মোস্তফা কামাল
ঘুষ নিয়ে বেনাপোল ইমিগ্রেশনে কাস্টমস ও পুলিশ সহনীয় মাত্রায় ঘুষাঘুষি করলে ভাঙচুরসহ এত কাণ্ডকীর্তি হয় না। গড়াত না এমন ফ্যাসাদে। ইমিগ্রেশন ওসি ওমর শরীফকেও বদলি হতে হয় না।
সহনীয়তার গুরুত্ব না বোঝায় এখন তাদের সবার দুর্গতি। গণমাধ্যমগুলোও রসালো খবরের আইটেম পেতো না। এ সময়টাতেই নিজ মন্ত্রণালয়ের লোকজনদের সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। কিন্তু ঘুষ বিষয়ে তার সহনীয় মাত্রার থিউরি মানতে নারাজ দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যান।
তিনি বলেছেন, ঘুষ ঘুষই। এটা দুর্নীতি। তা সহনীয়, অসহনীয়, দুঃসহ যা-ই হোক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে ঘুষ-দুর্নীতি নম্বর ওয়ান প্রতিবন্ধকতা হলেও ব্যাপকতার তোড়ে শিক্ষামন্ত্রীর একে সহনীয় পর্যায়ে করার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতেই দুদক চেয়ারম্যানের এই প্রতিক্রিয়া।
দেশের বিদ্যমান আইনে ঘুষ দেওয়া-নেওয়া দুটোই দুর্নীতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত। শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডে অন্তর্ভুক্ত। যদিও হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়েও দিন কয়েক সরস আলোচনা ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয় না। কোনো সমাধানও মেলে না।
এ পর্যায়ে এসে সহনীয়তা বিষয়েও কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে কিঞ্চিত ভিন্নতা শিক্ষামন্ত্রীর তত্ত্বের সঙ্গে। তত্ত্বের তরজমায় বলেছেন, চালের দাম অসহনীয়। সরকারই চেয়েছিল চালের দাম একটু বাড়ুক
কারণ, মাননীয়দের এ ধরনের মন্তব্যে মানুষের কাতুকুতু ছাড়া আর কোনো প্রাপ্তি নেই। বরং ঘুষ, ঘুষি, দুর্নীতি, লেনদেন, বিনিময়, হাদিয়া, নজরানা, স্পিডমানি, গিফটের ঝাপটাঝাপটি ও গতি আরও বাড়ে। অফিস-আদালতে ঘুষের আলগা কামাই, মহার্ঘ্য (মহা+অর্ঘ্য), উপরি, ইনাম ইত্যাদি সোহাগি নামও রয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদসহ আমাদের কারও কারও স্মৃতিভ্রম না ঘটে থাকলে জানার কথা শিক্ষামন্ত্রীর আরও অনেক আগেই ঘুষকে বৈধতার ফতোয়া দিয়েছেন আরও পাওয়ারফুল মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অর্থমন্ত্রীর অনেক চড়া-কড়া বচনের সঙ্গে রয়েছে বাচনও। ঘুষকে তিনি স্পিডমানি নামে ডাকতে বলেছেন। ঘুষ নিয়ে মাতামাতির সময় আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘স্পিড মানি বৈধ। গিফটও অবৈধ নয়। কারও কাজ দ্রুত করে কিছু নিলে সেটা হবে উপহার।
সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের বিষয়েও তত্ত্ব রয়েছে তার। বলেছেন, এটা পাচার নয়, লেনদেন। আর এত লেনদেন মানে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। মানুষের হাতে অনেক টাকাই মানুষের আয় বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত।
এ পর্যায়ে এসে সহনীয়তা বিষয়েও কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে কিঞ্চিত ভিন্নতা শিক্ষামন্ত্রীর তত্ত্বের সঙ্গে। তত্ত্বের তরজমায় বলেছেন, চালের দাম অসহনীয়। সরকারই চেয়েছিল চালের দাম একটু বাড়ুক।
কী বোঝালেন? কী বার্তাই বা দিলেন এই মহোদয়। অর্থ ও শিক্ষামন্ত্রীর আগে-পরে আরেক হেভিওয়েট মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সহনশীলতার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
তিনি সহনশীলতার পরামর্শ দিয়েছেন ছাত্রলীগকে। তাদের স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের কাজে মানা করেছেন। বলেছেন, শিশুদের পিঠে এমনিতেই বইয়ের বোঝা। তার ওপর লীগের ভার তারা সইতে পারবে না। তাই এখন তা না করাই ভালো বলে পরামর্শ ওবায়দুল কাদেরের।
দুর্নীতি আর হরিলুটের মধ্যে তফাত রয়েছে। দেশে কোনো হরিলুট হচ্ছে না। যা হচ্ছে সেটা টুকটাক লুটপাট । অর্থাৎ হরিলুট নাজায়েজ লুটপাট জায়েজ
সহনশীলতার শিক্ষাটি একেবারে আচমকা বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে মাঠে আসেনি। বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী তত্ত্বটি দিয়েছেন প্রক্ষিত দৃষ্টেই। তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলেছেন, ঘুষ খান। কিন্তু সহনীয় মাত্রায় খান। শুধু অফিসাররা চোর নয়। মন্ত্রীরাও চোর। আমি নিজেও চোর।
