আতাউর রহমান খসরু
বার্তা সম্পাদক
সংকটের শুরু
দাওয়াত ও তাবলিগের কার্যক্রম শুরা ভিত্তিতে পরিচালিতে হবে, না আমির পদ্ধতিতে তা নিয়ে জটিলতা চলছে বেশ ক’বছর ধরে।
সংকটের সূত্রপাত তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিনে। কেন্দ্রের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের তাবলিগি কার্যক্রমে যথারীতি পড়েছে তার ছাপ।
দিল্লির নিজামুদ্দিনে অস্থিরতা শুরু হওয়ার বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় তাবলিগি মারকাজ কাকরাইলেও অস্থিরতা তৈরি হয়। ইতোমধ্যে কাকরাইলের তাবলিগি মুরব্বিগণ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সুবাদে সকলের কাছে স্পষ্ট।
আওয়ার ইসলামে প্রকাশিত দেওবন্দের একটি ঘোষণা
দিল্লির নিজামুদ্দিনের অস্থিরতায় যেন বিশ্বব্যাপী এ দীনী কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেজন্য উদ্যোগ নেয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ। দারুল উলুম দেওবন্দের পক্ষ থেকে মাওলানা সাদ-এর নিকট তার কতিপয় বক্তব্য ও তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এ নিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের সঙ্গে তার কয়েক দফা চিঠি বিনিময়ও হয়েছে। তবে দিল্লির সে সংকট এখনো দূর করা সম্ভব হয় নি।
কাকরাইলে অস্থিরতা
দারুল উলুম দেওবন্দের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামও কাকরাইলের মুরব্বিদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন এবং তাদের নানা পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু মূল মারকাজে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় এ পর্যন্ত কোনো আলোচনায় ফলপ্রসূ হয় নি।
মাওলানা সাদ-এর সঙ্গে উলামায়ে দেওবন্দ ও ভারতের অন্যান্য মুরব্বিদের সমস্যার সমাধান না হওয়ায় গত বছর তার তাবলিগি ইজতেমায় অংশগ্রহণ নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিঢাকার বিশ্ব তাবলিগি ইজতেমায় অংশ নেন এবং উল্লেখযোগ্য বয়ানও করেন।
এ বছরও ইজতেমার সময় ঘনিয়ে আসায় তার অংশগ্রহণের বিষয়টি আলোচনায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে। পূর্বের তুলনায় আরও কঠোর অবস্থান তৈরি হয়েছে তার পক্ষের ও বিপক্ষে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক
সব ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এবং এ মহান দীনি কার্যক্রমকে নিষ্কলুষ রাখতে গত ২৯ অক্টোবর (রোববার) রাতে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ধানমন্ডির বাসায় দেশের শীর্ষ আলেম, কাকরাইলের শুরা সদস্য ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক
বৈঠকে কাকরাইলের পক্ষ থেকে অংশ গ্রহণ করেন মাওলানা যোবায়ের, মাওলানা রবিউল হক, মাওলানা ফারুক, জনাব নাসিম, জনাব ওয়াসিফ ও জনাব ইউনুস শিকদারসহ শুরা সাথীগণ।
উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে অংশ নেন বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী, মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশের আমির ও গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব আল্লামা মাহমূদুল হাসান, বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মাওলানা আবদুল মালেক, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতি মোহাম্মদ আলী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা আনাস মাদানি প্রমুখ।
বৈঠকের ৩ সিদ্ধান্ত
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক সূত্র আওয়ার ইসলামকে বৈঠকের ৩ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানান,
১. সংকট সমাধান হওয়ার আগ পর্যন্ত জোড় ও ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভি আসবেন না।
২. উলামায়ে কেরাম ও কাকরাইলের শুরা সদস্যের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আছেন, কাকরাইলের মুরব্বি মাওলানা যোবায়ের, কাকরাইলের মুরব্বি জনাব ওয়াসিফুর রহমান, মাওলানা ওবাইদুল্লাহ ফারুক, মাওলানা মাহফুজুল হক এবং এ ৪ জনের বাইরে জনাব ওয়াসিফ একজনকে সংযুক্ত করতে পারবেন।
এ ৫ জন ভারত যাবেন। সেখানে মাওলানা সা'দ ও দেওবন্দ এর উলামাদের সাথে দেখা করবেন। মাওলানা সাদ ও স্থানীয় তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বিদের সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করবেন। মাওলানা সাদের ব্যাপারে দারুল উলুমের স্পষ্ট মতামত নিয়ে আসবেন। সব কিছু স্পষ্ট হলেই মাওলানা সাদসহ দিল্লির সব মুরব্বিগণ জোড় ও ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবেন।
৩. কাকরাইলের অভ্যন্তরীণ বিষয়াষয় ও শুরা সদস্যদের মধ্যে স্প্রীতি তৈরি ও দূরত্ব কমানোর জন্য শীর্ষ আলেমদের ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে রয়েছেন, আল্লামা আশরাফ আলী, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, আল্লামা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ও মাওলানা আবদুল মালেক।
উত্তরায় শীর্ষ আলেমদের পরামর্শ সভা, দেওবন্দের সঙ্গে সহমত ঘোষণা
এরই মধ্যে তাবলিগের চলমান সংকট নিরসনে দেশের শীর্ষ আলেমগণ গতকাল ১১ নভেম্বর ঢাকার উত্তরায় জরুরি পরামর্শ সভায় বসেছিলেন। তারাও বিষয়গুলো আলোচনা পর্যালোচনা করে ১৬ তারিখে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে সুষ্ঠু সমাধানের পথ নির্দেশনার আহবান জানান। পরামর্শ সভায় ৩টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
উত্তরায় আলেমদের পরামর্শ সভা
১. মাওলানা সাদের সকল বিতর্কিত বিষয়ের বিরুদ্ধে দারুল উলুম দেওবন্দের যে অবস্থান, বাংলাদেশের ওলামা তার সাথে একমত!
