যুবায়ের আহমাদ
খতীব ও কলামিস্ট
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশদের হাতে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগে ভারতবর্ষে মুসলিম শিশুদের শিক্ষা শুরু হতো কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে।
বিখ্যাত একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘Between the age of four and five years the Muslim boys and girls were required to attend the Primary Madrasah for their primary education. It was customary to start with Bismillah ceremony of a boy or girl at the age of four years, four months and four days.’ (A. R. Mallic, British policy and Muslim in Bengal : 149).
অর্থাৎ ‘মুসলিম বালক-বালিকাদের জন্য চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) মাদরাসায় ভর্তি হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
এটা ছিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা, যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হলে ‘বিসমিল্লাহ অনুষ্ঠান’ নামের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার শিক্ষার সূচনা হতো। ’ পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো, শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত।
৭০০ বছরের মুসলিম শাসনের সময় উপমহাদেশের মাদরাসাগুলোর ব্যয়ভার বহনের জন্য বিশাল সম্পত্তি ওয়াকফ করা ছিল। ব্রিটিশরা এসে প্রাথমিক শিক্ষার শত শত বছর ধরে চলে আসা সেই মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়। মাদরাসার জন্য ওয়াকফকৃত সম্পত্তিগুলো বাজেয়াপ্ত করে দিয়ে চাপিয়ে দেয় ধর্মহীন প্রাথমিক শিক্ষা।
ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা উদ্ধার হওয়ার পর সাধারণ ও মাদরাসা—এ দুই ধারার শিক্ষা চালু হয়। তবে সে সাধারণ শিক্ষাধারায়ও ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। আরবি ও ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে। এমনকি একাত্তরের রক্তস্নাত স্বাধীনতার পরও ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ছিল।
স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘আরবি ও ইসলামী শিক্ষা’ বিভাগ থেকে ‘আরবি’ ও ‘ইসলামী শিক্ষা’ আলাদা বিভাগ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারিত করেছিলেন।
বর্তমানেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষা চালু আছে। আছে মাধ্যমিকেও।
প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তত পাঁচজন শিক্ষক থাকেন। পাঁচজন শিক্ষকেরই কেউ না কেউ পড়ান ইসলাম শিক্ষা। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষক তা পড়ান, কিন্তু ইসলাম শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকরা তা পড়ান।
এর চেয়েও দুঃখের বিষয় হলো, অনেক স্কুলে ইসলাম ধর্ম পড়ান হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকা। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে অনেক রিপোর্ট হয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাকে ১১ জানুয়ারি, ২০১৭ এক রিপোর্টে বলা হয় ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ফরিদপুরের মানিকদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষকের ইসলাম শিক্ষা পড়ানোর কথা।
শ্রীমঙ্গলে ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম শিক্ষার এমন তথ্য উঠে আসে দৈনিক জনতায় ২ অক্টোবর, ২০১৬ সালের এক রিপোর্টে। এভাবেই ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক না থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু শিক্ষকরা ইসলাম শিক্ষা পড়ান।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক, ইসলাম শিক্ষার জন্য ক্লাসও নির্ধারিত থাকে; অন্য শিক্ষকরা তা পড়ান। এর স্থলে পঞ্চম শ্রেণির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের নামাজসহ ইসলামের মূল বিষয়গুলো শেখানো, তাদের নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলা এবং তাদের কোমল হৃদয়ে তাওহিদ ও রিসালাতের পাশাপাশি ইসলামের দেশপ্রেম, মানবতার ছবি মজবুতভাবে এঁকে দিতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষকের একজন ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিলেই সমস্যাটি থাকত না।
কোমলমতি শিশুরা তাদের ধর্ম শিক্ষার অধিকার পেত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষার এ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকার সারা দেশে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। ’ (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি, ২০১০)
শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক ঘোষণাই বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। তা বাস্তবায়িতও হয়েছে।
