কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ও সরকারি মান গ্রহণ এখন আলোচনার শীর্ষে। কওমি শিক্ষা ধারার ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘ দাবিও এটি। তবুও বিষয়টি প্রশ্নাতীত নয়। একদিকে যেমন আশান্বিত লাখো কওমি তরুণ, অন্যদিকে তেমন স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য হারানোর আশংকা করছেন অনেকেই। সংশয়বাদীরা টেনে আনছেন আলিয়া মাদরাসার উদাহরণ। কিন্তু কি ভাবছেন আলিয়া শিক্ষাধারার নীতি নির্ধারকগণ?
দেশের ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যত, আলিয়া মাদরাসা বর্তমান পরিস্থিতি ও কওমি মাদরাসার উপর সরকারি স্বীকৃতির সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘খুলনা আলিয়া কামিল মাদরাসা’র প্রিন্সিপাল ‘মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ যাকারিয়া’। কথোপকথনে তার সঙ্গে ছিলেন আতাউর রহমান খসরু।
আওয়ার ইসলাম : বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ইসলামি শিক্ষার অবস্থান কি এবং তার ভবিষ্যত কতোটা সম্ভাবনাময়?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : আল হামদুলিল্লাহ! বাংলাদেশের মানুষ ইসলামি শিক্ষায় আ্গ্রহী। তারা চায় তাদের সন্তান ইসলাম সম্পর্কে জানুক। দীনের মৌলিক শিক্ষা লাভ করুক। কারো প্রত্যাশা তাদের সন্তান দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত হোক এবং সাথে সাথে জাগতিক শিক্ষাও লাভ করুক। যাতে তাদের দুনিয়া-আখেরাত দুটোই হয়। এ শ্রেণির অভিভাবক তাদের সন্তানদের আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি করেন।
অন্য শ্রেণি চান তাদের সন্তান ধর্মীয় শিক্ষায় অধিক পারদর্শী হোক। তারা সন্তান কওমি মাদরাসায় ভর্তি করান।
আওয়ার ইসলাম : আলিয়া মাদরাসা কি অভিভাবকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : আমার মনে হয় , পারছে। পুরোপুরি না পারলেও পারছে। তবে এটা ঠিক একজন শিক্ষার্থী ধর্মীয় জ্ঞানে যতোটা সমৃদ্ধ হওয়া উচিৎ ছিলো তা হচ্ছে না। নায়েবে নবী (নবীর উত্তরসূরী) হিসেবে তাদের মধ্যে কিছুটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এজন্য অনেকাংশে দায়ী আলিয়া মাদরাসার বর্তমান সিলেবাস ও শিক্ষা কারিকুলাম।
সরকার ও সরকারের বাইরে থাকা একদল বামপন্থী বুদ্ধিজীবী -যারা চান না দেশে ভালো আলেম তৈরি হোক- তাদের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রের কারণে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এসব বু্দ্ধিজীবীদের হাত থেকে ইসলামি শিক্ষা রক্ষা করা প্রয়োজন।
আওয়ার ইসলাম : আপনি বললেন, পারছে না। কিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। কেনো?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : আমরা যখন আলিয়া মাদরাসায় পড়েছি, তখন আলিয়া মাদরাসার সিলেবাস, শিক্ষা কারিকুলাম ও পরিবেশ ছিলো খুবই সুন্দর। কিন্তু যখন শিক্ষার মান নিতে যেয়ে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের আলোকে তা ঢেলে সাজানো হলো, তখনই আলিয়া মাদরাসা তার বৈশিষ্ঠ্য হারালো।
ফাজিল ও কামিলের মান নেয়ার পর আলিয়া মাদরাসা সনদ নির্ভর হয়ে উঠেছে। ফলে ক্লাসের গুরুত্ব কমে গেছে। শিক্ষকের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। এখন আলিয়া মাদরাসার অনুসরণীয় হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই ক্লাস নেই, পড়ালেখা নেই। সুতরাং আলিয়া মাদরাসায়ও ক্লাসের গুরুত্ব কমছে।
ফাজিলের ক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা হলো, কলেজের সিলেবাস পরিপূর্ণ করে মান নিতে হচ্ছে। ফলে একজন শিক্ষার্থী যেমন দীনী ইলম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি বোঝা এড়াতে কলেজমুখী হচ্ছে। এ সমমানে উপকার হচ্ছে না। বরং মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলাম ঠিক রেখে সমমান দেয়া উচিৎ।
অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে যে কর্মস্থান হচ্ছে, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা তা থেকে বঞ্চিত। সুতরাং মাদরাসা শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহও কমছে।
আওয়ার ইসলাম : ক্লাস রুমে অনুপস্থিতি ও কর্মসংস্থানে বৈষম্য আলিয়া মাদরাসার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এটা কাটিয়ে ওঠার উপায় কি?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আমি বলবো, সরকার সমমান দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সেক্টরে সেসব কর্মকর্তারা বসে আছেন তাদের অনেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যপূর্ণ মনোভব পোষণ করেন। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সব জায়গায় প্রবেশ করুক তারা তা চায় না। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের তারা সাইড করে রাখেন। ফলে আইনের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এ সংকট কাটাতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। সরকারই পারে সমমান নিশ্চিত করতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক। আমরা চাই, বৈষম্য দূর করতে তিনি প্রশাসনকে জোর নির্দেশনা দিবেন।
কর্মসংস্থানে বৈষম্যের কারণে মাদরাসা শিক্ষা থেকে মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের কর্মস্থানের প্রসার করা প্রয়োজন। যেনো তারা নির্বিঘ্নে ইসলামের কাজ করতে পারে। তাহলে মাদরাসা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
ক্লাসে উপস্থিত করানোর বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক। আকর্ষণীয় পাঠদান পদ্ধতি, নিয়মিত ক্লাস, ক্লাসটেস্ট, ইনকোর্স ইত্যাদির ব্যবস্থা করলে; অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের উপাদেয় খোরাক দিতে পারলে তারা ক্লাসে উপস্থিত হবে।
আওয়ার ইসলাম : আলিয়া শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মীয় শিক্ষা ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয় করতে যেয়ে কি কি সমস্যা হচ্ছে?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : সমন্বয় করতে যেয়ে উপরের দিকে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু নিচের দিকে সিলেবাস অনেক ভারি হয়ে গেছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সতেরশো নম্বরের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। স্কুলের সব বিষয় ও মাদরাসার সব বিষয় পড়তে হচ্ছে তাদের।
উপরের দিকে সমস্যা হচ্ছে, মাদরাসার সাবজেক্ট কম আছে এবং সাধারণ সাবজেক্ট বেড়ে গেছে। তাই মাদরাসার শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা রক্ষা করে মান নিতে পারলে সেখানে যোগ্য আলেম তৈরি হবে। নতুবা দিন দিন অবস্থার আরও অবনতি হবে।
আওয়ার ইসলাম : শিক্ষা সনদের মান নেয়ার ক্ষেত্রে এক সময় আলিয়া মাদরাসা যেভাবে শুরু করেছিলো। আজ কওমি মাদরাসা সেভাবে শুরু করছে। আলিয়া মাদরাসা এখন তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসার প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : কওমি মাদরাসাগুলো ইদানিং সরকারের স্বীকৃতি নিতে আগ্রহী হয়েছে। সরকারও তাদের স্বীকৃতি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এটা ভালো দিক।
দেশের কোনো শিক্ষাব্যবস্থা সরকারের অবহেলা ও অনিয়ন্ত্রণে থাকা উচিৎ নয়। তবে লক্ষ্য রাখতে শিক্ষা সিলেবাস ও কারিকুলামে যেনো হস্তক্ষেপ না হয়। হস্তক্ষেপের সুযোগ পেলে সরকারের ভেতরে ও বাইরে থাকা কথিত বুদ্ধিজীবীরা কওমি মাদরাসার সর্বনাশ করে ছাড়বে।
সাথে সাথে দীনী শিক্ষার উদ্দেশ্য যেনো ব্যহত না হয় তা লক্ষ রাখতে হবে।
আমার প্রথম পরামর্শ থাকবে আলিয়া মাদরাসা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মান নিতে যেয়ে যেনো কোনোভাবে স্বকীয়তা নষ্ট না হয়। বিশেষ করে শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাসে হস্তক্ষেপের সুযোগ কওমি মাদরাসার জন্য আত্মঘাতী হবে।
