আলী আবদুল মুনতাকিম
অতিথি লেখক
বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা- দুই বাংলায় জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ এর অনেক নাটকের একটি ধারাবাহিক নাটকে বাকের ভাই নামে একটি মাস্তান চরিত্র খুবই জনপ্রিয় ছিল, তেমনই প্রধান চরিত্রের একটি জনপ্রিয় ডায়লগ ছিল ‘মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে।’
আজকের লেখার শিরোনাম নির্ধারণে ডায়লগটি মনে পড়ে গেল।
শিক্ষকের মাইরের ডরে ছাত্র পড়া না শিখে পারে না। গেরস্তের মাইরের ডরে চোর সতর্ক থাকে। এখানে অন্য কোন ভাইটামিনই কাজ করে না। মাস্তানের মাইরের ডরে সাধারণ মানুষ তটস্থ থাকে। এই ভাইটামিনের নাম কী? জানি না।
হয়ত এই ভাইটামিনের নাম দেয়া যায় ভয়। কিসের ভয়। মাইরে ব্যথা পাওয়ার ভয়, কষ্টের ভয়, বেইজ্জতি বা অপমানের ভয়। এই ভয়টাই একরকম ভাইটামিনের কাজ করে।
মাইর ও ঘুষের মধ্যে কোন সম্পর্ক বা মিল হয়ত নাই। যোজন-যোজন ফারাক থাকলেও তাদের চমৎকার অ্যাকশন বা ফলাফলে যথেষ্ঠ মিল আছে। ঘুষের কারণে পুকুর ভরাট হয়ে মাঠ হতে পারে, মাঠ খনন হয়ে পুকুর হয়ে যেতে পারে।
রাস্তা ফসলের ক্ষেত হয়, ফসলের ক্ষেত রাস্তা হয়। অপদার্থ হয় বড় বস বা কর্তা। যোগ্য কর্মকর্তা বস না হয়ে ওএসডি হয়ে বসে থাকে। ঘুষে এক লাখ টাকার টেন্ডার দশ লাখ হয়, ঘুষ না দিলে একলাখ টাকার বিল হয়ে যায় পঞ্চাশ হাজার হয়।
পরীক্ষার পাশ ফেল, চাকরির ইন্টারভিউর পাশ ফেলও ঘুষ নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুষ দিনকে রাত বানায়, রাতকে বানায় দিন। ঘুষ করে বেহুশ, ফিরায় হুশ। ঘুষখোর সাজে নির্দোশ। ঘুষ খুব আরাম খাবার। এর মধ্যে অনেক ভিটামিন আছে। যে ভিটামিনের প্রভাবে উক্ত কাজসহ বহু কাজ সহজ হয়। ঘুষে যে ভিটামিন আছে তার নাম কী? জানি না। হয়ত তার নাম হতে পারে প্রভাব।
ঘুষের প্রভাবে কত কিছুই সম্ভব। যেমনটি মাইরের ভয় দেখিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব। এখানেই দুটো কর্মের ফলাফলে অদ্ভূত মিল। সম্মানিত পাঠক ভাববেন আমি দুটো ভিটামিন মিলাতে যাচ্ছি কেন? নিশ্চয়ই মজার কারণ আছে! সেকথা বলছি, আমরা জানি দুটো নেগেটিভ মিলে পজিটিভ হয়। আজকের লেখার টারগেট হচ্ছে দুটো নেগেটিভকে মেলানো।
খবরে প্রকাশ মুন্সিগঞ্জের এক মসজিদের ওয়াকফের এক একরের বেশি জমির কিছু অংশ মসজিদ কমিটির এক কর্মকরতা বিক্রির জন্য ওয়াকফ অফিসে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করেন।খবর পেয়ে সাথে সাথে পুলিশ ধরে ফেলেন। মাইরের ভয়ে তিনি ড্রয়ারে থাকা অন্য ঘুষের আরও আশি হাজার টাকাও বের করে দেন।
খবরের কাগজে দেখেছিলাম কোন একটি উপজেলায় সিভিল প্রকৌশলী সাহেব ঠিকাদার থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন, কিন্তু বিল দিতে গড়িমসি করায় তার দপ্তরেই ঠিকাদার দ্বারা মারপিটের স্বীকার হন।
সম্ভবত ১৯৯৬ সালে ইনকাম টেক্স বা কর অফিসের এক কর্মচারীকে হোটেল রাজমনি ঈশাখাঁর মালিক জনাব আহসানউল্লাহ মনি থাপ্পর মেরেছিলেন। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছিল।
কিছু দিন আগে ঢাকার পল্টনস্থ হোটেল আজাদের মালিক আবুল কালাম আজাদ এক এসবি পুলিশ কর্মকর্তাকে ঘুষি মেরেছিলেন। পত্রিকার ভাষ্য মতে এসব মাইরের ইস্যু ঘুষ বলেই ধারণা করা হয়।
এভাবে গায়ে হাত তোলা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, আইন কেউ নিজের হাতে ও তুলে নিতে পারে না।আবার এটাও ঠিক যে, এসব মারপিটে সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তি হেদায়েত হয়ে যায়। ঘুষের উপর মাইর অনেক বড় দাওয়াই।
তারপরও অফিসে গিয়ে মাইর দিয়ে ঘুষ বন্ধ করার কোন সুযোগ নাই। কিন্তু ঘুষের মত নেগেটিভ কাজ বন্ধ করতে আর একটি নেগেটিভ দাওয়াই তো লাগবেই। সেটা মাইর না হয়ে অন্য শাস্তি ও হতে পারে।
ঘুষখোরদের জন্য হাশরে মাইর অপেক্ষা করছে। রাসুল সা়. বলেছেন। ‘ঘুষ দাতা ও ঘোষখোর উভয়ই দোযখের আগুনে জ্বলিবে।’
ঘুষ কেন লেন-দেন হয়? কিছু কারণ এ রকম-
১) অবৈধ সুবিধা আদায় ২) অবৈধ নথি পাশ করানো ৩) অবৈধ পদোন্নতির ব্যবস্থা ৪) অবৈধ অর্থ ছাড় করানো বা কামানো।
৫) অবৈধ সম্পদ সঞ্চয় করা বা ধরে রাখা ৬) কাউকে ফাঁসানো বা মামলায় জড়ানো ৭) আইনকে ফাঁকি দেয়া ৮) প্রভাব বিস্তার ৯) প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লোভ।
১০) রাজনৈতিক ফায়দা ১১) সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লোভ ১২) বড় ব্যবসায়িক ফায়দা
ইত্যাদি নানাহ কারণে ঘুষ লেনদেন হয়। হিসেব করলে দেখা যাবে বর্ণিত সব কারণই অন্যায় বা অবৈধ। এসব কারণ দেখিয়ে দোজখের শাস্তি থেকে বাঁচা যাবে না।
দোজখের মাইর সবচেয়ে বড় শাস্তি। সেটা চলতে থাকবে। সেখান থেকে ফিরে এসে সংশোধন হওয়ার
কোন সুযোগ নাই। দোজখের মাইর থেকে বাঁচার জন্য এখনই প্রস্তুতি থাকতে হবে।
ঘুষ দেয়াা যাবে না, ঘুষ নেয়া যাবে না। ঘুষখোরদের বর্জন করতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক