রশীদ জামীল
আলেম, লেখক
মতি মিয়া ওয়াজ থেকে ফেরার পথেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আজ থেকেই তাহাজ্জুদের নামাজটা ধরে ফেলবে।
হুজুর বলেছেন, 'মধ্যরাতের পর এই নামাজটা পড়লে আল্লাহপাক চেহারার নূর বাড়িয়ে দেন। কারো ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থাকলে সে তাইয়াম্মুম করেও নামাজটি পড়ে ফেলতে পারে'। ওয়াজটি মতির খুব মনে ধরেছে।
অনেকদিন ধরে এমন একটি ওয়াজই খুঁজছিলো সে। ফেয়ার এন্ড লাভলির পেছনে অনেক পয়সা নষ্ট হয়েছে। কাজ হয়নি। তাহাজ্জুদের কারণে যদি কিছু হয়!
সে রাতেই চুপি চুপি বেড থেকে নামলো মতি। পাশে বউ শুয়ে আছে। বউকে বুঝতে দেয়া যাবে না। হুজুর বলেছেন, নফল এবাদত যত নির্জনে এবং চুপিসারে করা হবে, সওয়াব ততই বেশি। ওজু করতে যাবে; টের পেল তার শ্বাসকষ্টটা বেড়েগেছে। মনে পড়ল হুজুর বলেছেন, তাইয়াম্মুম করলেও হবে। পা পা করে এগিয়ে গেল পাকঘরের দিকে। মাটিতে হাত ঘঁষে তাইয়াম্মুম করতে হবে। লাইট জ্বালানো যাবে না। বউ জেগে যাবে। মতি অন্ধকারেই হাত ঘঁষতে লাগলো ঘরের মেজেতে।
ওদিকে বউ রাতে রুটি বানিয়ে গরম তাওয়া উপোড় করে মেজেতে রেখে দিয়েছিল, ঠাণ্ডা হলে মাচায় উঠিয়ে রাখবে বলে। ঘুমানোর আগে আর বেচারির আর খেয়াল ছিল না তাওয়া উঠিয়ে রাখতে। মতি অন্ধকারে তাওয়ার তলায় হাত ঘঁষে তাইয়াম্মুম করে তাহাজ্জুদের নামাজটা পড়ে অন্যরকম তৃপ্তি নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙলো সকাল আটটায়। তাহাজ্জুদের ঠেলায় ফজর কোনদিকে গেছে, বোঝা যায়নি!
সকালবেলা বউকে ডেকে তুলে বলল, বউ! আমি আজ রাতে একটি কাজ করেছি। কী করেছি বলা যাবে না। তাহলে সওয়াব কমে যাবে। তুমি শুধু আমাকে বলো, আমার চেহারায় কি নূর দেখতে পাচ্ছো?
বউ বলল, নূর কোন কালারের হয়, সেটা তো আমি জানি না। তবে নূরের কালার যদি কালো হয়, তাহলে তোমার চেহারায় শুধুই নূর আর নূর!
দুই
মুমিনদের উপর আমি একটি এহসান করেছি।
-আমাদেরকে মানুষ হিশেবে সৃষ্টি করার কথা বলছেন, আল্লাহ?
-না।
-আমাদের হাত পা চোখ সবকিছু ঠিকটাক দেয়ার কথা বলছেন?
-না।
-বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন বলে?
-না।
-শ্রেষ্ট জাতি ঘোষণা করার কথা বলছেন মনেহয়?
- আরে, না।
-তাহলে কোন এহসানের কথা বলছেন? আমরা তো পা থেকে মাথা, ভেতর থেকে বাইর, জন্ম থেকে বর্তমান, আপনার এহসানে মধ্যেই ডুবে আছি। কোনো এহসানের কথা তো আপনি এভাবে মোটাদাগে আলাদা করে এহসান জিতলাননি! তাহলে কোন সে এহসান?
আল্লাহ বললেন। দেখো! আমি তোমাদেরকে যত যা-ই দিয়েছি, আমার ভাণ্ডারে কম পড়েনি। দেয়ার পর এক চিলতে জায়গাও খালি হয়নি। যেমন ছিল তেমনই রয়েগেছে। কিন্তু যে এহসানের কথা বলেছি, সেটা একপিসই ছিল আমার কাছে। সবচে’ প্রিয় ছিল আমার। আমি আমার সেই প্রিয় জিনিসটিই তোমাদেরকে দিয়ে দিয়েছি। দেয়ার পর দেখলাম জায়গাটি খালি হয়ে আছে! তাহলে তোমরাই বলো কী দিয়েছি তোমাদের। এমন কিছু দিয়ে দেবার পর সেটার কথা আমি ভুলি কী করে!
-বুঝতে পারছি অনন্য কিছুর কথাই বলছেন। কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না কী সেটা।
আল্লাহ বললেন, ('ইয বা’আসা ফীহিম রাসূলাহ') তোমাদেরকে আমি আমার 'মুহাম্মাদ' দিয়ে দিয়েছি। মুহাম্মাদ আমার কাছে একপিসই ছিল। দ্বিতীয় আর বানাইনি। সেই মুহাম্মাদ তোমাদেরকে দিয়ে দিলাম...
কারো কাছ থেকে গিফট পেলে আমরা খুশি হই। আর আল্লাহর কাছ থেকে গিফট, আবার সেই গিফটটাও যদি এমন হয় যে, স্বয়ং আল্লাহ বলছেন এটা আমার দেয়া সেরা উপহার, তাহলে মুসলমানদের খুশির অন্ত থাকার কথা না। সঙ্গতকারণেই আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ট উপহার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর আগমন উপলক্ষে মুসলমান সবচে’ বেশি খুশি হবে, ঈদ তো কী, একশ’ ঈদ থেকেও সে খুশির পরিমাণ হবে বেশি, এটাই ঈমানের দাবি।
তিন
মিলাদুননবী মানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম। মিলাদুননবী একটি ঐতিহাসিক সত্য। এটি আকিদা সংক্রান্ত কোনো বিষয় নয় যে, দলিল দিয়ে সাবিত করতে হবে। ঈমান সংক্রান্ত কোনো মাসআলা নয় যে, 'আমানতুবিল্লাহ ওয়া মিলাদুন-নাবীইয়্যিহি' বলতে হবে। নবীজির জন্ম, আরবিতে বললে মিলাদুন্নবী; এটা মানা না মানার কিছু নেই। মিলাদুননবী বা নবীজির জন্ম হয়েছে, এটা তো মুসলিম, অমুসলিম সকলেই স্বীকার করে। তাহলে সমস্যাটা আসলে কোথায়?
সমস্যা হল,
-নয় নাকি বারো!
-মিলাদ নাকি সিরাত!
-বসে, শুয়ে নাকি দাঁড়ায়ে!
-মিলাদুননবীকে 'ঈদ' বলা বিদ'আত!
- মিলাদুননবী 'ঈদ' না বলা গোস্তাখি!
ব্যাপারটি যতটা না শরীয়াহ সংক্রান্ত ইজতেহাদি এখতেলাফ, আজকাল তারচে’ বেশি ইগোটিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইস্যুটিকে বেরলবিয়ত এবং কওমিয়্যতের মধ্যে এক ধরণের হটকেক হয়ে বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন;
... আগর কেরামত আযায়ে, তো আযানেদো, হামলোগ মিলাদুননবী-হি বুলেঙ্গে।
... জান দে-দুঙ্গা ,মাগার মিলাদুননবী বিলকুল নেহি বুলুঙ্গা, হরগিজ নেহি!
দরকার ছিল না। শব্দের পেছনে পাল্টা-পাল্টি অ্যাকশানে যাওয়ার কোনো দরকার ছিল না। বিষয়টিকে আরো সফটলি নেয়া যেত। এতোটা এক্সট্রিম না হলেও পারা যেত।
চার
কথা তো দু'দিকেই বলার আছে। ঈদ' বলতে চাইলে বলার পক্ষেও দলিল দাঁড় করানো যাবে। ঈদ' না বলার ক্ষেত্রেও। নির্ভর করছে ইনটেনশনের উপর। 6 এবং 9, ছয় দেখতে চাইলে দেখা যাবে, নয় দেখতে চাইলে তাও দেখা যাবে। একদিকে তাকালে ছয়, উলটা করে দেখলে নয়। কী কীভাবে তাকাবে, নির্ভর করবে সেটার উপর। ব্যাখ্যা করছি।
এপীঠ
''ইসলামে দুই ঈদ। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা। তৃতীয় কোনো ঈদের কথা বলা নেই। সুতরাং ওয়ালাদাতে নবুওতের দিনকে ঈদের দিন ঘোষণা করা বা এই দিনকে ঈদ বলা শরীয়তে মুহাম্মদিতে বাড়তি সংযোজন। সুতরাং এটি একটি বিদআত...''
... শাব্দিক অর্থে দুই ঈদ ছাড়া অন্যান্য দিনকে ঈদ বলার প্রমাণও তো আছে। সহিহ বুখারি, হাদিস নাম্বার ৪৫, এবং সহিহ মুসলিম, হাদিস নাম্বার ৭৫২৭, এক ইহুদি সাইয়্যিদুনা উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিআল্লাহু আনহুর কাছে এসে বলল, উমর! তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি।
উমর বললেন, বলো কী বলবে!
-তোমাদের কোরআনে এমন একটি আয়াত আছে, যে আয়াতটি যদি আমাদের ধর্মের বেলায় নাযিল হত, খুশিতে আমরা পাগল হয়ে যেতাম। যেদিন এমন আয়াত নাযিল হত, সেই দিনকে আমরা ঈদের দিনের মত পালন করতাম।
উমর বললেন, কোন আয়াত?
-সুরায়ে মায়েদার তৃতীয় আয়াত, 'আল ইয়াওমা আকমাতুু লাকুম দ্বীনাকুম'।
হযরত উমরের জবাবটি ছিল ইন্টেলেকচুয়াল। বললেন, ডন্ট ওরি ম্যান, সেই দিনটি আমাদের জন্য ডবল ঈদের দিনই ছিল। একে তো ছিল আরাফার দিন, যা আমাদের কাছে ঈদের মতই। সাথে ছিল শুক্রবার। শুক্রবারও আমাদের কাছে ঈদের দিন।
তাহলে ইসলামী শরীয়ায় মুসলমানদের জন্য ঈদ দুইটা হলেও লুগতান বা শব্দগত অর্থে দুই ঈদ ছাড়া অন্যান্য দিনের জন্যও 'ঈদ' শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। শাব্দিক অর্থে দুই ঈদ ছাড়া অন্যান্য দিনকেও ঈদ বলা যেতে পারে।
যারা মিলাদুননবীকে 'ঈদে মিলাদুন্নবী' বলেন, ব্যাপারটিকে তাঁরা যদি এমন ভাবেন, তাহলে আমার মনে হয় না সমস্যার কিছু আছে। কেউ যদি শাব্দিক অর্থ বিচারে মিলাদুননবীকে 'ঈদ' বলে খুশি হতে চায়, হোক না। সমস্যা কী!
ওপীঠ
এভাবে শাব্দিক অর্থ ফিট করে পরিভাষা তৈরি করতে থাকলে কাল একজন বলবে, আমার বাবা মা আমার রব।
দলিল হল কোরআনে কারিম, রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগিরা। আল্লাহ বলেছেন ছোটবেলা আমাদের বাবা মা আমাদের রব ছিলেন!