কুরআন-হাদিস ও ধর্মীয় জ্ঞানের নিশ্চয়তা প্রদানের পরই কেবল অন্যকিছু গ্রহণ করা যাবে। নতুবা কওমি মাদরাসা থেকে ইলমের নাম-গন্ধ মুছে যাবে।
আওয়ার ইসলাম : বর্তমান সরকার আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। তার কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষায় তার কি সুফল বয়ে আনতে পারে?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের মুসলমানের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বহুদিনের দাবি। শতবছরের দাবিও বলা যায়। এজন্য সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনও ছিলো। আগে ফাজিল-কামিলের সার্টিফিকেট দিতো বোর্ড। কিন্তু বোর্ড সার্টিফিকেট দিতে পারে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এ জটিলতা দূর হবে।
এছাড়া তারা ইসলামি ভাবধারা অক্ষুণ্ন রেখে ইসলামি শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করতে পারবে।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় যেনো আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থাকে। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত না হয়। তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক থাকে।
আওয়ার ইসলাম : লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অক্ষুণ্ন রাখতে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিৎ?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : অবশ্যই যোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারাই তা পরিচালিত হতে হবে। আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিৎ যাদের কুরআন-হাদিস, ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে। ইসলামি শিক্ষার জন্য কোনটা ভালো হবে, কোনটা মন্দ হবে তা তাদের বুঝতে হবে। সাথে সাথে জাগতিক বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। পর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে তাদের দ্বারা জাতির প্রত্যাশা পূরণ হবে না। এমনকি তাদের উদ্দেশ্য সৎ থাকলেও তা সম্ভব হবে না।
আওয়ার ইসলাম : সরকার চাচ্ছে আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আলিয়া ও কওমি উভয় ধারার মাদরাসাকে সার্টিফিকেট দিবে। এটা কী সম্ভব?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : এটা একটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণযোগ্য। দীর্ঘ মেয়াদে তা সম্ভব হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে তা করতে হলে এক সিলেবাসে আসতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন কারিকুলামে পরিচালিত দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলতে পারবে না। এতে শিক্ষার মান রক্ষা করা যাবে না।
আওয়ার ইসলাম : আপনাকে দেখলাম ছাত্রদের সুন্নতি পোশাকের জন্য শাসন করছেন? সুন্নতি পোশাক ও আচরণের প্রতি কেনো গুরুত্ব দেয়া দরকার?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : আসলে শুধু শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ গড়া যায় না। আদর্শ মানুষ গড়ার জন্য প্রয়োজন নৈতিক দীক্ষা ও সুসংহত আচরণ শিক্ষা দেয়া। আর তা মুহাম্মদ সা. এর আদর্শ ও অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব। রাসুল সা. এর সুন্নাতের অনুসরণ ছাড়া কোনো মানুষ আদর্শ মানুষ হতে পারে না। পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না। এজন্য আমি সব সময় পরিবেশের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করি।
আওয়ার ইসলাম : আপনার মতো যারা দীনী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল তাদের প্রতি আপনার কি পরামর্শ থাকবে?
মাওলানা আবুল খায়ের যাকারিয়া : আমি আমার সহকর্মী ও বন্ধুদের বলবো, একজন আলেম শুধু চাকরি করে না। বরং তারা নবীর উত্তরসূরী ও দীনের খাদেম। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছাত্রদের জীবন গঠনের জন্য মনোযোগী হতে হবে। এটাকে দীনী দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা উচিৎ।