ওয়ালি উল্লাহ আরমান
আলেম, সাবেক ছাত্রনেতা
শাহপরীর দ্বীপ বাহরুল উলূম মাদরাসার (বড় মাদরাসার) মুহতামিম মাওলানা হোসাইন আহমদ গতকাল মধ্যরাতে ইন্তেকাল করেছেন৷ তিনি এবং তার মাদরাসার নামটি আলোচনায় এসেছে এই মাস তিনেক হলো। তাও মানবতার কল্যাণে তাদের অনুকরণীয় ইতিবাচক ভূমিকার কারণে৷
গত তিন মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ওলামায়ে কেরামদের যারাই শাহপরী গেছেন, তাদের অধিকাংশই শাহপরী বড় মাদরাসার সহায়তায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হাতে ত্রাণ সাহায্য তুলে দিয়েছেন৷
বলাইবাহুল্য, এর সার্বিক তদারক করেছেন মরহুম মাওলানা হোসাইন আহমদ৷ সে কারণে মাওলানার মৃত্যু সংবাদে পরিচিতগণ শোকাহত হয়েছেন, ব্যথিত অনুভূতি ব্যক্ত করে কিছু লিখেছেনও৷
গত বছর দেড়েক যাবত আমি ত্রাণ সহায়তা নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতায়াত করছি৷ আর এই ত্রাণ সঠিকভাবে বিতরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় আলেম কিংবা দ্বীনদার ভাইদের সরাসরি সহায়তা নিতে হয়েছে আমাকে৷ তাদের কেউ কক্সবাজার ঈদগাঁর, কেউ উখিয়ার আবার টেকনাফেরও কেউ কেউ আছেন৷
আর এটা তো বাস্তব সত্যই, স্থানীয় বাসিন্দাদের অংশগ্রহণ কিংবা সম্পৃক্ততা ব্যতীত শত শত মাইল দূর থেকে গিয়ে টেকনাফ-উখিয়ায় শরণার্থীদের হাতে ত্রাণ তুলে দেয়া সহজসাধ্য নয়৷
গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রথমবারের মতো আমি মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবীর সাথে শাহপরী দ্বীপ বাহরুল উলূম মাদরাসায় গিয়ে খুলনা, মাগুরা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ প্রভৃতি দেশের প্রত্যন্ত জেলার আলেমদের দেখা পাই৷
দ্বিতীয়বারও শাহপরীতে গিয়ে মরহুম মাওলানা হোসাইন আহমদের সহায়তা নিতে হয়েছে আমাদের৷
দু’বারই দেখেছি, মরহুম মাওলানা হোসাইন আহমদ বাহরুল উলূম মাদরাসায় দূরদূরান্ত থেকে আগত আলেমদের মেহমানদারী করেন এবং দাতার পছন্দমতো স্বাধীনভাবে সহায়তা তুলে দেয়ার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাও করছেন৷
আমাদের এটা দেখে ভালো লেগেছে, তিনি নিজ মাদরাসার শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রতিদিন নবাগত শরণার্থীদের ডাটা সংগ্রহ এবং লিখিতভাবে টানিয়ে রেখেছেন৷ পরিবারের কতোজন এসেছে, নারী-পুরুষের সংখ্যা কতো, দুধের বাচ্চা, গর্ভবতী নারী, অসুস্থ, আহত, শিশু, বৃদ্ধ কতোজন সব লিখে রাখছেন৷ এর ফলে সহজেই প্রয়োজনানুপাতে সরাসরি শরণার্থীদের হাতে নগদ সহায়তা তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে৷
মাদরাসায় আসার পর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধপত্র, পরিধেয় কাপড় সরবরাহের পাশাপাশি দ্বীপ পার করে সাবরাং ঘাট থেকে ক্যাম্পের গাড়িতে তুলে দেয়ার দায়িত্বও পালন করেছেন৷
