মুসা আল হাফিজ
কবি ও গবেষক
ইয়েমেন বধ্যভূমি। আগুন, মৃত্যু আর বিনাশের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড। কাতার অবরুদ্ধ। রক্তচক্ষু, প্রবল চাপ, হুমকি ও আতঙ্কের রজনী পার করছে। লেবানন অস্থিরতায় কম্পমান। অজানা বিপর্যয়ের ইশারায় ভীত, শঙ্কিত।
ফিলিস্তিন বিনাশের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত, রুদ্ধশ্বাস। তাকে বলা হচ্ছে নিঃশ্বাস ত্যাগের চেষ্টা করো না। শান্তি নষ্ট হবে। বলা হচ্ছে, নিঃশব্দে সব মেনে নাও। নতুবা...
কে বলছে? ইসরাইল? না, ইসরাইল বললে ভয় ছিলো না।বলছে সৌদি আরব। লেবাননের সম্ভাব্য বিপর্যয়, কাতারের অবরুদ্ধ দশা, ইয়েমেনে অব্যাহত গণহত্যা সবই 'সম্পন্ন' হচ্ছে সৌদি আরবের নেতৃত্বে।
এর আগে মিসরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির পতনে সবচে’ সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে সৌদিকে, সিরিয়ায় আমেরিকা-ইসরাইলের সহযাত্রী হয়েছে সৌদি। লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ইত্যাদিতে মুক্তিকামী, ইসলামপ্রিয় শক্তির বিরুদ্ধে চলমান তার ভূমিকা।
এই যে কথাগুলো আপনার কাছে খারাপ লাগছে, ভাবছেন, পবিত্রভূমির শাসকদের খারাপকে এভাবে খারাপ বলা ঠিক হচ্ছে কী? এতে তো লাভবান হবে ইরান, শিয়াবাদ- আপনার ও কোটি কোটি মুসলিমের এ মানসিকতা ‘পবিত্রভূমি’র শাসকদের অপবিত্রতায় ডুবার পথ প্রশস্ত করছে।
শাসকরা বরাবরই চাইছে, মুসলমানরা এমনটি ভাবুক। এ ভাবনা এমন এক আশ্রয়শিবির, যা তাদের সুরক্ষা দেবে। ফলশ্রুতিতে ইসলাম তাদের কাছে উপেক্ষিত হলেও তারা ভক্তির জায়গায় থেকে যেতে পারবে। নিজেদের বিজ্ঞাপিত করতে পারবে মুসলিমদের হৃদপিণ্ডের নিগাহবান বলে।
নাগরিকদের কাছে তারা আনুগত্য নয়, চাইছে ভক্তি। এ জন্য সমালোচনা বরদাশত করতে পারছে না। সৌদি তার সকল তৎপরতাকে শিয়াদের হুমকি মোকাবেলা নামক মোড়কে অাবৃত করে চালিয়ে দিচ্ছে। যদিও শিয়াবাদের প্রভাবকে দৃঢ় ও প্রসারিত করতে তার ভুলনীতির ‘অবদান’ সবচে’ বেশি।
সৌদি শাসকমহল আসলে একটি হুমকিকেই ভয় পাচ্ছে, যে হুমকি তাদের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, স্বেচ্ছাচারকে প্রত্যাখান করে। আর সে হুমকি হচ্ছে ইসলামের রাজনৈতিক ও জৈবনিক দর্শন।
সৌদি রাজতন্ত্র ইসলামকে ভয় পাচ্ছে আবার ইসলামকেই তার প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন ছিলো এমন কৌশলী রূপ, যাকে দৃশ্যত ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়া যায়। আমেরিকা - ইসরাইলের থিংকট্যাংক প্রবর্তিত ‘উদার ইসলাম’ সে প্রয়োজনকে পূরণ করছে।
এটা ইসলামের নামে এমন এক প্রস্তাবনা, যাকে অবলম্বন করে শাসকরা ইসলামের যা কিছুকে নিজেদের জন্য হানিকর মনে করে, তাকে অনুদার বা অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রত্যাখানের সুযোগ পেয়ে যায়। আবার প্রত্যাখ্যানটাও হয় ইসলামের নামে।
সাম্রাজ্যবাদ ইসলামকে তার জীবন্ত অবয়বে দেখতে চায় না। ইসলামের অপূর্ণ রূপ কখনোই সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা থেকে পাশ্চাত্যকে টলাতে পারে না। অতএব পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের সবচে' সচেতন যে অংশ, তারাই ইসলামের এমন এক ধাচ হাজির করলো, যা জীবনদর্শন ও বিশ্বনেতৃত্বে পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম নয়। এর পক্ষে তাদের প্রচারণা চলছে বহু বছর ধরে।
মুসলমানরা যদি একে গ্রহণ করে, তবে ইসলাম কেবল একটি সাংস্কৃতিক ব্যাপার হয়ে যায় এবং জীবনাদর্শের জায়গা থেকে ইসলামের হুমকি সাময়িকভাবে অনেকটা শক্তিহীন হতে থাকে। ‘উদার ইসলাম’ এর প্রবক্তাদের কাছে ইসলামের যা কিছু অপছন্দ, সব কিছুকে উচ্ছেদের পথ প্রশস্ত হয়। অথচ বিষয়গুলো মূলত ইসলামের অংশ, বিপরীত পশ্চিমা সভ্যতার।
প্রকল্পটি খুবই কৌশলী। কিন্তু তার কার্যকরিতা নির্ভরশীল ছিলো প্রয়োগের উপর। একে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে কোথাও গ্রহণ করানো ছিলো জরুরি। শেষ অবধি তাও হলো এবং মুসলিম জাহানে সবচে' প্রভাবক জায়গা সৌদি আরবেই হলো। আমেরিকা-ইসরাইল-ইউরোপের জন্য এটা চিন্তাগত বিশাল বিজয়।
মুহাম্মদ বিন সালমান উদার ইসলামকে গ্রহণ করেছেন। মানে ইসলামের যে বিষয়গুলো পাশ্চাত্য অনুমোদন করেছে, তাকে গ্রহণ করেছেন। অাদর্শগতভাবে উম্মাহের কেন্দ্র থেকে এত বড় বিচ্যুতির নজির আরেকটি চোখে পড়ে না।
ইসলামের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা এ ব্যবস্থায় হুমকি বলে বিবেচিত। ‘উদার ইসলাম’ কখনো এ হুমকিকে সহ্য করে না। কেউ উদার ইসলাম গ্রহণ করলো, মানে সে ইসলামের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করবে বলে ঘোষণা দিলো।
সৌদি যখন মধ্যপন্থি বা উদার ইসলামকে গ্রহণ করলো, মনে হলো সৌদি আরব আপন সীমানায় এর চর্চা করবে। কিন্তু না। সে তার নীতিকে অন্যান্য আরব দেশে রপ্তানি করতে চায়। যেখানেই ইসলাম রাষ্ট্রীয় প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়, সেখানেই সে দেখছে নিজের বিরুদ্ধে হুমকি।
অতএব ইখওয়ান তার রাতের ঘুম হারাম করে দেয়া নাম হয়ে উঠে। ইসলামি জীবন দর্শনের প্রায়োগিক ও বিজয়কামী রূপটি একটা আপদ হয়ে দেখা দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে
যে রাষ্ট্র এমনটি ভাববে না, সৌদি তাকেও আপদ হিসেবে দেখতে চাচ্ছে । যে আলেম ইসলামকে ইসলাম হিসেবে দেখেন, তিনিও আপদ হয়ে উঠেন। যে ভাবধারা ইসলামকে তার জীবনীশক্তিতে উজ্জীবিত দেখতে চায়, তাও আপদ হয়ে উঠে। অতএব এমন কোনো আপদকে মুহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরব বরদাশত করছে না।
এমবিএসের সৌদি আরব যাকে আপদ হিসেবে দেখছে, ইসরাইলও তাকেই দেখছে শত্রু হিসেবে। ইসলামি শক্তির উত্থান উভয়ের কাছে বিরাট হুমকি। এমবিএসের আরব ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখছে, দেখছে ইসরাইলও। উভয়েই চায়, ইরানের পরাভব। উভয়েই চায় ফিলিস্তিনে প্রতিরোধ আন্দোলন থেমে যাক। লেবাননে হিজবুল্লাহ ক্রিয়াশীল না থাকুক। কুর্দিরা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ুক।
আল জাজিরা বন্ধ হোক বা সংবাদ প্রকাশে স্বাধীনতা হারাক।
তুরস্ক উভয়ের জন্য হুমকি। মাথাব্যথা।ভয়। সৌদি ভীত সুন্নী ঘরাণায় তার নেতৃত্বে ভাগ বসায় কি না তুরস্ক। এরদোগানের সহায়তায় ইখওয়ান ইত্যাদি ঘুরে দাঁড়ায় কি না,মধ্যপ্রাচ্যে তুর্কি মডেলের স্বাধীনচেতা রাজনীতি প্রসারিত হয় কি না!
সেই ভয়ের জায়গা থেকেই সে প্রচারের প্রতিটি উপায়কে কাজে লাগিয়ে বলে চলছে, তুরস্ক চায় উসমানী সালতানাতের পূণঃপ্রতিষ্ঠা। মানে আরবদের স্বাধীনতা হরণ। এ প্রচার মিসর, আরব আমিরাত, বাহরাইন, জর্দান ইত্যাদিতে তুমুলভাবে চলমান। যদিও প্রচারকরাও জানে, উসমানী সালতানাতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় মোটেও।
এ প্রচারে ইউরোপ-আমেরিকার কণ্ঠস্বরগুলোও সরব। ইসরাইলও। ইসরাইল চায় আরব- তুর্কি,তুর্কি- কুর্দি, শিয়া-সুন্নী সমস্যা আরো প্রবল হোক এবং আন্তঃসীমান্ত বিরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝড় বয়ে যাক।
এতে সরকার সমূহ দুর্বল থাকবে, নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকবে, জনগণ বিভক্ত থাকবে, গোষ্ঠীসমূহ পরস্পর পরস্পরকে ভয় করবে, অবিশ্বাস করবে, আক্রমণ করবে। বিরোধের প্রেক্ষাপটে ইসরাইল নিজের প্রভাব বলয় সম্প্রসারিত করবে, তার শত্রুকে শেষ করে দিতে ব্যবহার করবে আরবদের এবং সে থেকে যাবে সুরক্ষিত। শুধু সুরক্ষিত নয়, সে তার সীমান্ত সম্প্রসারণ করবে নির্বিঘ্নে।
আর এটাই সঙ্কটের মূল জায়গা। ইসরাইল তার প্রতিশ্রুত ভূমি দখল করতে চায়। তাদের বিশ্বাস, ইশ্বর ইহুদিদের যে ভূমির অধিকার দিয়েছিলেন, সেটা মিসরের নীল নদ অবধি বিস্তৃত। এর মধ্যে আছে জাযিরাতুল আরব, মক্কা-মদিনাও। সেই ভূমি পূণরুদ্ধার তাদের করতে হবে। সব ভূমি একত্রিত হলেই প্রতিশ্রুত, পবিত্র ইসরাইল পূর্ণতা পায়।
এটা যতই অসম্ভব মনে হোক, ইসরাইল হাল ছেড়ে দেয় না। এক সময় ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই অসম্ভব মনে হতো। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হয়েছে। এক সময় আরবরা ইসরাইলিদের মেনে নেবে, এমনটি অবাস্তব মনে হতো, সেটাও বাস্তব আজ। এক সময় মনে হতো, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল একঘরে হয়ে থাকবে। আজকের পরিস্থিতি এর উলটো।
ইসরাইল জানে, কোন লক্ষ্য পূরণে কাকে ব্যবহার করতে হবে। অতীতে ইহুদিবাদ ব্যবহার করেছে বৃটেনকে, ফ্রান্সকে, রাশিয়াকে, আমেরিকাকে। আরবদেরও। করছে এখনো। কার মধ্যমে কী উদ্ধার করতে হবে, সেটাও তাদের জানা। যে ব্যবহৃত হয়, তাকে দেখানো হয় তারই একটি বিশাল ও অনিবার্য স্বার্থ। যা হাসিলে তাকে ইসরাইলের সহায়তা নিতেই হবে। সে ভাবে, ইসরাইল তাকে সহায়তা করছে।কিন্তু ইসরাইল নিজেকে ছাড়া কাউকেই কখনো সহায়তা করে না।
এমবিএস ভাবতে পারেন ইসরাইল তার বন্ধু, কিন্তু কোন অর্থে?
মনে রাখতে হবে ইসরাইলের বন্ধুত্ব নিবেদিত চলমান সময়ের স্বার্থ ও বৃহত্তর প্রতিশ্রুত ইসরাইলের লক্ষ্যপূরণে।
সেই ‘বৃহত্তর প্রতিশ্রুত' ইসরাইলের পথ প্রশস্ত হবে যার দ্বারা কিংবা বুঝে- না বুঝে এ প্রকল্পের কামলাগীরি করবে যে মুসলিম, তাকে তারা বন্ধু বানাবে না তো কাকে? কিন্তু সেটা হবে ক্লাইভের সাথে মীর জাফর আলী খানের বন্ধুত্বের অনুরূপ। একে কী বন্ধুত্ব বলে না অন্য কিছু?
ইসরাইল তার পরবর্তি লক্ষ্য পূরণে আরব রাষ্ট্রসমূহকে অস্থিতিশীল দেখতে চায়। যুদ্ধমুখর দেখতে চায়।সংঘাতময় দেখতে চায়।রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত দেখতে চায়। তারা চায় রাষ্ট্রসমূহের সীমানা অকার্যকর হয়ে যাক, ঠুনকো হয়ে যাক। ভাংতে থাকুক।
আইএস সীমানাকে অস্বীকার করেছে এক যুক্তিতে, অকার্যকর করেছে। কুর্দিরা সিরিয়া-ইরাক-তুরস্কে সীমানাকে চ্যালেঞ্জ করছে আরেক যুক্তিতে। আমেরিকার পরিকল্পিত আরব পুরণো সীমান্ত সমূহকে ওলটপালট করেই সাজানো।
যদিও এই সীমানার বিন্যাস ব্রিটেন,আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইসরাইলের স্বার্থেই হয়েছিলো, কিন্তু সে স্বার্থ পূরণ হয়েছে। এখন নতুন স্বার্থ, অতএব নতুন চাহিদা ইসরাইলের। যার বাস্তবায়নে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহ কার্যকারিতা হারাতে থাকবে, সংঘাত চলতেই থাকবে একের পর এক মোড়কে। একটা স্থিমিত হলে আরো দশটি জ্বালামুখ খুলে দেয়া হবে।
সেই জ্বালামুখের কেন্দ্রবিন্দু হোক সৌদি আরব, এটাই চেয়েছিলো ইসরাইল। তাদের সেই চাওয়া সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমে ক্রমে রূপান্তর আনতে থাকবে।
এ রূপান্তর মুসলমানদের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।