এইচ এম মাহমুদ হাসান সিরাজী
অতিথি লেখক
আমি এ দেশে জন্মেছি। জন্মসূত্রে আমি এ দেশের একজন নাগরিক। এ দেশের হাওয়া বাতাস খেয়েই আমি বড় হয়েছি। এ দেশের কালচারে আমি বেড়ে উঠেছি। তাই তো এদেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এদেশের পতাকাকে ভালোবাসি।এ দেশের মানচিত্রকে ভালোবাসি।
আমার এ ভালবাসার মাঝে কোনো ভেজাল নেই। নির্ভেজাল দেশপ্রেম নিয়েই আমাদের বেড়ে উঠা। ফলে দেশের সুসময়ে যেমন আনন্দিত হই তেমনি দেশের ক্লান্তিকালেও অনেক ব্যথিত হই।
আজ আমার দেশের মহান বিজয় দিবস। গোটা দেশে বিজয় দিবসের উৎসব পালিত হচ্ছে। আমরা যারা বিজয় দিবসটি স্বচক্ষে দেখিনি তারাও বিজয় উৎসব পালন করছি। আমরা দিবসটি নিয়ে খুব গর্ব করি।
আমরা একটা সময় পরাধিন ছিলাম। প্রথম স্বাধিনতা পেয়ে ছিলাম ৪৭ এ। তবে সে স্বাধিনতার স্বাদ আমরা বেশি দিন ভোগ করতে পারিনি। আর স্বাধিনতাটাও ঐভাবে আসেনি। ঐ সময় মানচিত্রের স্বাধিনতা পেলেও প্রকৃত স্বাধিনতা পাইনি।
দুইশত বসরের গোলামির শৃকল থেকে বাহ্যিক মুক্তি পেলেও কালচারালভাবে এখনো সে পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছি। পাশ্চাত্যরীতি আর কালচার আমাদের সমাজ- সভ্যতায় যে আঘাত করেছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া আমাদের প্রজন্মের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়।
আমাদের নিজস্ব ভাষা আর ভাবসম্প্রসারণের পদ্ধতি থাকলেও নিজস্ব ভাষা বাদ দিয়ে বিদেশি ভাষায় কথা বলা বা ভাবসম্প্রসারণকেই আমাদের স্ট্যাটাস বানিয়ে নিয়েছি।
কেন আমাদের ভাষা কি সংকীর্ণ? এ ভাষায় কি ভাবসম্প্রসারণ সম্ভব নয়? এ ভাষার মাঝে কি কোনো মায়া নেই? এ ভাষার কোনো ব্যাপকতা নেই?
তাহলে আজ মহান বিজয় দিবসের প্যারেডির ধারা ভাষ্যেও কেন বিদেশি ভাষার সাহায্য নিতে হবে? বিজয় দিবসের এ লেখা যখন লিখছি তখনো কেন মিশ্র ভাষার আশ্রয় নেওয়া উপস্থাপিকার ধারা ভাষ্য শুনতে হবে?
এ প্রশ্নগুলো আমাদেরকে যেমন বিব্রত করে তেমনি অনেক সময় লজ্জিতও করে।
আমার দেশের প্রতি যেমন ভালবাসা রয়েছে তেমনি ভাষার প্রতিও ভালবাসা থাকতে হবে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় নির্মমতা থেকেই কিন্তু স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। ভাষা আন্দোলনের নায়কদের হাত ধরেই কিন্তু ৭১ এর সুচনা হয়ে ছিল। ভাষার নামের সাথে দেশের নামেরও কিন্তু বিশ্বব্যাপী একমাত্র দৃষ্টান্ত আমার এ দেশ।
তাই বিজয়ের এই দিনে ভাষার প্রতি, পতাকার প্রতি ও মানচিত্রেরর প্রতিও আমাদের সমান ভালবাসা থাকতে হবে।
আমি অনেক আরবী ফার্সী জানি। তাই বলে আমার মায়ের ভাষার সাথে তার সংমিশ্রন ঘটাতে হবে? ১৬ ডিসেম্বর জানি। অথচ ২ রা পৌষ জানি না। ২৬ ই মার্চ জানি। অথচ ১২ চৈত্র জানি না। ২১ ফেব্রুয়ারী জানি কিন্তু ৯ ই ফাল্গুন জানি না।
অন্য ভাষার দাসত্ব আমাকে গোলাম বানিয়ে রাখছে অথচ আমি এখনো চেতনা ব্যবসায় নিমগ্ন। আমার সাথে নাচতে পারলে, আমার কথা শুনতে পারলে কিংবা আমার মতাদর্শ বিশ্বাস করলেই আমি তাকে চেতনার সার্টিফিকেট দিয়ে দেশ প্রেমিক বানিয়ে দেই।
আমাদের আগে দেশপ্রেমের জায়গাটা বুঝতে হবে। দেশপ্রেম শিখতে হবে। দেশের তরে যারা জিবন বিলিয়ে দিয়েছে তাদের চিনতে হবে। তাদেরকে সেভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে। তাদের বিরত্বগাথা ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হবে।
