আওয়ার ইসলাম: ওয়াজ মাহফিল বাংলাদেশি মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির জায়গা৷ শীতের মওসুমে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন৷
সাধারণ মুসলিম যারা কুরআন হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না তারা এসব ওয়াজ মাহফিল থেকে ইসলামি জীবন পরিচালনার দিক নির্দেশনা পেয়ে থাকেন৷ অগণিত মানুষ নিয়মিত নামাজি, মুত্তাকি হয়ে ওঠেন৷
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়ায়েজদের সড়ক দুর্ঘটনা, ডাকাতি, দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার ও কয়েকটি জায়গায় হেনস্তার ঘটনারও খবর পাওয়া গেছে৷ এসব বিষয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের নন্দিত ওয়ায়েজ ও ঢাকার যাত্রাবাড়ীর মারকাযুত তাকওয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি হাবিবুর রহমান মিছবাহ (কুয়াকাটা৷)
সাক্ষাতকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের সাব এডিটর হাওলাদার জহিরুল ইসলাম।
আওয়ার ইসলাম : সম্প্রতি মাহফিল থেকে ফেরার পথে রাতে ওয়ায়েজরা ডাকাতি ও হামলার শিকার হচ্ছেন, এরকম ঘটনার সম্মুখিন হয়েছেন আপনি?
মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ : হ্যাঁ, আমি কয়েকবার ডাকাতি ও হামলার সম্মুখিন হয়েছি৷ তবে শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতি হইনি৷
একবার কুমিল্লার হোমনায় একটি ডাকাত দল আমাদের গাড়ি টার্গেট করেছিলো৷ তখন আমরা দ্রুত রাস্তা পরিবর্তন করে চলে আসতে সক্ষম হই৷ আরেক জায়গায় ডাকাত দল আমাদের গাড়ি ঘিরে ফেলে৷ পরে আমার পরিচয় পেয়ে নিরাপদেই ছেড়ে দেয়৷
আর কয়েক বছর আগে বগুড়ার শেরপুরে জামাত শিবিরের লোকেরা আমাকে তিনদিন যিম্মি করে রেখেছিলো৷ মানসিকভাবে আমাকে খুব টর্চার করেছিলো৷ তিনদিনে একটু পানিও খেতে দেয়নি৷ পানি চাইলে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়েছে৷ অবশেষে তখনকার সিলেটের র্যাব কমান্ডারের সহযোগিতায় আমি মুক্ত হই৷
আরেকবার নোয়াখালীর মেজর মান্নান কলেজ মাঠের মাফিল শেষে ঢাকায় ফেরার পথে সোনাপুর মোড়ে লা-মাযহাবিরা গাড়ি ভাংচুর করেছিলো। এভাবে কয়েকবার আকিদাগত ও প্রতিহিংসাগত কারণের হামলার শিকার হয়েছি।
আওয়ার ইসলাম : এসব ডাকাতির শিকার হওয়া বা হামলার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ : এখানে বিশেষ কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না৷ হতে পারে ব্যক্তি বা দলগত বিদ্বেষ, কমিটির স্বার্থে পরিকল্পিত ডাকাতি করানোও হতে পারে৷ আর ডাকাতিই হলো সাধারণ ডাকাতদের পেশা৷
ওয়ায়েজদের এখানে তেমন কিছু করারও থাকে না৷ কেবল সতর্ক থাকতে হবে৷ কমিটি যেনো কোনোভাবেই ওয়ায়েজকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে৷ কোনো কোনো ওয়ায়েজ না বুঝে কমিটির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন৷
কমিটি তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ওয়ায়েজকে ব্যবহারের চেষ্টা করে৷ তখন বিপদে পড়েন ওয়ায়েজ৷ এক্ষেত্রে ৯৫% দোষই কমিটিকে দেয়া যেতে পারে৷ তাই ওয়ায়েজকে সবদিক থেকে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি৷
এ ব্যাপারে সরকারেরও দায়বদ্ধতা আছে৷ সরকারের উচিত প্রতিটি হাইওয়ে এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা৷ পুলিশ যেনো এক জায়গায় বসে না থেকে সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করতে থাকে৷ আমি বিদেশের রাষ্ট্রগুলোতে এ ব্যবস্থা দেখেছি৷
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের একজন শীর্ষ আলেম মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদ দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন এবং তাও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে!
মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদ তো বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচিত শীর্ষ পাঁচজন মুফতীর একজন৷ তার মতো একজন মানুষ হামলার শিকার হওয়া প্রশাসনের তৎপরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে৷ প্রশ্ন উঠবে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়েও৷ এটা জাতীয় লজ্জা৷
অনেক সময় দেখা যায় পুলিশ নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার মাঝে ট্রাক থামিয়ে চাঁদা নেয়৷ এতে জ্যাম হয়ে পেছনের গাড়িগুলো ডাকাতি বা চুরির কবলে পড়ে৷ পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে উদ্যেগী হওয়ার আহ্বান করছি৷
আওয়ার ইসলাম : অনেক সময়ই দেখা যায় ওয়ায়েজদের গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েকজন নিহতও হয়েছেন এ কারণে, এটা নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ : আমি মনে করি দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনাই৷ এখানে মানুষের হাত থাকে না৷ সতর্ক থাকতে হবে৷ তবে কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে সরকারিভাবে তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে৷
আমরা দেখেছি কয়েকদিন আগে একটি মামলার রায়ে সিনেমা নির্মাতা প্রয়াত তারেক মাসুদের পরিবরাকে ৪ কোটি প্লাস অর্থ দেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একজন সিনেমা নির্মাতা আর একজন আলেমের মর্যাদা কখনো এক হতে পারে না৷
একজন আলেম তিনি তো জাতির রাহাবার, পথপ্রদর্শক৷ সুতরাং বাংলাদেশে কোনো আলেম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তার পরিবারকেও যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি৷
যেমন, মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী, মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ ও যশোরের মাওলানা আবু জাফর রহ.সহ সড়ক দুর্ঘটনায় শহিদ হওয়ার সবার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা৷
আওয়ার ইসলাম : সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করেন?
মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ : ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয় না৷ কেউ ইচ্ছে করে নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে না৷ কেননা, দুর্ঘটনা হলে সেখানে আরেকটি গাড়িরও মুখোমুখি সংঘর্ষ থাকতে হয়৷ তাহলে ষড়যন্ত্রকারী কেনো নিজের জীবন বাজি রেখে দুর্ঘটনা ঘটাবে?
তবে দুর্ঘটনার পর তদন্ত হওয়া জরুরি৷ আমাদের ওলামাগণ রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার। তাঁদের সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারি তদন্ত হয় না৷ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে ওলামাদেরও পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে৷
আওয়ার ইসলাম : হামলা ও দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকতে আপনার পরামর্শ জানতে চাই।
মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ : হামলার ব্যাপারে আমার পরামর্শ হলো, সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা৷ যেখানে পরিচিত কেউ নেই, সেখানে মাহফিল না রাখা৷ মাহফিল রাখার সময় কমিটিকে শর্ত দেয়া যে, তারা ওয়ায়েজকে নিরাপদ স্থান থেকে রিসিভ করে নিয়ে যাবে, এবং মাহফিল শেষে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিবে৷
মাহফিলের ব্যাপারে কমিটির সঙ্গে কথা একদম পাক্কা করে নেয়া চাই৷
আর দুর্ঘটনা এড়াতে পরামর্শ হলো, ড্রাইভারকে বলে রাখা যেনো কখনোই ৮০ কি.কি.-এর উপর গাড়ির গতি না উঠায়। ডাইভারকে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেয়া৷ লাগাতার লং ড্রাইভ না করা৷ ঘুম বা তন্দ্রা অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ না করা৷
প্রয়োজনে গাড়ি থামিয়ে কিছুটা ঘুমিয়ে নেয়া বা চা পান করে নেয়া৷ গাড়ির সবাই ঘুমিয়ে না যাওয়া৷ পুরো সময়টাতে একজন এমন থাকা যিনি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বার্তা চালিয়ে যাবেন৷ এমনিভাবে অতিরিক্ত কুয়াশার মধ্যে গাড়ি না চালানো৷
এসব বিষয়ে খেয়াল রাখলে অনেকটাই নিরাপদ থাকা সম্ভব ইনশাআল্লাহ।
আওয়ার ইসলাম : অনেক স্থানে মাহফিলের বক্তাদের শ্রোতা কর্তৃক হেনস্তার শিকার হতে হয়। এর প্রতিকার কী?
মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ : এর উত্তর আগেই দিয়েছি৷
আওয়ার ইসলাম : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য শুকরিয়া৷
মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ : আওয়ার ইসলাম পরিবারকেও অনেক ধন্যবাদ৷
দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