২০১১ সালে মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন তিনি। তা-ও আলোর মুখ দেখেছে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের ন্যায়সংগত অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। তা-ও বাস্তবায়নের পথে। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সে ঘোষণা আলোর মুখ দেখেনি আজও।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ইসলামী শিক্ষা নিশ্চিত হলে শিশুরা নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠত। ধর্মীয় আকিদা ও বিশ্বাস, নামাজসহ বিভিন্ন ইবাদত শেখার পাশাপাশি সত্য কথা বলা, পরোপকার করা, বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা করার মানসিকতা তৈরি হতো আবার সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের কোমল হৃদয়ে গড়ে উঠত শক্তিশালী অবস্থান।
এ ছাত্র বড় হয়ে সত্যবাদী হতো, দুর্নীতি ও অন্যায় থেকে দূরে থাকত। কিন্তু ইসলামে মানবতার যে মহান শিক্ষা আছে, তা দেশের সব মুসলিম শিশুকে যথাযথভাবে না জানানোর কারণে স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থীই আজ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।
হলি আর্টিজানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গির সবাই ছিল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। রোহান ইমতিয়াজ, মীর সাবিহ মুবাশ্বের ও নিবরাস ইসলাম স্কলাস্টিকা ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এদের মতো অনেক জঙ্গিই এমন, যারা ‘আধুনিক শিক্ষা’র নামে ইসলামী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই জঙ্গি হয়েছে।
দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনেও উঠে আসে এমনটিই। ‘জঙ্গি কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২ ছাত্র-শিক্ষক’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিত্তবান পরিবারের সন্তানদের বেশির ভাগই সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা পায় না। তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ধর্ম নিয়ে নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। সেখানে ধর্মান্ধ বন্ধু ও মতলবি শিক্ষকের পাল্লায় পড়ে ধর্মান্ধ হয়ে ওঠে। ’ (প্রথম আলো, ১ আগস্ট, ২০১৬)
‘আধুনিকতা’র নামে ধর্মীয় শিক্ষা না দেওয়ায় তরুণ-তরুণীরা বড় হতে থাকে, তখনই তারা ধর্মীয় জ্ঞানের শূন্যতা অনুভব করে। ধর্মীয় বিষয়গুলো জানতে দ্বারস্থ হয় ইন্টারনেটের। অন্যদিকে ইন্টারনেটের বিশাল এ উন্মুক্ত মাধ্যমে ফাঁদ পেতে রাখে বিপথগামী জঙ্গিরা।
বিপুল সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম ইসলামের ‘জ্ঞানার্জন’ করতে গিয়ে জঙ্গিদের ফাঁদে পা দেয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখতে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা দিতে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই প্রাথমিক শিক্ষায় ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। পাকিস্তান সিনেটে ‘Compulsory teaching of the holy Quran Bill, 2017’ আইন পাস করে শিক্ষার সব পর্যায়ে কোরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। (পাকিস্তান টুডে : ২৫ আগস্ট, ২০১৭)
সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলার মুসলিম দেশ তুরস্কের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক। নবীজি (সা.)-এর সিরাত (জীবনী) এবং কোরআনুল কারিমের অংশ মুখস্থ করাও বাধ্যতামূলক। ইসলামী শিক্ষা প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, ‘আমরা ধর্মপরায়ণ এক যুব প্রজন্ম তৈরি করতে চাই।
... আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করতে চাই, যারা রক্ষণশীল গণতন্ত্রবাদী ও গণতান্ত্রিক, যারা নাস্তিক নয়; জাতির নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বুকে লালন করবে। ’
আমাদের দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইসলাম শিক্ষা বা ধর্ম পড়ানোর জন্য শিক্ষক আছেন। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষার শিক্ষক নেই। অথচ শিশুকে আদর্শবান করে গড়ে তোলার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় শিশুকাল।
এ সময় শিশুরা যা শেখে, তা মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে স্থান করে নেয়। রিচার্ড এডওয়ার্ডের বিখ্যাত উক্তি—‘স্ট্রাইক হোয়াইল দি আয়রন ইজ হট (Strike while the iron is hot)’ লোহা গরম থাকতে থাকতে পেটাও! দেরি করলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
ঠাণ্ডা লোহা দিয়ে দা-কুড়াল হবে না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে শিশুকালের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিলে একদিকে যেমন নামাজসহ দৈনন্দিন ইসলামের বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখবে, তেমনি সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান থাকায় বিপথগামী জঙ্গিদের খপ্পর থেকেও নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কারি ও খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, বোর্ডবাজার, গাজীপুর।