বিজয় দিবসে আজ তাদের অনুভূতিগুলো তাদের ভাষায় আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে।
যাদের হাত দিয়ে এ বিজয় অর্জিত হল তারাই মুলত আমাদের নায়ক।তাদের কাছে আমরা ঋনি।
কত লক্ষ শহীদের বিনিময় আমরা এ স্বাধিনতা পেলাম তা রাজনৈতিক বিতর্কিত ইস্যু হলেও সংখ্যাটা যে বিশাল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।এদেশের নাগরিকদের বিশাল একটা অংশের কেরবানীর মধ্য দিয়েই আমরা এ জয় অর্জন করেছি।
আজ এ মহান দিবসে তারা আমাদের থেকে কি পাচ্ছেন আর কি পাচ্ছেন না এর একটা হিসাব আমাদের কষে বের করতে হবে।
তারা আমাদের জন্য যা করে গেছেন এর বিনিময় আমরা তাদের কি দিতে পারছি এটাও ভাবনা বহির্ভূত বিষয় নয়।
বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসা করে যাদের পেট চালাতে হয় তারাও হিসাবটা জেনে রাখা ভাল। ধর্মনিরপেক্ষতার জিকির তুলে দেশটাকে যারা কলুষিত করে বেড়াচ্ছে তাদের এসব ইতিহাস জেনে রাখা প্রয়োজন।
আমি বঙ্গবীর কাদের ছিদ্দিকীর একটি প্রবন্ধ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পদকধারীদের একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরছি।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য সর্বমোট ৬৭৬ জন চার স্তরের সম্মামনা পদক পেয়েছিলেন।
১ ম স্তরে ৭ জনকে বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেওয়া হয়। এদের সবায় মুসলমান ছিলেন। ২ য় স্তরে বীর উত্তম পদক দেওয়া হয় ৬৮ জনকে। তাদের মধ্যে ৬৭ জন মুসলমান। মাত্র ১জন ছিলেন হিন্দু।
৩ য় স্তরে ১৭৫ জনকে বীর বিক্রম পদক দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১৭২ জনই ছিলেন মুসলমান। আর মাত্র৩ জন ছিলেন হিন্দু।
৪ র্থ স্তরে বীর প্রতিক সম্মামনা পদক দেওয়া হয় ৪২৬ জনকে। তাদের মধ্যে মুসলমানই ছিলেন ৪২২ জন। তিন জন মাত্র ছিলেন হিন্দু। আর একজন বিদেশী এক খৃস্টান ছিলেন।
চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেল, ৬৭৬ জন পদক প্রাপ্তদের মধ্যে ৬৬৮ জন ছিলেন মুসলমান। আর মাত্র ৮ জন ছিল মুসলমানদের বাইরে।
তবে আফসোস আর পরিতাপের ব্যাপার হল, কোন নাস্তিক কিন্তু পদক পায় নি। আর তাদের কে কে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সেটাও জানা যায় নি।
এখন বলুন, মুক্তিযুদ্ধে কারা এগিয়ে? স্বাধীনতা এটা কাদের অবদান? কাদের সার্থে কারা স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল?
আজ আমি মহান বিজয়ের এ দিবসে পরলোকগত মুক্তিযুদ্ধাদের রুহের মাগফিরাত আর বেঁচে থাকা যুদ্ধাহতদের দীর্ঘজীবন কামনায় খতমে কুরআন আর বিশেষ দোয়ার আয়োজন করেছি।
আমি জানি এবং বিশ্বাস করি ফুল দেওয়ার চেয়ে আমার এ উদ্যোগ অনেক উত্তম হবে।
সবশেষে সবাইকে নিয়ে সুন্দর একটা দেশ গড়তে চাই। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবায় এক পতাকার তলে এক মানচিত্র আকড়ে ধরে থাকতে চাই।
কারণ দেশটাকে অনেক ভালোবাসি। দেশবাসীকে নিয়ে অনেক ভাবি। দেশের ও দশের প্রতি এ ভালবাসা আমৃত্যু অটুট ও দৃঢ় থাকুক।
লেখক: প্রিন্সিপাল, জামিয়া ওসমান ইবনে আফফান রা.