আওয়ার ইসলাম: তিনি গুজরাতের ভূমিপুত্র। তিনি আজ দেশের শাসক। গুজরাত থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর জয়যাত্রা। ঘরের মাটিতে ফিরে সেই জয়কে ধরে রাখা আজ বড় চ্যালেঞ্জ নরেন্দ্র মোদীর জন্য।
আর অন্য জন গত ছ’মাস ধরে গুজরাতের মাটি কামড়ে লড়াই দিলেন। এটাই প্রথম নির্বাচনী লড়াই, যেখানে সনিয়া গাঁধীকে একেবারেই পেলেন না তিনি। এটাই প্রথম নির্বাচনী লড়াই, কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে যাঁর মুখোমুখি হলেন তিনি। গুজরাতে জয় পাওয়া খুব বড় চ্যালেঞ্জ রাহুল গাঁধীর কাছে।
আসলে ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ বা ‘খুব বড় চ্যালেঞ্জ’ বললে পরিস্থিতির গুরুত্ব ঠিক বোঝা যায় না। গুজরাতের নির্বাচন হল অগ্নিপরীক্ষা— নরেন্দ্র মোদীর জন্যও, রাহুল গাঁধীর জন্যও।
গুজরাত থেকেই উত্থান মোদীর। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদ দীর্ঘ দিন নিজের দখলে রাখার সুবাদেই প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হয়ে উঠেছিলেন মোদী। ‘গুজরাত মডেল’ নামে এক উন্নয়নী মডেলের স্বপ্ন গোটা দেশকে দেখিয়ে দেশের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয় হাসিল করেছিলেন মোদী। গুজরাতের ঘাঁটি অক্ষুণ্ণ রাখা তাই অসীম গুরুত্বপূর্ণ নরেন্দ্র মোদীর জন্য।
মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশের নানা প্রান্তে বিধানসভা নির্বাচনের মুখোমুখি ইতিমধ্যেই হয়েছে বিজেপি। অধিকাংশ নির্বাচনেই বিজেপি সাফল্যের মুখ দেখেছে। সেই প্রতিটি নির্বাচনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল মোদীর জন্য সংশয় নেই। কিন্তু গুজরাত হল মোদীর যাবতীয় সাফল্যের ভরকেন্দ্র। গুজরাত হল মোদীর রাজনীতির প্রাণভোমরা।
গুজরাতে বিজেপি-র পরাজয়ের অর্থ হল মোদীর দেখানো স্বপ্নের পরাজয়। তাই গুজরাত হাতে রাখা অপরিহার্য মোদীর জন্য। পাটিদার বিক্ষোভ, সংখ্যালঘুর উষ্মা, দলিত ও অনগ্রসরদের অসন্তোষ, কর্মসংস্থানহীন যুব সম্প্রদায়ের মোহভঙ্গ, নোটবন্দি-জিএসটির ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়া ব্যবসায়ীদের রোষানল— এ বারের নির্বাচনে এতগুলি নেতির মুখোমুখি গুজরাতের বিজেপি সরকার।
এত কিছু সামলে শাসন ক্ষমতার উপর দীর্ঘ দু’দশকের দখল বহাল রাখা একেবারেই সহজ কথা নয়। কিন্তু হারের মুখ দেখতে হলে আরও কঠিন পরিস্থিতি বিজেপি-র অপেক্ষায় থাকবে গোটা দেশে। তাই যে কোনও মূল্যে গুজরাত ধরে রাখা মোদীর জন্য অপরিহার্য।
অন্য দিকে, ‘গুজরাত মডেল’-এর কাছেই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছে কংগ্রেস। ওই উন্নয়নী মডেলের স্বপ্ন দেশ জুড়ে চারিয়ে গিয়েছিল বলেই দিল্লির মসনদ থেকে খুব তিক্ত ভাবে বিদায় নিতে হয়েছে কংগ্রেসকে। মোদীর বা বিজেপির সেই মডেলকে অসার প্রমাণ করা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেসের জন্য।
গুজরাত মডেলের স্বপ্ন ফেরি করে ২০১৪ সালে কংগ্রেসকে ছুড়ে ফেললেন যিনি, সেই মোদীর রাজত্বে ক্রমশ আরও পর্যুদস্ত হয়েছে কংগ্রেস। দেশের নানা প্রান্তে একের পর এক নির্বাচনে কংগ্রেস বিপর্যস্ত হয়েছে। যদি ঘুরে দাঁড়াতে হয় এই অবস্থা থেকে, তা হলে মোদীর নিজের দুর্গেই সর্বাগ্রে হানাটা দিতে হবে, মোদীর নিজের ঘাঁটিটাই ধসিয়ে দিতে হবে সর্বাগ্রে, বুঝেছেন রাহুল গাঁধী।
নিজের রাজনৈতিক যাত্রাপথটার স্বার্থেও যে গুজরাতে জয়টা খুব জরুরি, তাও রাহুল গাঁধী জানেন। রাহুলের কৃতিত্বে কংগ্রেস খুব বড় সাফল্য পেয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। তথাপি কালের নিয়মে সনিয়া গাঁধী সরে গিয়েছেন কংগ্রেসের শীর্ষপদ থেকে, রাহুলের অভিষেক হয়েছে সভাপতিত্বে।
গুজরাতের নির্বাচনী প্রচারেও একেবারেই সামিল হননি সনিয়া। কংগ্রেসের এক এবং একমাত্র মুখ হিসেবে গুজরাত চষে ফেলেছেন রাহুল। গুজরাতে সাফল্য বা ব্যর্থতার কৃতিত্ব বা দায় তাই রাহুল গাঁধীরই হবে। বলাই বাহুল্য, নিজের রাজনৈতিক যাত্রাপথে একটা খুব বড় মোড় খুঁজছেন রাহুল মরিয়া হয়ে এখন।
সেই মোড়টা তিনি পেয়ে গেলেই বদলে যাবে জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও, সম্ভবত এমনও আশা করছেন রাহুল। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে যখন রাহুল নতুন ইনিংস শুরু করছেন, ঠিক তখনই সেই মোড়টা আসা জরুরি।
যে গুজরাত থেকে ছুটতে শুরু করেছিল মোদীর অশ্বমেধের ঘোড়া, সেই গুজরাতে ঢুকেই ঘোড়াটার রাশ টেনে ধরলেন তিনি, এমন একটা ছবি তৈরি করা রাহুল গাঁধীর জন্য এখন অত্যন্ত জরুরি। যদি সফল হন, সামনের দিন উজ্জ্বল। আর ব্যর্থতা আরও অন্ধকারে ঠেলে দেবে রাহুলকে এবং কংগ্রেসকে।
গুজরাতের এই নির্বাচন তাই সব অর্থেই অগ্নিপরীক্ষা। আবার বলি, এই নির্বাচন নরেন্দ্র মোদীর জন্য অগ্নিপরীক্ষা, রাহুল গাঁধীর জন্যও অগ্নিপরীক্ষা। কে শেষ পর্যন্ত উতরে যেতে পারছেন সে পরীক্ষায়? উত্তরের অপেক্ষায় সমগ্র ভারত।
আনন্দবাজার পত্রিকা/এইচজে