তাওহীদ মাদানি
শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ২৫ বছর আগে এই দিনেই ধ্বংস হয়েছিল ভারতের অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ। আজ সেই ঘটনা ২৬ বছরে পা দিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকেই মুসলমানগণ এই দিনকে কালো দিন হিসেবে ঘোষণা দেয়৷
ঘটনার ২৫ বছর অতিবাহিত হলেও প্রাশাসন কর্তৃক উল্লেখযোগ্য কোনো ফায়সালা হয়নি আজ অবধি৷ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ তম বর্ষপূর্তিতে আসুন জেনে নেওয়া যাক বিবাদের ইতিবৃত্ত।
১- ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় নির্মিত হয় বাবরি মসজিদ। তাঁর নামেই এই মসজিদের নামকরণ হয়। যদিও হিন্দুদের দাবি ছিল, এটিই রাম জন্মভূমি এবং এখানে ভগবান রামের মন্দিরও ছিল।
২- ১৮৫৩ সালে সিপাই বিদ্রোহের চার বছর আগে প্রথম ধর্মীয় বিবাদের সূত্রপাত হয় এই মসজিদকে কেন্দ্র করে।
৩- ১৮৫৯ সালে ধর্মীয় বিবাদ আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় ছ’বছর পর ব্রিটিশ সরকার বিতর্কিত কাঠামোর চারপাশ ঘিরে দেয়। ভিতরের অংশে মুসলিম সম্প্রদায় এবং বাইরের অংশে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রবেশাধিকার করে দেওয়া হয়। প্রায় নব্বই বছর এইভাবেই ছিল সবকিছু।
৪- ১৮৮৫ সালে প্রথমবারের মত হিন্দুদের পক্ষ থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়৷
৫- ১৯৪৯ সালে ৫০ জন হিন্দু মিলে মসজিদের মূল কেন্দ্রে ভগবান রামের মূর্তি নির্মাণ করে৷ এরপর থেকেই হিন্দুরা নিয়মিত সেখানে পূজা-অর্চনা শুরু করে দেয়৷
৬- ১৯৫০ সালে রাম চন্দ্র দাস নামক এক হিন্দু নেতা মসজিদের ভিতরে রামের মূর্তি প্রবেশ করেন অপচেষ্টা করে ৷
৭-১৯৫৯ সালে হিন্দুদের পক্ষ থেকে বাবরি মসজিদ স্থানান্তরিত করার আওয়াজ ওঠে৷
৮-১৯৬২ সালে উত্তর প্রদেশর সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড হিন্দুদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে৷
৯- ১৯৬৫ সালে হিন্দুদের পক্ষ থেকে বাবরি মসজিদে তালা ঝুলানো হয়৷
১০- ১৯৮৪ সালে বাবরির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়। জাতীয় কংগ্রেসের পর এক নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়। ভারতীয় জনতা পার্টি। তার সঙ্গে গোটা দেশে মাথাচাড়া দেয় হিন্দুত্ববাদ।
ভগবান রামের জন্মভূমিকে অশুভ শক্তি থেকে ‘মুক্ত’ করার ডাক দিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে গঠিত হয় রাম মন্দির কমিটি। তার পুরোধা করা হয় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানীকে।
১১- ১৯৮৬ সাল তথা ঠিক দু’বছর পর জেলা আদালতের বিচারক আচমকাই নির্দেশ দেন, হিন্দুদের পুজো-অর্চনার জন্য বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া হোক। নির্দেশের ঘন্টাখানেকের মধ্যে গেট খুলে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে ফেলেন।
১২- ১৯৮৯ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এক অভিযান শুরু করে। বিতর্কিত কাঠামো লাগোয়া জমিতে রাম মন্দির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এই অভিযানের মধ্য দিয়ে। এবং বিজেপিও তাদের সহযোগিতায় যথাক্রমে হাত বাড়ায়৷
১৩- ১৯৯০ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য-সমর্থকরা বিতর্কিত কাঠামোর উপর রাম মন্দির নির্মাণ করতে যাওয়ায় গম্বুজের আংশিক ক্ষতি হয়। এরপরই উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব করসেবকদের উপর গুলিচালনার নির্দেশ দেন। রাম মন্দির নির্মাণের সমর্থনে আদবানী দেশ জুড়ে রথযাত্রা বের করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর গোটা ঘটনায় মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেও তা বিফলে যায়।
১৪- ১৯৯১ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। কেন্দ্রে যথারীতি কংগ্রেস।
১৫- ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২। ভারতের ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ভিএইচপি, বিজেপি এবং শিব সেনার সমর্থকরা চড়াও হয়ে গুড়িয়ে দেয় বাবরি মসজিদের কাঠামো। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। প্রায় দু’হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যায় এই দাঙ্গায়।
১৬- ১৯৯৮ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপির জোট সরকার। প্রধানমন্ত্রী হন অটল বিহারী বাজপেয়ী।
১৭- ২০০২ সালে বাজপেয়ী নিজের অফিসে একটি অযোধ্যা সেল গঠন করেন।
১৮- ওই বছরই মার্চ মাসের মধ্যে মন্দির নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ করার চ্যালেঞ্জ নেয় ভিএইচপি। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ অযোধ্যা থেকে ফেরার সময় গুজরাতের গোধরার কাছে সবরমতী এক্সপ্রেসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ৫৮ জন করসেবকের। তিনদিনের মধ্যে গোধরাকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাধে। বহু মানুষের মৃত্যু হয় তাতে।
১৯- এপ্রিল মাসে বাবরি মসজিদের জায়গার অধিকার কোন সম্প্রংদায়ের, সেই মর্মে এলাহাবাদ হাই কোর্টে মামলার শুনানি শুরু হয়।
২০- আদৌ বাবরি মসজিদের কাঠামোর মধ্যে রাম মন্দির ছিল কি না তা জানার জন্য পরের বছর জানুয়ারি মাসে আদালত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে সার্ভে করার দায়িত্ব দেয়।
২১- ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে এএসআই রিপোর্টে জানায়, মসজিদের নিচে রাম মন্দির থাকার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। এই রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে মুসলিম ল’ বোর্ড।
২২- ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আরও এক অধ্যায় সংযোজিত হল অযোধ্যার ইতিহাসে। এলাহাবাদ হাই কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দেয়। বাবরি মসজিদকে তিন ভাগে বিভক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত।
এক ভাগ পায় উত্তরপ্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড এবং বাকি দুই ভাগ দেওয়া হয় নির্মোহী আখাড়া এবং রাম লালা কমিটিকে। কাঠামোর কর্তৃত্ব যায় হিন্দুদের দখলে। মুসলিমদের হয়ে এক আইনজীবী এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানান। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
২৩- উক্ত বছরেই কৃত আপিলের ভিত্তিতে মামলা হাই কোর্ট থেকে সুপ্রিমকোর্টে হস্তান্তর হয়৷
২৪- ২০১১ সালের মে মাসে এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়কে খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও সমাধানে পৌঁছানো যায়নি এই ইস্যুতে৷
২৫- চলতি বছরে তথা ২০১৭ এর ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্ট আদালতে মামলার শুনানী শুরু হলে চূড়ান্ত রায়ের জন্য ২০১৮ এর ৮ ফ্রেব্রুয়ারী পর্যন্ত শুনানী মুলতবীর ফায়সালা হয়৷
এইচ জে