পলাশ রহমান
ইতালি থেকে
রংপুর সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী হাতপাখা মার্কায় ২৪ হাজার ছয় ভোট পেয়েছেন। যা বেসরকারিভাবে নির্বাচিত লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী থেকে প্রায় একলাখ সাড়ে ৩৬ হাজার ভোটের বিশাল ব্যবধানে দলটিকে চতুর্থ নাম্বারে তুলে এনেছে। এতেই ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎফুল্লতা লক্ষ করা গেছে। সোস্যাল মিডিয়ায় তারা এটাকে আদর্শিক বিজয় বলে শুকরিয়া প্রকাশ করেছে।
আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারিনি এখানে তারা আদর্শিক বিজয়ের কী দেখলেন। রংপুর সিটি নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ। ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ। রিটার্নিং অফিসের এই হিসাবে ইসলামী আন্দোলনের প্রতীক হাতপাখায় মোট কতো শতাংশ ভোট পেড়েছে?
এই ভোট সংখ্যা দিয়ে তাদের কী অর্জন হয়েছে? তারা কী আদৌ ইসলামী আন্দোলনকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড় করাতে পেরেছে?
রংপুর সিটি করপোরেশনে ইসলামী আন্দোলনের মোট কতো জন ভোটার আছে? দলের ভোট ব্যাংকের সংখ্যা কতো? তারা কী সবাই ভোট দিয়েছে? দলীয় ভোট ব্যাংকের বাইরে সাধারণ মানুষের কতো শতাংশ ভোট তাদের প্রার্থী গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন?
ভোটের এই চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়তো ইসলামী আন্দোলনের নেতারা করবেন। তাদের নির্বাচনি সেলে হয়তো এগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, গবেষণা হবে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো- রংপুর সিটি নির্বাচনে গোলাম মোস্তফা শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ছিলেন না, তিনি অঘোষিতভাবে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র প্রার্থী ছিলেন।
দলটি যদি এই বিবেচনা মাথায় রেখে কাজ করতো তবে তাদের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান বিজয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সাথে আরো অনেক কমে আসতে পারতো।
ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎফুল্লতার অন্যতম কারণ হতে পারে ধানের শীষ প্রতীকের সাথে তাদের প্রতীকের ভোটের ব্যবধান। কারণ রংপুর সিটি নির্বাচনে ধানের শীষ এবং হাতপাখা প্রায় কাছাকাছি অংকের ভোট পেয়েছে। দুই প্রতীকের মধ্যে ভোটের ব্যবধান মাত্র ১১ হাজার থেকে একটু বেশি। যা বিএনপির প্রার্থীকে এনে দিয়েছে তৃতীয় অবস্থান এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীকে চতুর্থ অবস্থান।
আমি মনে করি ধানের শীষের সাথে হাতপাখার এই ভোট ব্যবধানে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার মতো বিশেষ কিছু নেই। কারণ রংপুর সিটি নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে লাঙ্গল এবং নৌকার মধ্যে। জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলের জন্যই রংপুর বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সুতরাং তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারলেই হাতপাখার প্রকৃত সাফল্য দৃশ্যমান হতো।
