পলাশ রহমান
ইতালি থেকে
মার্কিন সরকার ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের প্রথম কিবলা’র শহর জেরুসালেমকে এক তরফা এবং অবৈধভাবে হানাদার ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে গোটা দুনিয়া অস্থির করে তুলেছেন। কেনো তিনি এই অবিবেচক কাজটি করতে গেলেন? মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব থেকে, নাকি কথিত ২০ মিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার পূরণ করলেন?
সমালোচকরা বলাবলি করছে, বাংলাদেশের সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে, আর আমেরিকা সব সময় ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় উচাটন থাকে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবিবেচক এবং অবৈধ সিদ্ধান্তের কারণে যখন গোটা দুনিয়া অস্থির, বিশেষ করে আরব বিশ্ব ফুসে উঠেছে ঠিক তখনি আমরা দেখলাম নিউইয়ার্কের ম্যানহাটনে বোমা বিস্ফোরণে একজন বাংলাদেশি অভিবাসী আহত হলেন। মুহূর্তের মধ্যে গোটা দুনিয়ায় হৈহৈ পড়ে গেলো। সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরনামে উঠে এলেন কথিত বোমা হামলাকারী আকায়েদ উল্লাহ।
আকায়েদ সাত বছর আগে আমেরিকার অভিবাসন গ্রহণ করেন। তিনি চেইন মাইগ্রেশনের আওতায় এফ- ৪ ভিসায় মার্কিন অভিবাসী হন। সেখানে তিনি ট্যাক্সি ড্রাইভসহ বিভিন্ন সাধারণ কাজ করে জীবন নির্বাহ করতেন।
হঠাৎ করে খবর বের হলো তিনি শরীরে বোমা বেঁধে ম্যানহাটনে গিয়েছিলেন হামলা চালাতে। কিন্তু হামলা চালাতে পারেন নি। হামলার আগেই তার শরীরে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে যায়। এতে তিনি হালকা আহত হন। শরীরের কিছুটা চামড়া পুড়ে যায়।
প্রথামবস্থায় এই ঘটনাকে বিশ্ব মিডিয়াগুলো বেশ হাক-ডাক করে প্রচার শুরু করে। তারা বোঝাতে চায় আকায়েদ বোমাটা ফাঁটাতে পারলে ব্যাপক ক্ষতি হতো। বহু মানুষ মারা যেতো। মিডিয়ার এই প্রচারে প্রশ্ন উঠলো- এত শক্তিশালী বোমা আকায়েদের শরীরে বাঁধা অবস্থায় বিস্ফোরণ হলো অথচ তার তেমন কিছু হলো না কেনো? শরীরের কিছুটা চামড়া পুড়ে গেলো, এ কেমন তরো শক্তিশালী বোমা?
এর পর প্রচার শুরু হলো বোমাটা আকায়েদের নিজের বানানো নিম্নমানের বোমা ছিল। প্রশ্ন উঠলো- নিজের জীবনের বীনিময়ে হামলা চালাতে যাওয়া একজন মানুষ এত নিম্নমানের বোমা নিয়ে কেনো গেলেন, যা তার শরীরের সামান্য চামড়া পোড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারে না?
প্রচার করা হলো- আকায়েদ আইএস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। হতেই পারেন। পৃথিবীর যে কোনো মানুষ যে কেউ বা যে কোনো গোষ্ঠি দারা প্রভাবিত হতে পারে। মানুষ যেমন ভালো কাজের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, অন্যায় কাজের প্রতিও কখনো-সখনো ঝুঁকে পড়ে। তবে অন্যায় কাজে ঝোকা বা জড়িয়ে পড়ার পেছনে অনেক কারণ থাকে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষ যখন ক্ষুব্ধ হয়, অত্যাচারিত হয়, অধিকার বঞ্চিত হয় তখন অন্যায় কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। আকায়েদের ক্ষেত্রেও কী এমন কিছু ঘটেছে? সে উত্তরে যাওয়ার আগে আমরা এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া একটু দেখে নিতে চাই।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘটনায় তার লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহজ অভিবাসন নীতির কারণে এসব ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি অভিবাসন নীতিতে আরো কাড়াকড়ি আরোপের কথা উল্লেখ করে বলেন, অন্য দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে আইন আরো বেশি কড়াকড়ি করতে হবে। বিশেষ করে তিনি মুসলিম প্রধান দেশগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে বর্তমানের ঢিলেঢালা অভিবাসন নীতি কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পর বিশ্লেষকরা একটু নড়ে-চড়ে বসেছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন- তবে কী 'আকায়েদের বোমা হামলা' সাজানো নাটক ছিল? ট্রাম্প প্রশাসন সে দেশের অভিবাসন আইন পরিবর্তনের জন্য এই নাটক সাজিয়েছে?