বাহরুল উলূম মাদরাসার অবস্থান বাংলাদেশের উপকূলীয় সীমান্তের শেষপ্রান্তে৷ ওপাড়ে বৈরী প্রতিবেশী মিয়ানমারের রক্তপিপাসু সৈন্যদের তৎপরতা৷ আবার মাদক, অস্ত্রের মতো ধ্বংসাত্মক এবং সমাজ ও দেশবিরোধী চোরাচালানীপণ্য ঢোকানোর রুট হিসেবে পরিচিত শাহপরীর দিকে প্রশাসনের কঠোর নজরদারী রয়েছে এবং এমন সতর্ক অবস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক৷
যতোদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার শাহপরীর দ্বীপে সহায়তা নিয়ে যেতে বাধা দেয়া হয়নি, বাহরুল উলূম কর্তৃপক্ষ তাদের মানবিক সহায়তার কাজ অব্যাহত রেখেছেন৷ এতে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক মরহুম মাওলানা হোসাইন আহমদ ও তার মাদরাসাকে নানারকম প্রতিকূলতা, কুৎসা এবং অপবাদও সইতে হয়েছে৷
অবশ্য চক্রান্তকারীদের অপপ্রচারের কারণও রয়েছে৷ অতীতে বছরের পর বছর ধরে ওখানকার জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালীরা শরণার্থীদের পুঁজি করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে৷
কিন্তু এবার শাহপরী দ্বীপের দুটি মাদরাসার তত্ত্বাবধানে দেশের নানাপ্রান্তের আলেমদের সরাসরি ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনার ফলে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র অবৈধ অর্থ কামাতে না পারার কারণে পত্রপত্রিকায় মিথ্যা সংবাদ প্রকাশে সম্মানহানী এবং প্রশাসনকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়রানীর চেষ্টা করেছে৷
প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছে যে মাদরাসায়৷ তাদের জরুরি সেবা দিতে ব্যতিব্যস্ত সেখানকার অপ্রশিক্ষিত জনবলের দিক থেকে সবরকম কাজের সুশৃঙ্খল, পুংখানুপুংখু এবং গোছালো কাজ আশা করাটা কি বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হয়ে যায় না? আর সেটাকে ভিত্তি করে অসত্য প্রচারণায় আস্থা রাখা কি সুবিবেচনার পরিচায়ক হতে পারে?
আফসোসের বিষয় হচ্ছে, ইসলাম আলেমবিদ্বেষী চিহ্নিত মিডিয়ার সেই অপপ্রচারে আমাদেরও অত্যুৎসাহী কোনো কোনো ভাই কণ্ঠ মিলিয়েছেন৷ তবে এক্ষেত্রে আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ দিতে চাই৷ তারা বিষয়টির সত্যাসত্য যাচাই করে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদন করেছেন৷
মাওলানা হোসাইন আহমদের দুনিয়া থেকে চিরবিদায়ের হৃদয়বিদারক সংবাদে শাহপরীর দ্বীপে রোহিঙ্গাদের খেদমতে তার অবদান, মুহাজিরদের খেদমতে ছুটে আসা সারা দেশের মেহমানদের অকৃপণ আপ্যায়নের সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্যগুলো আজ বারবার আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে!
কিছুই বলার নেই! ইন্না লিল্লাহি মা আখাজা ওয়া লাহু মা আ'তা৷
মহান রবের দরবারে মিনতি জানাই, ইসলাম ও মানবতার এই মহান খাদেমকে জান্নাতে শান্তিতে রেখো! তার নেক আমলগুলোর বহুগুণ বেশি জাযা দান করো৷ তার মিশন এগিয়ে নিতে তার যোগ্য উত্তরসূরীর ব্যবস্থা করে দিও৷ তার আপনজনদের সবরে জামিল দিও৷ তুমিই আমাদের সকলের যিম্মাদার হয়ে যাও মাওলা!!
টেকনাফের রোহিঙ্গাসেবক মাওলানা হোছাইন আর নেই