ইসলামি আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ভাবতে পারেন রংপুরে অন্য কোনো ইসলামি দল প্রার্থী দিতে পারেনি, তাদের দল পেরেছে, এটাই তাদের বড় সাফল্য তাহলে বলার কিছু নেই। তবে রাজনৈতিক এতিম প্রার্থীদের সাথে অথবা বিরোধীদল হিসাবে চরম রকমের ব্যর্থ বিএনপির প্রার্থীর সাথে তুলনা করে ইসলামি আন্দোলন বা ইসলামি আন্দোলনের প্রতীককে ছোট করার পর্যায়ে হয়তো দলটি এখন আর নেই, এই বাস্তবতা ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বুঝতে হবে।
নির্বাচনে ভালো করার জন্য নয়, বরং বিজয়ের জন্য তাদের লড়াই করতে হবে। সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে- তারা হেরে গেলে দেশের ইসলামপন্থীরা হেরে যায়, তারা বিজয়ী হলে ইসলামপন্থীদের বিজয় হয়। সুতরাং বিজয়ের জন্য দলের তৃণমূলে অধিক মনোযোগী হতে হবে।
শুধুমাত্র মেয়র বা এমপি নির্বাচন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না থেকে ওয়ার্ড, ইউনিয়ান পর্যায়ের নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী দিতে হবে এবং একদম গোড়া থেকে জনপ্রতিনিধি সৃষ্টির জন্য কাজ শুরু করতে হবে।
কাছে-ধারে দেশের আরো অন্তত ৫টি সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সরকার টালবাহানা না করলে ঢাকা উত্তরেও নিয়ম মাফিক উপনির্বাচন হওয়ার কথা। এসব নির্বাচনে দলটি আগের তুলনায় অধিক পরিকল্পিত, গোছালোভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে সম্মানজনক ফলাফল ঘরে উঠার সম্ভবনা অবাস্তব নয়।
তবে দলকে রাজনৈতিক দক্ষতা বিচক্ষনতা দেখাতে হবে। আরো বেশি বিস্তর পরিসরে চিন্তা করতে হবে। একলা চলতে গিয়ে একবারে ‘একা’ হয়ে যাওয়া কোনো শুভ লক্ষণ নয় তা মাথায় রাখতে হবে।
রংপুর, নারায়ণগঞ্জ বা ঢাকা সিটির মতো কথিত ভালো ফলাফল না করে বরং সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসার চেষ্টা করতে হবে। নামকা ওয়াস্তে তিনশ আসনে বা সব সিটিতে মেয়র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে কিছু মানুষকে নির্বাচন বাণিজ্য করার সুযোগ না করে দিয়ে বরং গোড়া থেকে জনপ্রতিনিধি সৃষ্টি করতে পারলেই প্রকৃত সাফল্য ঘরে উঠবে ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক সম্ভবনাময় একটা দল হওয়ার পরও আজ পর্যন্ত তাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ী জনপ্রতিনিধি নেই। সুতরাং অন্যের উপর দোষ না চাপিয়ে এর সত্যিকারের কারণ উদঘাটন করে একদম শেকড় থেকে কাজ শুরু করতে হবে। প্রত্যেক শহর গ্রামের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে যাতে দুই চারজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারে সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে চরমোনাই ইউনিয়ানের মতো সারা দেশে অন্তত একশ ইউনিয়ন, ওয়ার্ডে বিজয়ী জনপ্রতিনিধি সৃষ্টি করতে হবে। ইসলামপন্থী অন্যান্য দলগুলোর সাথে নির্বাচন কেন্দ্রীক সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
দলীয় ভোট ব্যাংকের বাইরে গিয়ে সাধারণ ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। কারণ বিজয়ী প্রার্থী যেখানে ১ লাখ ৬০ হাজারের উপরে ভোট পায় সেখানে ইসলামি আন্দোলনের প্রার্থীর ভোট মাত্র ২৪ হাজার। এই অসম্মানজনক ব্যবধান দিয়ে নির্বাচনী কুতকুত খেলা যেতে পারে, সাফল্য ঘরে উঠবে না।
২.
রংপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের উৎফুল্লতার মাঝে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ঢাকার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। তাদের নির্বাচন বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে রংপুরে হাতপাখার প্রাপ্ত ভোট। উপস্থাপক আলোচকরা মিলে প্রায় সাড়ে চার মিনিট সময় খরচ করেছেন ইসলামী আন্দোলনের জন্য।
এ নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। চ্যানেলটির রংপুর স্টুডিও থেকে যোগ দেয়া একজন নারী সাংবাদিক হাতপাখায় ২৪ হাজার ভোট পড়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে কিছুটা ইতিবাচক কথা বলেছেন।
এতে যেমন নেতাকর্মীরা খুশি হয়েছেন একই ভাবে উপস্থাপকসহ অন্যরা দলটির নাম সঠিকভাবে বলতে না পারায় বেজায় বেজার হয়েছেন। কেউ কেউ সাংবাদিকদের সমালোচনা করেছেন শালীনতার বাইরে গিয়ে।
সাংবাদিক আলোচকদের জানার পরিধি, জ্ঞানের পরিধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, কিন্তু একটা বিষয় হয়তো অস্বীকার করার যো নেই যে, ইসলামী আন্দোলন সঠিকভাবে তাদের দলকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনার আগে আমি ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কাছে একটা প্রশ্ন করতে চাই- বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির অনুষ্ঠানে, প্রকাশনায় আমিরুল মুজাহিদের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করা হয় না কেনো? মুজাহিদ কমিটির আমির বা পীর সাহেব চরমোনাইর পাশাপাশি ইসলামি আন্দোলনের আমির বলা বা লেখা হয় না কেনো?
সহজ উত্তর হলো নীতিনির্ধারকরা একটার সাথে অন্যটা গুলিয়ে ফেলতে চান না। তারা আলাদা দুটি প্লাটফর্ম থেকে রুহানিয়াত এবং জিহাদের সমন্বয় ঘটাতে চান। মুজাহিদ কমিটির ব্যানারে অরাজনৈতিক, ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান। ইসলামী আন্দোলনের ব্যানারে রাজনৈতিক কর্যক্রম করতে চান।
বিষয়টা যদি এমনই হবে তবে কেনো ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘পীর সাহেব চরমোনাই’ পরিচয়টা এত বড় করে দেখানো হয়? এখানে কেনো আন্দোলনের ‘আমির’ পরিচয়ের পাশাপাশি ‘পীর সাহেব চরমোনাই’ পরিচয় তুলে ধারা হয়? বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্দোলনের আমির পরিচয় থেকে ‘পীর’ পরিচয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
দলের ব্যানার, পোষ্টার, লিফলেন, প্রেস রিলিজসহ অন্যান্য প্রকাশনায় ‘পীর’ পরিচয় অধিক গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধারা হয়। যেমন পীর সাহেব চরমোনাই ঘোষিত, পীর সাবেহ চরমোনাই মনোনীত, পীর সাহেব চরমোনাই স্বীকৃত, ইত্যাদি।
এমনকি ইসলামী আন্দোলনের অনুষ্ঠানে আমিরের নাম ঘোষনার সময় ‘পীর’ পরিচয় বলার সময় গলার উপর অধিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। এতে সাধারণ দৃষ্টিতে হয়তো কোনো সমস্যা মনে হয় না, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া খুব বেশি শুভকর হয় না, যার ছোট্ট প্রমাণ দিয়েছে একাত্তর জার্নাল।
যখন রাজনৈতিক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ‘পীর’ পরিচয় গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয় তখন সাধারণ মানুষ ইসলামী আন্দোলনকে কোনো রাজনৈতিক দল ভাবতে পারে না। তাদের মানষপটে ভেসে ওঠে সুফি, দরবেশ বা খানকা কেন্দ্রীক কোনো পীরের পতিচ্ছবি।
তারা ইসলামী আন্দোলনকে রাজনৈতিক দল না ভেবে পীরের দল ভাবেতে শুরু করে। সুতরাং ইসলামী আন্দেলন যতো বড় মিটিং মিছিলই করুক না কেনো তা রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে গিয়ে পীরের দল বা পীরের কাজ বলে মূল্যায়িত হয়।
