সম্মানের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। তাবলিগ জামাতের পক্ষ থেকেই এই তিনদিন উলামা টেন্ডে অবস্থানরত সকলের জন্য উত্তম মেহমানদারির ব্যবস্থা করা হয়।
শায়খুল হাদিস রহ. এর খেদমতে প্রতিবছর একজনকেই দেখতাম। তিনি কাকরাইল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা নুরুর রহমান। তিনি অত্যন্ত মুহব্বতের সাথে শায়েখের খেদমত করতেন। সারাদিনই লেগে থাকতেন হুজুর কী খাবেন, হুজুর কী লাগবে, শায়েখও তাকে খুব মুহব্বত করতেন।
উলামা টেন্ডের সবধরনের ব্যবস্থাপনাও ছিল উন্নত। সুযোগ সুবিধার কোনো কমতি ছিল না। রুমের সাথেই এটাচ বাথরুম। শীতের যেন কষ্ট না হয় সে জন্য গরম পানির ব্যবস্থা। খানাদানা এই পরিমাণ দেয়া হত যে, কয়েকজন খাওয়ার পরেও রয়ে যেত। তাদের এই আন্তরিকতায় শায়েখ খুব খুশি হতেন। সম্পূর্ণ সময়টা তিনি নিজ কামরাতেই কাটাতেন। ইবাদত বন্দেগি করতেন।
এখানে বসেই বয়ান শুনতেন। দেশের দূর দূরান্ত থেকে আগত আলেম উলামাগণ এসে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ করতেন। দোয়া নিতেন। তাদের সাথে কুশল বিনিময় হত। আমরাও সুযোগ পেতাম অন্য বড় আলেমদের কাছে যাওয়ার।
শুধু ইজতেমাই নয়, শায়খুল হাদিস রহ. তাবলিগের এই মেহনতকে দীন ইসলামের পক্ষে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ মনে করতেন। তিনি নিজেও কয়েকবার তিনদিনের জামাতে গিয়েছেন। একবার গিয়েছিলেন গেণ্ডারিয়া জামে মসজিদে। এই খবরে সারা ঢাকায় বেশ সাড়া পড়েছিল। শায়েখের সাথে দেখা করতে এবং বয়ান শুনতে কাকরাইলের অনেক মুরব্বিরাও সেখানে হাজির হয়েছিলেন।
মাহবুব মামার কাছে শুনেছি, তাবলিগের কাজের গুরুত্বের ওপর অত্যন্ত সারগর্ভ আলোচনা করেছিলেন শায়খুল হাদিস রহ.।
তাবলিগের এই মেহনতকে তিনি জেনারেল শিক্ষিত মানুষের জন্য বিশেষ উপকারী মনে করতেন।
একবারের কথা মনে পড়ে। এমনি এক বিশ্ব ইজতেমার কথা। শায়খুল হাদিস রহ. এর সাথে আমি তখন ওলামা টেন্ডে। কোনো এক কাজে আমি একটু বেরিয়েছি। তখন কজন ছাত্র শায়খুল হাদিসে রহ. এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো।
তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কে কী করে! তারা বললো, দাওরা শেষ করে এক বছরের জন্য তাবলিগে বের হয়েছে। তাদের কথা শুনে মনে হলো তিনি খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না।
তিনি বললেন, তোমাদের এখন উচিৎ ছিল কুরআন হাদিসের খেদমতে লেগে যাওয়া। আরও কিছু কথা বলছিলেন, ঠিক এমন সময় আমি সেখানে উপস্থিত হলাম।
আমি হাজির হতেই আমাকে দেখিয়ে বললেন, দেখ ওর বাবা একজন ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ, ঢাকা কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল। ওরে আমি যখনই জিজ্ঞেস করি তোর আব্বা কোথায়, ও বলে তাবলিগে। তাবলিগে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করা দরকার তাদের মতো মানুষদের। আর ছাত্রত্ব শেষ করার পরপরই খেদমতটা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি সব সময় বলতেন, দাওরা শেষ করার পর যে যেটা শুরু করবে, সেটা করেই তার জীবন কাটবে। কেউ যদি শুরুতে খেদমতে না লাগে, খুব বেশি দেরি করে ফেলে তাহলে তার জন্য পরবর্তী সময়ে খেদমতে শরিক হওয়া কঠিন।
আখেরি মুনাজাতের আগেই আমরা ওলামা টেন্ড থেকে বিদায় নিতাম। শায়খুল হাদিস রহ. স্টেজের পাশে গিয়ে দোয়ায় শরিক হতেন। চারদলীয় জোট সরকার তখন ক্ষমতায়। সেখানে অনেক এমপি মন্ত্রীও থাকতো। জোটের শীর্ষনেতা হিসেবে শায়খুল হাদিসের গাড়িও অন্য মন্ত্রীদের গাড়িবহরের সাথে পুলিশ প্রটেকশনে বেরিয়ে যেত। জ্যাম আর আমাদের নাগাল পেতো না। আমরা খুব দ্রুতই ঘরে ফিরতে পারতাম। পরবর্তী জ্যাম এড়াতে এর চেয়ে কোনো ভালো বিকল্প আমাদের কাছে ছিল না।
একদিনের ঘটনা মনে পড়ে। দোয়ার আগ মুহূর্তে আমরা শায়খুল হাদিস রহ. কে নিয়ে স্টেজের কাছে গেছি। স্টেজের বাম পাশে তখন ছিল আরবদের অবস্থান। সেখানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজুদ্দিন আহমদও বসা ছিলেন। শায়খুল হাদিস রহ. কে হুইল চেয়ারে যেই আমরা নিয়ে গেছি, এর মধ্যে কয়েকজন আরব মজমা থেকে উঠে আসলেন। আমার এখনো চোখে ভাসে এক আবর শায়েখকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমু খেলেন। পুরো মজলিস হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
শায়খুল হাদিস রহ. যতদিন সুস্থ ছিলেন ইজতেমায় শরিক হতেন। বিশেষ কারণ ছাড়া কখনোই বাদ দেননি। শেষ জীবনে তিনি যখন বিছানায়, তখন আর যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু তখনো ওলামা টেন্ডে শায়খুল হাদিসের জন্য নির্ধারিত কামরা তৈরি হত। কাকরাইলের মুরব্বিদের সিদ্ধান্ত ছিল হুজুর যতদিন হায়াতে আছেন ততদিন হুজুরের জন্য বরকত স্বরূপ আমরা কামরা তৈরি করবো।
আমরা দোয়া করবো হুজুর যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং আমাদের ইজতেমায় শরিক হতে পারেন। দু’বছর এভাবে গেল। এরপর তো তিনি বিদায় নিলেন ইহজগত থেকে।
এখনো প্রতি বছরের মতো ইজতেমায় শরিক হই। লক্ষ লক্ষ মানুষের জুমার কাতারে শামিল হই। কোটি মানুষের সাথে হাত তুলি আখেরি মুনাজাতে। এখনও তো সব কিছু আগের মতোই আছে। কিন্তু তারপরও অনুভব করি শূন্যতা। ইজতেমা এলেই এই শূন্যতাটা নতুন করে অনুভব করতে হয়।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, মাসিক রাহমানী পয়গাম