২. চলমান পরিস্থিতে মাওলানা সাদ বাংলাদেশে আগমন করলে এদেশের দ্বীনি অঙ্গনে ফেৎনা সৃষ্টির আশংকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং ওলামায়ে কেরাম কর্তৃক গৃহিত পদক্ষেপকে এ মাহফিলের পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানানো হচ্ছে এবং সকল ক্ষেত্রে দ্রুত কার্যকর করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
৩. সারা বিশ্বে প্রকাশমান এ সঙ্কটে মাওলানা সাদ এর ব্যাপারে দারুল উলূম দেওবন্দ, সাহারানপুর এবং আল্লামা আহমদ শফীসহ সারা বিশ্বের সকল ফতওয়া বিভাগ আস্থা প্রকাশ করার পূর্ব পর্যন্ত তাকে তাবলিগি কোন কাজে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হবে না।
সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু, ১৬ নভেম্বর যাত্রাবাড়ি বৈঠক
স্বরাষ্টমন্ত্রীর বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের শীর্ষ আলেমগণ চলতি মাসের ১৬ তারিখ তারা ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় একত্র হবেন। তারা হলেন, আল্লামা আশরাফ আলী, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, আল্লামা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ও মাওলানা আবদুল মালেক।
যাত্রাবাড়ী মাদরাসা একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদরাসায় বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে।
সেখানে কাকরাইলের শুরা সদস্যগণও উপস্থিত থাকবেন। মাওলানা যোবায়ের পাকিস্তানের রাইওয়ান্ডে অনুষ্ঠিত অংশগ্রহণ করলেও আজকালের মধ্যে দেশে ফিরবেন এবং ১৬ তারিখের বৈঠকে অংশ নিবেন বলে জানা গেছে।
ঢাকার সাথীদের আলাদা বৈঠক, মাওলানা সাদ-এর উপস্থিতির দাবি
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মাওলানা সাদ কান্ধলভি, মাওলানা ইবরাহিম ও মাওলানা আহমদ লাট কারো বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য জোড় ও ইজতেমায় অংশগ্রহণের কথা না থাকলেও তারা সবাই আসছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। এতে পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
এদিকে গত ৪ নভেম্বর শনিবার মিরপুর তাবলিগের মিরপুর শাখা মারকাজে এক মতবিনিময় সভা করেন ঢাকা জেলার তাবলিগি উলামায়ে কেরাম ও সাথীবৃন্দ।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিবৃতিতে জানা যায়, সভায় তারা নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
১. ৫ দিনেরে জোড় ও বিশ্ব ইজতেমা দিল্লির নিজামুদ্দিন থেকে মাওলানা সাদ কান্ধলভির সিদ্ধান্তকৃত ও পাঠানো জামাতকেই বাংলাদেশের তাবলিগি জামাতের সাথে যুক্ত উলামা হজরত ও সাথীরা গ্রহণ করবেন। তাদের পরামর্শক্রমে জোড় ও ইজতেমা পরিচালিত হবে।
সিদ্ধান্তের পক্ষে যারা স্বাক্ষর করেন
২. পাকিস্তান ভিত্তিক আলমি শুরা বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে বাংলাদেশর তাবলিগি জামাতের সাথে যুক্ত উলামা হজরত ও সাথীরা কোনোভাবেই মেনে নিবেন না।
৩. যেহেতু বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী শতাধিক দেশের বিদেশি মেহমানদের তাবলিগি কার্যক্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যার সমাধান মাওলানা সাদ দিয়ে থাকেন, তাই তিনি না আসলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না।
এমতাবস্থায় ২৯ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজামুদ্দিন মনোনীত দ্বিতীয় সারির কাফেলাই জোড়ে আসবেন। মাওলানা সা'দ, মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা ও মাওলানা আহমদ লাক কেউ আসবেন না। যদি মাওলানা ইবরাহিম দেওলা ও মাওলানা আহমদ লাখ কেউ ইজতেমায় আসেন তাহলে মাওলানা সাদও ইজতেমায় অংশ গ্রহণ করবেন।
উক্ত সিদ্ধান্তে স্বাক্ষরকারী জিম্মাদারহণ হলেন, ১. মুফতি মুজিবুর রহমান (সাভার), ২. মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (টঙ্গী), মাওলানা আলীমুদ্দীন (সাভার), মোঃ খালিদ ইকবাল (সাভার), আতাউর রহমান (মিরপুর), মাওলানা জাহিদ (কাকরাইল), মোহাম্মদ ইকরাম হোসেন (কাকরাইল), মাওলানা আবদুল কাদের (ডেমরা), মোঃ সাঈদ (কেরানীগঞ্জ) ও মাওলানা ছানাউল্লাহ (যাত্রাবাড়ী)।
মাওলানা সাদ বিষয়ে উত্তরার সভায় আলেমদের ৩ সিদ্ধান্ত
তাবলিগে সংকট ও কোটি হৃদয়ের আকুতি