যেমন মুজাহিদ কমিটি যদি এখন থেকে আমিরুল মুজাহিদের পাশাপাশি ইসলামি আন্দোলনের পরিচয় দেয়া শুরু করে কিছু দিন পরে দেখা যাবে কিছু মানুষ মুজাহিদ কমিটির কার্যক্রমকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে মূল্যায়ন করতে শুরু করবে।
সুতরাং ‘পীর’ পরিচয় মুজাহিদ কমিটির জন্য এবং ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে যদি আন্দোলনের ‘আমির’ পরিচয় আলাদা করে তুলে ধরা না হয় তবে যোগ্য মূল্যয়ন পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষ, মিডিয়াকর্মীরা বিভ্রান্ত হয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অনেক বড় বড় রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করে সত্যি, কিন্তু তা সাধারণ মানুষ এবং মিডিয়ার কাছে পীরের দল বা পীরের কার্যক্রম বলেই মূল্যায়িত হয়। এতে ওইসব অনুষ্ঠানের রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে যায়।
এমনকি দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সরকারের কাছে পীরের দল, পীরের কার্যক্রম উল্লেখ করে রিপোর্ট পেশ করে। তাছাড়া অন্য একটা বিষয় হলো ইসলামী আন্দোলনের নেতারা দলটিকে সাধারণ মানুষের কাতারে নামিয়ে আনতে পারেননি।
ইসলামী আন্দোলনকে গণমানুষের দলে পরিণত করতে পারেননি। তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে কোনো সাধারণ ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করতে পারেননি। তাদের আমির, নায়েবে আমির কেউ নিয়মিত ঢাকায় থাকেন না। প্রতিদিন রাজনৈতিক অফিসে বসেন না। তারা ব্যস্ত সময় কাটান ওয়াজ মাহফিল নিয়ে। তাদের মহাসচিব দাড়িতে মেহেদির রং মেখে সুফি দরবেশ সেজে বসে থাকেন।
দেশের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে স্বতন্ত্র কিছু বলেন না। দলটিকে তারা ধর্মীয় ইস্যু ভিত্তিক রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছেন। প্রতিষ্ঠতা আমির সৈয়দ ফজলুল করিম রহ. এর মৃত্যুর পর দলে পারিবারিক প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কোনো অনুষ্ঠানে ‘সৈয়দ’ পরিবারের অতি প্রভাব অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু মনে হয়। যা দলের সার্বজনিন গ্রহণযোগ্যতায় বেঘাত ঘটায়।
একাত্তর টিভির মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়ার কাছেই ইসলামী আন্দোলন খুব বেশি পরিচিত কোনো নাম নয়। এর প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক মূল্যায়নের বাইরে গিয়ে ইসলামী আন্দোলন পীরের দল হিসাবে মূল্যায়িত হওয়া এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো ধারাবাহিকতা না থাকা।
কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠতে না পারা। নিয়মিত জনস্বার্থ ঘনিষ্ট কর্মসূচি না থাকা। ধর্মীয় ইস্যু ভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে আত্মতৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করা। মিডিয়াসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রকাশ্য সমালোচক, শুভাকাঙ্ক্ষি সৃষ্টি করতে না পারা।
যে কারণে ইসলামী আন্দোলনের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সাফল্য অন্যদের ঘরে ওঠে। ইসলামী আন্দোলনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যায় সমমনা অন্যদের কৌশলী অবস্থানে।
দেশের জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখার মতো, টকশোয় আলোচনা করার মতো, সমালোচনা করার মতো যোগ্য মেধাবী মানুষ ইসলামী আন্দোলনে নেই তা কিন্তু নয়, কোনো এক অদ্ভুত কারনে তারা দলে গুরুত্বহীন পর্যায়ে পড়ে থাকেন। কৌশলে তাদের দাবিয়ে রাখা হয়।