আরেকজন বলবে, আমার বস আমার মাওলা। দলিল; মুনিবকে মাওলা বলা যায়।
আরেকজন বলে বসতে পারে আমি বিন্দাবন যাচ্ছি, এটা আমার হজ্জ! হজ্জ অর্থ ইচ্ছা করা। আমি বিন্দাবন যাওয়ার ইচ্ছা করেছি।
-আরেকজন বলতে পারে আমি আযান মানি না। কারণ, মুয়াজ্জিন অর্থ আহবানকারি। আর মুয়াজ্জিন মিথ্যাকথা বলে। কোরআনে আছে, 'ফাআযযানা মুয়াযযিনুন আইয়্যাতুহাল য়ীরু ইন্নাকুম লাসারিকুন'। ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁর ভাইকে কাছে রাখার জন্য কৌশলের আশ্রয় নিলেন। ভাইয়ের থলিতে বাটখারা রেখে দিয়ে এক মুয়াজ্জিন আযান দিল, 'তোমরা চোর'!
সালাত অর্থ দুরুদ। এখন কেউ যদি দৈনিক পাঁচবেলা দুরুদ পড়ে আর বলে আমার সালাত(নামাজ)আদায় হয়ে গেছে, কী বলবেন!
বলতে চাচ্ছি, সকল ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থ ফিট করলে সমস্যা আছে। সমস্যা তৈরি হয়। ভুল বোঝাবুঝির রাস্তা খুলে। সুতরাং ইসলামের বিশেষ পরিভাষাগুলোকে বিশেষ রাখাই ভালো।
ছয়
হুজুরের জন্মদিন কবে!
কী করা যাবে! কী করা যাবে না!
তারিখ নিয়ে মতামতের অন্ত নাই। অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণের মতামত ৯ অথবা ১২ রবিউল আউয়াল। তবে একর্ডিং টু সহিই মুসলিম, দিনটি সোমবার ছিল। সময় ছিল সুবহে সাদিক। তাহলে সোমবারের ব্যাপারটি গ্যারান্টেড। রবিউল আউয়াল এবং সুবহে সাদিক মোটামুটি কনফার্ম। এখন কথাহল, মিলাদুননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে আমরা যদি কিছু করতে চাই, কী করতে পারি?
নির্ভেজাল এবং অথেনটিক আমল হতে পারে রোজা রাখা। নবীজি সোমবারে রোজা রাখতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে হুজুর বলেছিলেন, সোমবার আমার জন্মদিন। তাই আমি রোজা রাখি। আমরা যারা দাবি করতে চাই এবং মনেকরি নবীজির প্রতি আমার ভালোবাসা সবচে' বেশি, তাহলে প্রথম করণীয়, ভালোবাসাকে রবিউল আউয়ালকেন্দ্রিক করে না রেখে সারা বছর বিকশিত রাখা।
নবীজর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হল নবীর সুন্নতগুলোকে আপন করে নেয়া। নবীর ভালোবাসা যার মধ্যে যত বেশি থাকবে, তারমধ্যে সুন্নতের পাবন্দিও থাকবে বেশি।
অবশ্য নবীজির জন্মমাস রবিউল আউয়ালে একটা বাড়তি আবেগ কাজ করতেই পারে। সেটার প্রয়োগ আমরা ঘটাতে পারি অন্তত রবিউল আউয়ালের প্রথম তিন সোমবার রোজা রাখার মাধ্যমে। তবে এই রোজা জানান দিয়ে বা আয়োজন করে রাখা ঠিক হবে না। নবীজি এই রোজা রাখতেন কিন্তু সাহাবায়ে কেরামকে রাখতে বলেননি। যে কারণে আর কোন কোন সাহাবি রবিউল আউয়ালের সোমবারে রোজা রেখেছেন বা রেখেছিলেন কিনা, আমরা জানি না।
সাত
সুন্নতে রাসুলের ধার না ধেরে নূরের পেছনে ছুটছি আমরা!
অন্ধকারে হাতড়ে ফিরছি তাইয়াম্মুমের মাটি!
তাওয়া এবং মাটি, ফারাক করা দরকার।
নাসিরনগর হামলার ‘মূল হোতা’ জামিনে মুক্ত