আলী আবদুল মুনতাকিম
অতিথি লেখক
বাংলা গানের জনপ্রিয় ভারতীয় শিল্পী মান্না দে’র একটি বিখ্যাত গানের কথা আমরা অনেকেই জানি, গান টি হল, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেছে সোনালি বিকেল গুলো সেই,আজ আর নেই’।
গানটির চরিত্র চিত্রায়নে দেখা যায় কলকাতার একটি বড় কফি হাউজে বন্ধুরা মিলে চা কফি পান করছে আর কবিতা গল্প বা সাহিত্য চর্চা করছে। বিশেষ করে একটি টেবিলে সাত বন্ধুর আড্ডা বা সংস্কৃতি চর্চার স্মৃতি মন্থন খুবই হৃদয়গ্রাহী।
সময়ের ক্রমে এক বন্ধু নিখিলেশ ইতালি তথা ইউরোপ চলে গেছে, আরেক বন্ধু মঈদুল ঢাকায় চলে এসেছে, সবাই প্রতিষ্ঠিত হলেও একজন দুর্ভাগা বন্ধু ক্যানসারে মারাও যায়। সাত বন্ধু মিলে কফি হাউজের সেই সোনালি বিকেল যেভাবে কাটাত আজ আর তা নেই।
তাদের যেমন সেই বয়স নেই তেমনি কফি হাউজেও সেই সাহিত্য আড্ডা আজ আর নেই। গানটির বিস্তারিত বলার কারণ হল এই গানের কবির সোনালি সময়ের, সোনালি বিকেল হারাবার আফসোস তার একার নয়।অনেক কস্ট আর দুংখ মিশেল এই আবেগ ভরা কথাগুলো আমাদের সকলকেই ভাবায়। কফি হাউজে আজ আর ভাল আড্ডা হয় না।
কফি হাউজ কম থাকলেও বাংলাদেশের এমন কোন শহর বা গ্রাম, পাড়া বা মহল্লা পাওয়া যাবে না যেখানে চা দোকান নেই। চা-কফি দোকান অাছে তো জমজমাট আড্ডাও আছে। সেই আড্ডায় যে কি পরিমাণ গীবত বা পরনিন্দা চর্চা হয় তা না শুনলে বুঝা যাবে না।
একটি গল্প প্রচলিত আছে এরকম- আলমনগরের হেকিমপুর গ্রামের ঘটনা। খাঁ বাড়ির চাচা কাজীবাড়ির ভাতিজা, মোল্লাবাড়ির দাদারা সবাই মিলে নিয়মিত আড্ডা দিত। মুন্সী বাড়ির মেধাবী ছাত্র তারেকের পরিবারের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করতে গিয়ে একজন বলল, কাউল্লা মাস্টারের (আসল নাম কালাম) পোলা তারিক্কারে নাকি স্কুলে ভর্তি করাইছে, অন্যজন বলল ভর্তি করালে কি হবে পাশ করতে পারব না।
পাশ করার সংবাদ শুনে আরেকদিন বলল, পাশ করলে কি হবে চাকরি পাবে না। চাকরিও যখন হল, এবার সমালোচনা করল তাতে কি এসব চাকরিতে বেতন পাবে না। বেতনও যখন পেল এবার বলল, তাতেও লাভ নাই, বেতনে বরকত হবে না।
বরকতপূর্ণ ওই পরিবার যখন ভালই চলছিল তখন সমালোচনা করল, এরা কবরে গিয়ে শান্তি পাবে না। নিন্দা সমালোচনা কবর পর্যন্ত চলে গেল।
এরকম গল্প আর আড্ডায় সবাই খুব মজা পায়। চা-কফি পান আর গীবতের বাণে-জেয়ারে চায়ে কিন্তু চিনিও লাগে না।
এক চায়ের আড্ডায় গ্রাম্য মাতবর-মেম্বার বসে চা পান করছিল আর অনুপস্থিত ব্যক্তিদের গীবতে মশগুল ছিল। চা দোকানের কর্মচারী বলল, মেম্বার কাকা আপনার চায়ে তো চিনি দেই নাই। মেম্বার বলল, কই বললি না ক্যান, চা তো শেষ, চিনির কথা মনে হয়নি তো।
শুনে মুরুব্বী একজন বলল, যেভাবে বসে বসে মানুষের গীবত করো, তাতে মুখ এমনিতেই মিষ্টি থাকে, চায়ে চিনির দরকার নেই।
হিংসা, নিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, গীবত ভারতীয় উপমহাদেশে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। শিক্ষিত-মূর্খ কেউ মুক্ত নয়।
আমার মরহুমা স্ত্রী জান্নাতবাসীনি মাসুমা বেগমের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য আমি সিংগাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ১০ দিন ছিলাম। নার্স স্টেশনে নার্সদের দেখতাম বসে বসে গল্প করছে। একদিন খেয়াল করলাম তারা তো আড্ডা মারছে না, লেপটপ সামনে নিয়ে একজন রোগীর রোগ, তার ইতিহাস, তাকে কিভাবে সুস্থ করার নির্দশনা আছে, এ নিয়ে আলোচনা করছে।
আমি বিষয়টি আমার সাথে থাকা বড় ছেলে মীম আবদুল্লাহ ফাহীমকেও দেখিয়েছি। অযথা গল্প তারা করে না।
তাহলে তারা গল্প করছে আমার এমনটি মনে হওয়ার কারণ কী? এটিই আমার বা আমাদের বাঙ্গালি চিন্তা। বা বুঝার ভুল।
মরহুমা স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ল্যাব এইড হাসপাতালের ক্যাবিনে ছিলাম ৯ দিন। আর ইউনাইটেড হাসপাতালে ছিলাম ২০ দিন। দুটো হাসপাতালেই বন্দীখানায় ছিলাম যেন। এ নিয়ে বিস্তারিত অন্য দিন লিখব ইনশাল্লাহ।
নার্স স্টেশনে কিংবা ডাক্তার স্টেশনে ডাক্তারগণ বেশিরভাগ সময়ই আড্ডায় মেতে থাকত। রোগী বা তার এটেন্ডেন্ট নিয়ে ফালতু গল্প করত। বিপদের সময় রোগীর কাছে আনা যেত না। রোগীর কাছে আসলেও শরীরের অবস্থা দেখত না। এখানেও গীবতের চর্চা হয়।
ইদানিং গীবতের চর্চা হয় ফেসবুকে। যা চা দোকানকেও হার মানিয়ে ফেলছে। একে অন্যের পেছনে লেগেই আছে।
গীবত এক মধু মিশ্রিত মজাদার খাবার। এর বদহজম হবে কাল হাশরে। কোন সেলাইন বা ওষুধে কাজ হবে না।
গীবতের গোনাহ বড় কঠিন। এর থেকে বাঁচতে হলে যেতে হবে কুরানের কাছে। কুরান কী বলছে দেখুন,
‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা তোমরা বেশি বেশি অনুমান করা থেকে বেঁচে থাক, কেননা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুমান অপরাধ এবং একে অপরের দোষ খোঁজার জন্য তার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করো না। একজন আরেকজনের গীবত করো না, তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ে গোশত খাওয়া পছন্দ করবে, আর অবশ্যই তোমরা এটা ঘৃনা কর। এসব ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়লা তওবা কবুল করেন এবং তিনি অত্যন্ত দয়ালু।
সুরা হুজরাত আয়াত ১২। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়াত দান করুন। আমিন।