জহির উদ্দিন বাবর
অতিথি লেখক
দিন-তারিখ গণনার রীতিটা অনেক আগের। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই এগুলো আবিষ্কার করেছে। সৌরবছর হচ্ছে গণনাভিত্তিক এই রীতির সবচেয়ে পুরোনো ধারা। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর একবার ঘুরতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন বা এক বছর।
হজরত ঈসা আ.-এর জন্ম থেকে এই সাল গণনা শুরু হয়েছে। তাঁর ধর্মের অনুসারীরা বছরের শুরুর দিনটিকে উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে আসছে। দিন দিন এই উৎসবে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। ধর্মীয় বিধানে যেমন বিকৃতি এসেছে তেমনি এই দিনটি পালনেও যুক্ত হয়েছে নতুন সংস্কৃতি।
থার্টিফার্স্ট নাইট বা বছরের প্রথম রাতটিতে বিশ্বব্যাপী নানা উৎসব পালন করা হয়। এই রাতে উৎসবের আবরণে কত যে অপরাধ সংঘটিত হয় এর কোনো হিসাব নেই।
ঈসায়ি সনটি মূলত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃতির একটি অংশ। এর সঙ্গে তাদের ধর্মীয় আবেগ ও ভাবধারা গভীরভাবে জড়িত। ইসলাম তাদের ধর্মীয় সেই চেতনাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করে না।
এই সাল গণনা করা মুসলমানদের জন্য মন্দ কিছুও নয়। তবে এই সংস্কৃতির পেছনে ছুটে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেয়া কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। মুসলমানদের নিজেদের সাল হচ্ছে চন্দ্রবর্ষ বা হিজরি। বাংলা সনের সঙ্গেও মুসলমানদের যথেষ্ট যোগসূত্রতা রয়েছে। এই দুটি সালকে এড়িয়ে অন্য কোনো সংস্কৃতির দ্বারস্থ হওয়া উচিত নয়।
বর্তমানে আমরা নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত সালকে ভুলে গিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছি। থার্টিফার্স্ট নাইটের উৎসবে মেতে উঠছে মুসলিম তরুণ ও যুবসমাজ। ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত থাকলে কোনো মুসলমান এই ধরনের সংস্কৃতির প্রতি লালায়িত হতে পারে না।
জীবনের নির্দিষ্ট সীমা থেকে একটি বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়া সামান্য বিষয় নয়। একটু ভাবুন, আপনার হায়াত যদি ৭০ বছর হয়ে থাকে তাহলে এর থেকে একটি বছর চলে গেল। শত চেষ্টা করেও সেই বছরটি আর জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না।
আপনি হয়ত আরও ৬৯ বছর বাঁচবেন, কিন্তু এই বছরটি আর আপনার জীবনে কোনোদিন ফিরবে না। একজন চিন্তাশীল মানুষের কাছে এটা অনেক ভাবনার বিষয়। এই এক বছরে আমি কী করলাম, আমার কী করার ছিল, কেন করতে পারলাম না এই ভাবনাটাই হলো নতুন বছরের মূল চেতনা।
মানুষকে তার প্রতিটি কর্মের জন্য একদিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ফেলে আসা দিনগুলোর কৃতকর্মের ওপরই তার পরিণাম নির্ভর করে। হাদিসে মানুষের অতীত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে বিচার-বিশ্লেষণ করে ভবিষতের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সার্বক্ষণিক মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবগত আছেন।
এজন্য মানুষের উচিত অতীতের ভুলত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হওয়া। অনুশোচনার অশ্রু প্রবাহিত করা। দুটি বছরের সন্ধিক্ষণ এর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তাই পুরনো বছরকে বিদায় দিতে কিংবা নতুন বছরকে স্বাগতম জানাতে এমন কোনো আনন্দ-ফূর্তি করা উচিত নয় যা এই ভাবনাকে ভুলিয়ে দেয়।
নতুন বছর হারানো দিনগুলোর বেদনা ভুলে নবউদ্যমে পথ চলতে প্রেরণা জাগায়। নতুন করে জীবন শুরুর সুযোগ এনে দেয়। এজন্য বছরের শুরুতেই আমাকে পরিকল্পনা করা উচিত আমি বছরটি কীভাবে কাটাবো।
আগামী দিনগুলোতে আমি কী কী ভালো কাজ করবো এর একটা তালিকাও করে নিতে পারি। ৩৬৫টি দিন কম নয়। প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করলেও বছর শেষে ৩৬৫টি ভালো কাজ হয়ে যাবে। এই দিনগুলোতে আমি কোনো খারাপ কাজ করবো না এমন সংকল্পও করা উচিত। এর দ্বারা জীবন সুন্দর হবে।
আমাদের জীবনের যে প্রকৃত লক্ষ্য তা অর্জিত হবে। আমাদের স্বল্পসময়ের জীবনকে স্বার্থক করার জন্য নতুন বছরের এই পরিকল্পনা খুবই জরুরি।
নতুন বছর আমাদের পেছনের হিসাবে একটু চোখ বুলানোর সুযোগ করে দেয়। গত বছরটি আমি কীভাবে কাটালাম এই হিসাবের দিকে একটু তাকিয়ে দেখি। আমি আমার নিজের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য যা করার ছিল তা কি গত বছর করতে পেরেছি? মুসলিম উম্মাহর জন্য আমার যে করণীয় ছিল সেটা কি করেছি?
হয়ত সেই হিসাব দেখলে অনেকেরই হতাশ হতে হবে। আমরা নিজেকে নিয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে যতটা ব্যস্ত এর সিকিভাগও দেশ ও জাতি নিয়ে ভাবি না। মুসলিম উম্মাহর কথা আমরা চিন্তাই করি না। অথচ এটা আমাদের দায়িত্ব। এজন্য বছরের শুরুর দিন থেকেই আমরা আমাদের দায়িত্বগুলোর ব্যাপারে সচেতন হই।
আমরা নিজেকে যেমন সুন্দর করবো তেমনি দেশ ও জাতিকে সুন্দর করার সংকল্পও আমাদের করতে হবে। চারদিকে যে অন্যায়-অবিচার আছে এর বিরুদ্ধে কিন্তু আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে। আমরা যে বয়সেরই হই, দায়িত্ব সচেতন হলে আমার দ্বারা সবাই উপকৃত হবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম