সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
অতিথি লেখক
বাড়ির পাশের মুদি দোকান। দুইটা-আড়াইটার দিকে গেলাম একটা প্রয়োজনে। দোকানের সামনের সিমেন্টের বেঞ্চে তিনজন মাদরাসাছাত্র বসে বসে বনরুটি-মিষ্টি সমুচা খাচ্ছে। গায়ে নীল রঙের জামা। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বয়স আট থেকে বারোর মধ্যে।
পাশে রাখা ম্রিয়মান সাদা বস্তা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না- ‘কালেকশনে’ বেরিয়েছে তারা। ক্লান্ত মুসাফির দোকানের বেঞ্চে বসে সেরে নিচ্ছে দুপুরের বনরুটি-লাঞ্চ। একজন খাওয়া শেষ করে দোকানির কাছ থেকে চেয়ে ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে নিলো। ওর রোদজ্বলা দুপুরের ক্ষুধা কি মিটলো?
মাদরাসার বাচ্চাদের এভাবে দেখলেই আমার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। একটা সময় আমাকেও এভাবে বস্তা নিয়ে ঘুরতে হয়েছে দীর্ঘ গ্রামীণ পথ, মাইলের পর মাইল। কখনো ইচ্ছায় কখনো অনিচ্ছায়, মাদরাসার কানুন তো, যেতেই হতো। মানুষের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ধান বা চাল চাইতে লজ্জা হতো ভীষণ, কিন্তু উপায় তো নেই। ট্র্যাডিশন ইজ ট্র্যাডিশন!
নিজের কথা বাদ রাখি। বাচ্চা তিনটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালেকশনে এসেছো?’
‘জি।’
‘কোন মাদরাসায় পড়ো?’
‘গণকপাড়া মাদারসায়।’ একজন পাশে রাখা প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে একটা লিফলেট বের করে দিলো।
মাদরাসায় কয়েকদিন পর মাহফিল, তারা মাহফিল উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে চাল কালেকশনে বেরিয়েছে।
‘সেই গণকপাড়া থেকে হাইটা আসছো?’
‘না, কিছু দূর অটোতে আসছি, তারপর বান্নাখোলা থেকে হাইটা আসছি।’ সেও প্রায় মাইল তিন-চারের দূরত্বে। সেখান থেকে কালেকশন করতে করতে এসেছে এ গ্রামে।
‘কয়টার সময় বের হইছো?’
‘সকাল নয়টার দিকে।’
‘দুপুরে কী খাইছো?’
‘একেকজনরে পনেরো টাকা কইরা দিছিলো, ওইটা দিয়া বনরুটি আর ইডা-উডা খাইলাম।’
‘চাইল তুলছো কতোডি?’
‘বেশি উঠে নাই, মাইনষে চাইল দ্যায় না!’ বলেই একজন পাশে রাখা বস্তাটা তুলে ধরলো। বড়জোর কেজি চারেক চাল হবে বস্তায়।
চার কেজি চালের জন্য বিস্তর লম্বা সফর, ক্লান্তিহীন নতজানু পথচলা। পনেরো টাকা লাঞ্চের দেনা মিটিয়ে বাচ্চা তিনটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। অনিচ্ছার পায়দল হাঁটা, চলে যাচ্ছে কাঁধে বস্তার জগদ্দল উঠিয়ে। তিনটে নিষ্পাপ ফুল ফুটফুটে বাচ্চার দিকে আমি সকরুণ তাকিয়ে রইলাম।
দুই
মাদরাসার প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, সভাপতি, অভিভাবকদের কাছে আমার প্রশ্ন- এভাবে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য কি এ বাচ্চাদের মাদরাসায় পড়ানো হয়? হাতে ভিক্ষার বস্তা ধরিয়ে দিয়ে একটা ছেলেকে কীভাবে জগদ্বিখ্যাত হাফেজ-আলেম বানাবেন আপনারা?
কীভাবে আগামী পৃথিবীর জন্য তাকে ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করবেন আপনারা? ‘কালেকশন’ নামের ভিক্ষার বস্তা কাঁধে তুলে দিয়ে একটা বাচ্চার শৈশবকে আপনারা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছেন। তার ভেতরে সুপ্ত থাকা প্রবল ব্যক্তিত্ববান আলেম শিশুটিকে দলে-পিষে একাকার করে দিচ্ছেন মাটির সঙ্গে।
‘কালেকশন’ নামের ভিক্ষা-সংস্কৃতির মাধ্যমে তাকে শিক্ষা দিচ্ছেন-তোমাকে সারাজীবন অন্যের দয়াগ্রহণ করেই বেঁচে থাকতে হবে। যাও, হাত পাতো মানুষের দ্বারে দ্বারে! এটাই নবির শিক্ষা? এটাই ইলমে নববি অর্জনের সঠিক পন্থা?
এই তো মাসখানেক আগে আমাদের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো দুটি মাদরাসাছাত্র। বস্তা হাতে মাদরাসার জন্য কালেকশনে এসেছে। বয়স ওদের মতোই, আট-দশ। দুজনই ক্লান্ত। একজন ক্লান্তিতে হাতের বস্তা উঠোনে রেখে সেখানেই বসে পড়লো। দেখে আমার বুকটা হু হু করে ওঠলো।
মনে পড়ে গেলো নিজের শৈশব। ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, ‘দোকান থেকে কিছু খেয়ে নিও। আর তোমাদের হুজুরকে গিয়ে বইলো, এভাবে ছাত্রদের দিয়ে কালেকশন করা না জায়েজ!’
কিছুদিন আগে এমন দুটো বাচ্চাকে দেখলাম হাটের মাঝে মাহফিলের লিফলেট বিলি করছে আর হাটুরে লোকদের কাছে মাদরাসার জন্য চাঁদা চাচ্ছে। যার ইচ্ছা দু-পাঁচ টাকা দিচ্ছে, অনেকেই ধমক দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ বদরাগি আচরণও করছে ছেলে দুটোর সঙ্গে। কী করুণ অবস্থা!
ছেলেটার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে কোনো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। নিষ্পাপ একটা চেহারা। নিজের মা-বাবা হয়তো জীবনে কখনো উঁচু গলায় তার সঙ্গে কথাও বলেনি। এখনও বোন হয়তো তাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেয়। খাওয়ার সময় মাছের বড় টুকরোটা মা ছেলের জন্য রেখে দেন সযতনে।
বাড়িতে হয়তো তার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে কয়েক জোড়া অশ্রুসজল চোখ। অথচ এই ছেলেটাকে দিয়েই আপনারা হাটের মাঝে শত শত লোকের সামনে কালেকশনের নাম করে ভিক্ষা করাচ্ছেন। এ কেমন মানবিকতা শেখাচ্ছেন তালিবুল ইলমদের?
আপনারাই তাদের শেখান- তালিবুল ইলম পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম মানুষ, ফেরেশতারা তাদের চলার পথে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেয়; অথচ আপনারাই তাদের পাঠান মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কালেকশন করতে।
এটা কোন ধরনের সম্মানদান হলো? আপনি নিজেই যদি নিজের ছাত্রদের সম্মান দিতে না শেখেন, সাধারণ মানুষ কীভাবে তাদের সম্মান দেবে?
তিন
কোন অধিকারে আপনারা এই মাসুম বাচ্চাদের এভাবে মানুষের দ্বারে দ্বারে পাঠাচ্ছেন? কেন তাদের মানুষের দয়ায় বাঁচতে শেখাচ্ছেন? তারা গরিব বলে? তারা মা-বাবা, ভাই-বোন সকল আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে আপনাদের কাছে নিজেদের সঁপে দিয়েছে বলেই আপনারা তাদের সকল কিছুর মালিক হয়ে গেছেন?
তারা আপনার মাদরাসার কেনা গোলাম? ক্রীতদাস? হ্যাঁ, আপনি তাকে শিক্ষাদান করেন, সে আপনার বাধ্যগত সন্তানের মতো। শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে মানবিক যেকোনো শাসন-অনুশাসনগত আচরণ আপনি তার সঙ্গে করতে পারেন। কিন্তু আপনার মাদরাসার মাহফিলের খরচ সে কেন ভিক্ষা করে তুলতে যাবে?
এ ছাত্রদের অভিভাবকরা পড়াশোনা করার জন্য তাদের সন্তানদের মাদরাসায় দিয়েছেন। ভিক্ষাবৃত্তি করে মাদরাসা চালানোর দায়িত্ব তো তাদের নয়। আপনি মাদরাসার সভাপতি-প্রিন্সিপ্যাল-শিক্ষক, মাদরাসা কীভাবে চালাবেন সেটা আপনার দেখার দায়িত্ব। ছাত্রদের দিয়ে ভিক্ষা করাবেন কোন অধিকারে?
মাদরাসা যদি না চালাতে পারেন তবে সেটা আপনার ব্যর্থতা। আপনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন কিংবা মাদরাসার প্রিন্সিপাল হয়েছেন, কিন্তু আয়ের নির্দিষ্ট কোনো বন্দোবস্ত কেন করেননি? নিজের ব্যর্থতার দায়ভার এই কোমলমতি শিশুদের ঘাড়ে কোন অধিকারে তুলে দিচ্ছেন?
যারা এসব বাচ্চা ছেলেদের শৈশবের উচ্ছ্বলতাকে ভিক্ষার ঝুলি দিয়ে হত্যা করছেন, কী জবাব দেবেন আপনারা আল্লাহর কাছে? তারা আপনাদের কাছে খোদার কালাম শিখতে আসে, মানুষের তাচ্ছিল্য আর দয়ার দান খেয়ে বাঁচতে আসে নাই।
মাদরাসার উন্নয়নের নামে কালেকশন করে তাদের আপনারা মানুষের কাছে হাত পাততে শেখাচ্ছেন। অন্যের সামনে কীভাবে নতজানু হয়ে থাকতে হয়, সে বিদ্যা শেখাচ্ছেন। বিত্তবান লোকের সামনে কীভাবে ভিক্ষা মাগতে হয়, শেখাচ্ছেন সেই অশ্রাব্য শিক্ষা।
এই ছেলেটি কালেকশন করতে করতে যখন আলেম হবে, তখন তার কাজই হবে মানুষের দয়া ভিক্ষা করে জীবন চালানো। কিন্তু ক’জন আলেম এমন অন্যের দয়ায় বাঁচতে চান? প্রতিজন মাদরাসাছাত্রের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করুন, সে সত্যিকারার্থে এই কালেকশন নামের ভিক্ষাবৃত্তিতে খুশি কি-না।
একজনকেও পাবেন না কালেকশনের ব্যাপারে সুমতি প্রকাশ করতে। কে চায় আল্লাহর নাম নিয়ে মানুষের দ্বারে ভিক্ষা করতে? এ কোনো পুণ্যের কাজ কখনো? এ কোনো সম্মানের কাজ কোথাও?
চার
আকাবিরের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করবেন না। হোসাইন আহমদ মাদানি রহ. আর থানভি রহ. যদি বাংলাদেশের মাদরাসাওয়ালাদের এমন ভিক্ষাবৃত্তির অঢেল উদারতা দেখতেন, তবে ঝেঁটিয়ে থানাভবন আর দেওবন্দ থেকে বের করে দিতেন আপনাদের।
শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. যে আত্মমর্যাদাশীল মানুষ ছিলেন, তাঁর সামনে সরকারপ্রধান পর্যন্ত কথা বলতে ভয় পেতেন। তাঁরা এমনি এমনি যুগের নকিব হননি। নিজেদের আত্মমর্যাদা তাঁরা বিত্তবানদের পকেটের টাকায় বিকিয়ে দেননি কখনো।
উসুলে হাশতেগানার দোহাই দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করবেন না। উসুলে হাশতেগানা কোনো কুরআন-হাদিস নয় যে সেটাকে পরিবর্তন করা যাবে না। সময় আর যুগচাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন হতে পারলে একটা শিক্ষাব্যবস্থা কেন দেড়শো বছরের পুরোনো কারিকুলাম পরিবর্তম করতে পারবে না?
দেড়শো বছর আগের ইংরেজশাসিত ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের সমাজ-পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিকতা দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা ও ইসলামি শিক্ষা কারিকুলামের সাফাই গাওয়া হাস্যকরই বটে।
আগে নিজেরা পরিবর্তন হোন, উসুলে হাশতেগানার দোহাই দেয়ার প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশের অনেক মাদরাসা মানুষের দুই টাকা দান-খয়রাত ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে। তারা পারলে আর সবাই কেন পারবে না? যোগ্য নেতৃত্ব ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব।
অনেকে বলবেন, গ্রামের মাদরাসাগুলো কালেকশন ছাড়া চালানো সম্ভব নয়।
এসব বকওয়াজ ওয়াজ এবার বন্ধ করুন! কেন কালেকশন ছাড়া মাদরাসা চালানো সম্ভব নয়? মহিলা মাদরাসাগুলো কীভাবে চলছে? মহিলা মাদরাসার ছাত্রীরা তো কালেকশন করে না। সেখানকার সকল ছাত্রী তাদের অভিভাকদের টাকায় পড়াশোনা করছে। সেসব মাদরাসার জন্য হাটে-গ্রামে কালেকশনের প্রয়োজনও হয় না।
তবুও বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় অসংখ্য মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এবং সেগুলো খুব ভালোভাবে চলছে। শুধু চলছে তাই নয়, ছেলেদের কওমি মাদরাসার চেয়ে মহিলা কওমি মাদরাসার পরিচালনা আরও সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে।
যদি নিয়তই করে থাকেন কালেকশন করে মাদরাসা চালাবেন, তাহলে আগে এই চিন্তা পরিহার করুন। দিন এখন আর সে জায়গায় নেই।
মহিলা মাদরাসা চলতে পারলে ছেলেদের কওমি মাদরাসা কেন চলতে পারবে না? বাংলাদেশে এখন এমন ফ্যামিলি খুব কমই আছে যে ফ্যামিলির একটা ছেলে মাদরাসায় পড়াকালীন মাসিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা মাদরাসার বেতন ও বোর্ডিং খরচ বাবদ দিতে পারবে না।
যারা নিতান্তই দরিদ্র, তাদের জন্য মাদরাসার গোরাবা ফান্ড থাকতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, অধিকাংশ মাদরাসারই ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ছাত্র মাসিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা দেয়ার মতো সচ্ছল। যাদের সচ্ছলতা থাকার পরও ফ্রি বেতন ও ফ্রি খানায় মাদরাসায় পড়াশোনা করছেন, এটা সর্বোতভাবে অনুচিত কাজ।
কখনো কখনো এটা গোনাহর পর্যায়ে পড়ে যায়। আত্মমর্যাদা বলে যে জিনিসটা আছে, সেটা তখনই তৈরি হয় যখন নিজে নিজের মর্যাদার ব্যাপারে সম্যক ওয়াকিফহাল হবেন। অন্যেরা এসে আপনা মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করবে না। আপনার মর্যাদা আপনাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
লেখক: তরুণ আলেম, কবি ও কথাসাহিত্যিক