তাইফুর রহমান তমাল
রাজধানী ঢাকা ‘মসজিদের শহর’ নামে খ্যাত। শহরটিতে অসংখ্য মসজিদ রয়েছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন মসজিদটি এই শহরে প্রথম নির্মাণ করা হয়েছিল তাহলে ভাবনায় পড়তে হবে। কেননা এই তথ্য অনেকেরই অজানা।
‘কোম্পানী আমলে ঢাকা’ গ্রন্থে জেমস টেলর উল্লেখ করেছেন, ‘১৮৩২ সালে ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট জর্জ হেনরি ওয়াল্টার এক রিপোর্টে বর্ণনা করেন, তৎকালীন ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা ছিল ১৫৩টি। এই সংখ্যা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ক্রমেই ঢাকা পরিণত হতে থাকে অসংখ্য মসজিদের শহরে।’
বর্তমানে ‘মসজিদের শহর’ ঢাকায় কতটি মসজিদ আছে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া কঠিন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২০১৬ সালের এক হিসাব মতে, ঢাকায় ১১ হাজারেরও বেশি মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদে রয়েছে নান্দনিকতা আর আধুনিকতার ছোঁয়া। এত মসজিদের ভিড়ে আপনার যদি জানতে ইচ্ছে করে- ঢাকার প্রথম মসজিদ কোনটি? এর উত্তর পেতে হলে যেতে হবে পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকায়।
এলাকার ধোলাইখাল মোড় থেকে দয়াগঞ্জ যেতে মাঝামাঝি নারিন্দা মোড়। পুরান ঢাকার ৬ নম্বর নারিন্দা রোডের সুপ্রাচীন ‘হায়াৎ বেপারী’র পুলের উত্তর দিক থেকে ৫০ গজ পেরুলেই দেখা মিলবে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাচীন মসজিদের। নাম বিনত বিবির মসজিদ। এটিই ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদে খোদিত লিপি থেকে জানা যায়, এটি পাঠান রাজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে ১৪৫৬ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছোট এ মসজিদটির গঠন সুদৃঢ়। যতীন্দ্রমোহন রায় লিখিত ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে এই মসজিদের উল্লেখ রয়েছে। মসজিদের অবস্থান অবশ্য এটাও প্রমাণ করে যে, ১৪৫৬ সালের আগে থেকেই এলাকায় মুসলমানদের বসবাস ছিল। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন রচিত ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মসজিদটি দ্বিতীয় সংস্করণে ছয়-সাত কাঠা জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের আদি গঠনে একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজ এবং চার কোণবিশিষ্ট হলেও বাংলা ১৩৩৭ (১৯৩০ খ্রি.) সনে দ্বিতীয়বার সংস্কারকালে আরো একটি গম্বুজ যুক্ত করা হয়, যা মসজিদটির বিবর্তন ও সম্প্রসারণের স্পষ্ট ধারণা দেয়।
মসজিদের দেয়ালে স্থাপিত একটি কালো পাথরে ফারসি ভাষায় লিখিত বর্ণনায় রয়েছে, সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহর আমলে আরকান আলী নামক এক পারস্য সওদাগর ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঢাকার নারিন্দায় বসবাস শুরু করেন এবং তিনিই ৩০-৪০ জন মুসল্লির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বিনত বিবির মসজিদ নির্মাণ করেন। ঢাকায় বসবাসকালেই আরকান আলীর অতি আদরের কন্যা বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং তাকে ওই মসজিদসংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। কন্যার আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে-দুঃখে পিতা আরকান আলীও ছয় মাস পর মৃত্যুবরণ করলে তাকেও কন্যার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। অন্য একটি বর্ণনা মতে, মাহরামাতের কন্যা মুসাম্মাৎ বখত বিনত বিবি মসজিদটি নির্মাণ করিয়েছেন।
মসজিদের গায়ে বসানো একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, ৮৬১ হিজরি মোতাবেক ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করা হয়। সে হিসাব মতে মসজিদটি সুলতানি আমলের। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানী লিখেছেন, এটি সুলতানি আমলে নাসিরুদ্দিন মাহমুদের রাজত্বকালে (১৪৩৫-১৪৫৯) নির্মিত হয়েছিল। মসজিদের ১০ গজ দূরেই আছে বিনত বিবির মাজার ও তার বাবার মাজার।
কালের বিবর্তনে অনেক কিছু পাল্টেছে। নারিন্দা এলাকাটিও এর ব্যতিক্রম নয়। এখন পুরোনো সেই মসজিদকে পাশে রেখে তৈরি করা হয়েছে ৭ তলা আরেকটি মসজিদ। মসজিদটিতে এখন নামাজ পড়া না হলেও শিশুদের পবিত্র কোরআন শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। এখন নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডের চারপাশের দালানগুলো দৃষ্টি করেছে সীমাবদ্ধ। মসজিদের চারপাশে কিছু লেদ মেশিনের কারখানা গড়ে উঠেছে। ভোজনবিলাসীদের জন্য রয়েছে বেশকিছু নামিদামী রেস্তোরাঁ। তবে মসজিদের পুরোনো দালানটি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়ার আগে ঘুরে আসতে পারেন আমাদের এই রাজধানীর ৫৬১ বছরের পুরোনো মসজিদটিতে।
সুত্র: এনটিভি অনলাইন।
এসএস/