মার্কিন জনগণকে অভিবাসন আইনে কড়াকড়ি আরপের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে এটা করা হয়েছে? নাকি জেরুসালেম থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য এই নাটক সাজানো হয়েছে?
আমরা জানি মার্কিন প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে মানুষকে অন্যায়ের প্রতি প্রলুব্ধ করে। তারা যুবকদের ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অন্যায়ের জাল পাতে। কোনো কোনো বিক্ষুব্ধ যুবক তাদের সেই জালে জড়িয়ে পড়ে। আমরা অতীতে এর অনেক প্রমাণ দেখেছি।
মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশি যুবককে নকল বোমা দিয়ে হামলা করতে পাঠানোর নজিরও আমরা দেখেছি। যা কোনোভাবেই মানবিক দৃষ্টিতে বৈধ হয় না, হতে পারে না। কাউকে ফাঁদে ফেলে অপরাধী সাজানো কোনো সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না।
আমরা জানি না আকায়েদের বেলায় এমন কিছু ঘটেছে কি না? যদি ঘটে তা হবে চরম দুঃখজনক। আর যদি আকায়েদ নিজে থেকে এমন একটি অপকর্ম করতে গিয়ে থাকে তবে তার যথাযথ বিচার হওয়া উচিৎ। যারা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের দিকে বা বাংলাদেশি অভিবাসীদের দিকে আঙ্গুল তুলছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি-
বাংলাদেশে থাকতে আকায়েদরা বোমাবাজ ছিলেন না। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়ান নি। তারা কথিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়েছেন বা জড়িয়ে পড়ছেন আমেরিকায় গিয়ে।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো গোটা দুনিয়া থেকে লাখ লাখ আকায়েদ আমেরিকার মতো উন্নত দেশে যান একটা নিশ্চিৎ জীবনের জন্য। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য। সন্ত্রাসী বোমাবাজ হওয়ার জন্য কেউ প্রবাসী হন না। নিজ দেশের অভাব-অনাটন, দূর্নীতি, সামাজিক বৈসম্য থেকে মুক্তি পেতে মানুষ অভিবাসন গ্রহণ করেন। আকায়েদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না।
কিন্তু সে কেনো নিজের শরীরে বোমা বাঁধতে গেলেন? তাহলে কী আমেরিকাই তাকে বিক্ষুব্ধ করেছে? অপকর্মের পথে ঠেলে দিয়েছে? সেখানে কী আকায়েদরা এমন কোনো বৈসম্যের মুখোমুখি হন যা তাদেরকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে উস্কানী দেয়?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি, আমেরিকাসহ উন্নত অনেক দেশ নিজেদের আধিপত্ত বিস্তার, ব্যবসা এবং ধর্ম বিদ্বেষের কারণে অনেক দেশ, অনেক জনপদে হামলা করে। মানবতা গুড়িয়ে দেয়। মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে। সর্বশেষ তারা বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় তীর্থের দিকে হাত বাড়িয়েছে। যা মানুষকে চরম মাত্রায় বিক্ষুদ্ধ করেছে। এমতাবস্থায় যে কোনো মুসলিম যুবক ভাবতেই পারে- এখনই যদি আমেরিকাকে প্রতিউত্তর দেয়া না হয় তবে তারা আগামীতে মক্কা-মদীনার দিকে হাত বাড়াবে।
এই বিশ্বাস থেকে যদি কেউ বিক্ষুব্ধ হয়, বোমাবাজ হয় এর দায় আমেরিকা বা তার মতো দেশগুলোকেই নিতে হবে। তারাই মানুষকে উস্কানি দেয়, বিক্ষুব্ধ করে, সন্ত্রাস করতে বাধ্য করে। সুতরাং আমেরিকার সৃষ্টি আকায়েদদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে আমেরিকাকেই সংযত হতে হবে। বিশ্বজুড়ে আমেরিকান সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় এর সকল দায় তাদেরকেই বহন করতে হবে।
লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি
ফাঁস হচ্ছে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদের দুর্নীতির ইতিহাস