সুবিধাবাদী, তেলবাদীদের ভিড়ে তারা পেছনে পড়ে থাকেন। তাদের যোগ্য মূল্যায়ন করা হয় না। দলের আভ্যন্তরীন কুটরাজনীতি তাদের সামনে আসতে দেয় না। ডা. মোখতার হুসাইনের মতো পরীক্ষিত নেতাকেও এক সময় কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়েছিল। তাছাড়া ওয়াজ মাহফিল কেন্দ্রীক বাণিজ্যের কারণেও অনেককে ছিটকে পড়তে দেখা যায়।
দলের বাইরে দেশের ইসলামপন্থীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের যোগ্য মূল্যায়ন করা হয় না। নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হয় না। দলের বাইরে রাজনৈতিক লবিং গ্রুপিং করা হয় না। মিডিয়াগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হয় না।
আজ পর্যন্ত সমমনাদের নিয়ে একটা নির্বাচনী জোট পর্যন্ত গঠন করতে পারেনি বিপুল সম্ভবনাময় দলটি। এক প্রকারের আত্মঅহমিকায় ভোগে দলের আপদমস্তক।
এসব কথা যদি বিশ্বাস না হয়, বাড়াবাড়ি মনে হয় তবে নিজেদের গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে আসুন, ইসলামি রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ নেই এমন মানুষের কাছে যান, যাচাই করে দেখুন দেশের কতোজন মানুষ ‘পীর’ পরিচয়ের বাইরে আপনাদের সংগঠনের নাম জানে। কতো জনকে আপনারা আপনাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব জানান দিতে পেরেছেন।
হয়তো মিডিয়াকে দুষবেন, কিন্তু দেশের মিডিয়াগুলোকে তো আপনাদের বন্ধু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তারা অসহযোগিতা করবে এটাই তো স্বাভাবিক। সুতরাং অযোগ্যদের মতো অন্যের উপর দোষ না চাপিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করুন। রাজনীতির মাঠে নতুনত্ব আনুন। চমক সৃষ্টি করুন। নিয়মিত জনস্বার্থে কর্মসূচি দিন। রাজনীতির মূল স্রোতে এসে ধারাবাহিকতা রক্ষা করুন। দেশ পরিচালনার প্রতিটি স্তর নিয়ে খোলাখুলি কথা বলুন। জনগনের সমস্যা নিয়ে সরাসরি কথা বলুন।
‘ইসলাম কায়েম হলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে’ এমন গদ বাঁধা কথা না বলে দুই আদর্শের সুফল কুফল নিয়ে সরাসরি কথা বলুন। দুই আদর্শের পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করুন। প্রচলিত আদর্শের দূর্বলতাগুলো যুক্তি দিয়ে তুলে ধরুন।
সাধারণ মানুষকে ইতিহাস না পড়িয়ে তাদের নিত্য সমস্যা নিয়ে কথা বলুন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে সমালোচক, শুভাকাঙ্ক্ষি সৃষ্টি করুন। আওয়ামী লীগের মতো দলও তাদের নেতা এমপিদের সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়, আপনারা দেন না কেনো?
আপনারা কেনো সোস্যাল মিডিয়া জগতের জন্য একঝাক প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী তৈরি করেন না, যারা দলের হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে প্রোপাগাণ্ডা করবে। পরিকল্পিত এবং গোছালো আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি করবে।
দেশের সব মিডিয়া বা মিডিয়াকর্মীতো ইসলামি বিদ্বেষী নয়। তাদের মধ্যে আপনাদের বন্ধু নেই কেনো? আপনাদের সমালোচক নেই কেনো? আপনাদের কাউকে টকশোয় দেখা যায় না কেনো? যদি বলেন সবাই আপনাদের বিরোধী তাহলে আপনাদের রাজনৈতিক দক্ষতা যোগ্যতার মূল্য কী থাকলো?
নিজেদের যোগ্যতায় কেনো নিজেদের জায়গা করে নিতে পারেন না? মতোবিরোধের কারনে আপনারা কেনো সব জায়গা থেকে দুরে সরে আসেন? সঠিক পথে অন্যদের ধরে রাখতে পারেন না কেনো? মতোবিরোধের দোহাই দিয়ে ‘একলা’ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচায় প্রকাশ পায় না তা হয়তো আপনারা বোঝে না, কিন্তু সচেতন মহলের বুঝতে অসুবিধা হয় না।
লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি
প্রথম আলোর চরমোনাই সিলসিলা ও রসিক নির্বাচন