এ কথার সঙ্গে আরও কিছু কথাও বলেছেন নাহিদ। ঘুষের সমালোচনা করে বলেছেন, এ অবস্থা পাল্টাতে হবে। অনেকটা আত্মসমর্পণের মতোই বলেন- অনুরোধ করছি, আপনারা ঘুষ খান। কিন্তু সহনশীল হয়ে খান। কেননা আমার সাহস নেই বলার, ঘুষ খাবেন না। তা হবে অর্থহীন।
শিক্ষাভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন। বলেন, আপনারা স্কুলে যান খাম রেডি থাকে। সেটি নিয়ে আসেন আর পজিটিভ রিপোর্ট দেন। কিছুদিন আগে একজন কর্মকর্তাকে দুদক দিয়ে ধরিয়েছি। কারণ থানা-পুলিশ দিয়ে ধরালে ঘুষ খেয়ে তারাও ছেড়ে দেবে। তাই দুদক দিয়ে ধরাতে হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ওই কর্মকর্তার তথ্য সংগ্রহ করে দেখলাম তিনি পাঁচটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবার এক মাসের বেতন দিতে বলেছেন। সে অনুযায়ী শিক্ষকরা টাকা রেডি করে। অনেক কষ্টে তাকে ধরতে হয়েছে। ঢাকায় আটককালে তার সঙ্গে পাওয়া গেছে ক্যাশ আড়াই লাখ টাকা। ওই দফতরে চাকরি করে একজন ঢাকায় ১৩টি বাড়ি করেছেন এমন তথ্যও জানান শিক্ষামন্ত্রী।
গণমাধ্যমে তার সব কথা আসেনি। সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার সবকটিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এতে বিষয়টি শুধু সমালোচনার আইটেমই হয়েছে। যে যা পারছেন বলছেন। মন্তব্যের ইয়ত্তা নেই। কেউ জানতে চান, ঘুষের সহনীয়তার মাত্রা কত? কত টাকা দেওয়া-নেওয়া করলে মাত্রা মতো হবে? আবার কারও প্রশ্ন— অনৈতিক বিষয়ে উৎসাহিত করা বাবদ তিনি কত ইনাম পেয়েছেন? ঘুষকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষমতা কি জনগণ কিংবা সরকার তাকে দিয়েছে? এমনতর প্রশ্নের শেষ নেই।
রসিকতা করে কেউ কেউ ঘুষের সহনীয় মাত্রার সংজ্ঞা-ব্যাখ্যাও ঠিক করেছেন। এক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে পরিমাণ টাকার বান্ডিল দাতার পকেট থেকে বের হতে এবং গ্রহীতার পকেটে ঢুকতে অসুবিধা হয় না সেটাই সহনীয় মাত্রা।
এখন লোকজন কষ্ট করে মাননীয়দের চোর বলে না। এটা তাদের গা সহা হয়ে উঠেছে। তবে, মান্যগণ্যরা নিজেই নিজেদের চোরের শিরোপা দিচ্ছেন। প্রকাশ্য দিবালোকে চুরি-দুর্নীতির জানান দিয়ে বাহাদুরি দেখানোর ঘটনাও বাদ যাচ্ছে না
মাস কয়েক আগে দুর্নীতি আর হরিলুট বিষয়ে আপডেট তত্ত্ব জানিয়েছেন আরেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বলেছেন, দুর্নীতি আর হরিলুটের মধ্যে তফাত রয়েছে। দেশে কোনো হরিলুট হচ্ছে না। যা হচ্ছে সেটা টুকটাক লুটপাট।
অর্থাৎ হরিলুট নাজায়েজ। লুটপাট জায়েজ। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সংলাপে এ পানিসম্পদমন্ত্রী পানির মতো বুঝিয়ে দিলেন দুর্নীতি আর লুট, হরিলুট, লুটপাটের ব্যাপারটা।
এ মাননীয়রা ঘুষ, দুর্নীতি, চুরির স্বীকারোক্তি ও বৈধতা দিয়ে এখন যা বলছেন তার আভাস জীবদ্দশার শেষদিকে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা।
তিনি বলেছিলেন, ‘লোকজন একদিন ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কর্মীদের দেখলে বলবে তুই চোর। একসময় যেমন স্বাধীনতাবিরোধীদের বলত তুই রাজাকার।
ক্ষমতাসীনদের অনেকে এতে তার ওপর নাখোশ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের খাস লোক হয়েও লোকটা কেন উল্টা কথা বললেন, এর নানা ব্যাখ্যা প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকটা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে এবিএম মূসার কথা।
এখন লোকজন কষ্ট করে মাননীয়দের চোর বলে না। এটা তাদের গা সহা হয়ে উঠেছে। তবে, মান্যগণ্যরা নিজেই নিজেদের চোরের শিরোপা দিচ্ছেন। প্রকাশ্য দিবালোকে চুরি-দুর্নীতির জানান দিয়ে বাহাদুরি দেখানোর ঘটনাও বাদ যাচ্ছে না।
মাননীয় নৌপরিবহনমন্ত্রী গর্বভরে বলেছেন, তিনি এরশাদ ও মাইনুদ্দিন খান বাদলের সুপারিশে দুজনকে চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি দিয়েছেন। কী জানালেন-বোঝালেন তিনি? সারা দেশে কোটি কোটি বেকারের জন্য যে এরশাদ-বাদল সাহেব নেই তারা কী করবে? এ গর্বের জানান দেওয়া কোন নীতি?
এর আগে, প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা বলেছিলেন, ছাত্রলীগ কর্মীরা শুধু ভাইভা কার্ড পেলেই হবে। তিনি চাকরির ব্যবস্থা করবেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জোস সামলাতে না পেরে বলেছেন, ছাত্রলীগ করা মানেই তার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি। এ নিয়ে প্রশ্ন বা জবাবদিহির কিছু নেই।
সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এসএস/