আলী আবদুল মুনতাকিম
অতিথি লেখক
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম মাস্তানির টাকায় কেনা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং একই পরিবারে একটির বেশি গাড়ি না কেনার নিয়মনীতি আরোপ করতে। বন্ধুমহলে লেখাটি এত সাড়া জাগাবে বুঝতে পারিনি। যারা ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাদের প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে আজকের বিষয়ে যেতে চাই।
ফুটপাথ দখল ও চাঁদা়বাজি নিয়ে দুএকটি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের প্রায় সব শহরের ফুটপাথই হকারদের দখলে চলে গেছে। দেশটা গরিব। লাখ লাখ বেকার যুবক বিনা কর্মে হতাশাগ্রস্ত বা বিষাদগ্রস্ত হয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। তাদের অনেকেই কিছু একটা করে খাওয়ার মানসে রেডিমেট গার্মেন্টস বা কাপড় জুতাসহ নানারকম পসরা সাজিয়ে ফুটপাথে বসে যায়। কাস্টমারও রাস্তায় জিনিস পেলে দোকানে ঢুকতে চায় না। বাস জমে যায় ব্যবসা।একেবারে রমরমা।
ফুটপাথে আপনি কি পাবেন না, জুতা, সেন্ডেল, ফিতা, মোজা, গেঞ্জি, লুঙ্গী, জাঙ্গিয়া, পেন্ট, ভেষজ ওষুধ, শাড়ি, শার্ট, চাদর, পেস্ট, ব্রাস, সাবান, কস্মেটিকস, ভাত-মাছ, ফাস্টফুড, স্লো ফুড, কাগজ পেন্সিল, বেটারি, ক্রোকারিজ, সবধরনের ফল, ফুল, মিষ্টি দই, ফোসকা, চটপটি, পত্রিকা, ভবিষ্যত দ্রষ্টা আর তাদের টিয়া পাখি ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ফুটপাথে এমন অনেক আইটেম আছে যা দোকানে পাওয়া যায় না।ফুটপাথ বন্ধ থাকলে হকার শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না অনেক গ্রাহক ও বিপদে পড়ে যান। হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় ফুটপাতে। কিন্তু এই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় শত কোটি টাকার চাঁদার বিনিময়ে।
চাঁদার টাকা কেউ বকেয়া রাখতে পারে না। যেমন করে সিএনজি পাম্পে কেউ বকেয়া গ্যাস নেয় না বা সিনেমা দেখার টাকা কেউ বকেয়া রাখতে পারে না। ফুটপাতে একদম কাঁচা টাকা। নগদ নারায়ন। টাকায় মৌ মৌ গন্ধ। কিন্তু এই কাঁচা টাকার দখল নিতে যে কত রক্ত ঝড়ে তার খবর কতজন রাখে? আন্ডারগ্রাউন্ডে মাস্তানে-মাস্তানে খুনোখুনি যেন পান্তাভাত।
ফুটপাথে যারা হকারি করে তাদের এরিয়া ভাগ করা আছে। যেমন ভাষানী স্টেডিয়াম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম হয়ত একজন নিয়ন্ত্রণ করে, বায়তুল মোকাররমের চতুর্দিক ও উত্তরগেট অন্যজন নিয়ন্ত্রণ করে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ একজন, গুলিস্তান হল মার্কেট এরিয়া আরেকজন নিয়ন্ত্রণ করে। ঢাকা ট্রেড সেন্টার এরিয়া ও নবাবপুরের মুখে সুন্দরবন মার্কেট এলাকা আলাদা নিয়ন্ত্রক রয়েছে।
এমন শত এলাকার নাম বলা যাবে। নিউ মার্কেট নীলক্ষেত থেকে বাড্ডা খিলক্ষেত, মিরপুর-দিয়াবাড়ী থেকে সায়দাবাদ-যাত্রাবাড়ী, চট্রলা, মংলা, পাবনা, তেতুলিয়া, সিলেট, কুমিল্লা সবখানেই হকারে হকারে একাকার।
এবার আসা যাক ফুটপাথে মাস্তানিটা হয় কিভাবে!
রাজধানী ঢাকার কথাই বলি। প্রতিটি হকারের আলাদা আলাদা কাঠের চৌকি থাকে। চৌকির জায়গাটুকুই তার অস্থায়ী মালিকানা। যারা চৌকি ব্যবহার করে না তারা পলিথিন বিছায়। পলিথিন যতটুকু জায়গা নেয় ততটুকুর জন্যই তাকে প্রতিদিনের ভাড়া গুনতে হয়। চকি বা পলিথিন কোথায় বসবে তা ঠিক করে দেবে পাতি নেতা বা মাস্তান। মাস্তানের কথা যা তাই শুনতে হবে। এদিক সেদিক হলে মাইর।
কঠিন নিয়ম ফুটপাথে। তাদের নিয়মের কাছে অফিস আদালত ফেল। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফেল, মাননীয় মেয়রও ফেল। তারা নেতৃত্ব দেয় মাইকে ঘোষণা দিয়ে। ঘোষণা বছরের পর বছর চলতে থাকে। দল যতদিন ক্ষমতায় থাকে ততদিন নিশ্চিন্তভাবে কাঁচা টাকার চাঁদাবাজী চলে।
তাদের উচ্ছেদে সরকার যথেষ্ঠ আন্তরিকতা দেখিয়েছে। কিন্তু লাভ হয় নি। মাস্তানরাই জিতেছে। তাদের ছাড়া আবার দলগুলো অচল। কারণ তারাই মিছিলের খোরাক। মিছিল করতে তাদের লাগে। মারামারি করে তারাই রাজপথ দখলে রাখে। দলকে ক্ষমতায় আনে। সুতরাং তারাতো ফুটপাথ দখল করবেই। তাদের সরানো এত সহজ নয়।
আওয়ার ইসলামের ১ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে আমার অতিথি হয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান অতিথি ছিলেন। প্রেসক্লাব ভিআইপি লাউঞ্জে মুগ্ধ হয়ে তার বক্তৃতা শুনেছি। তিনি চমৎকার কথা বলেন। তার কাছে কোন বিষয়ে আশা করা যায়। অনেক সজ্জন মানুষ তিনি।
ফুটপাথ দখলের নেতৃত্বে কারা, মেয়রের ফুটপাথ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ কেন বিফল হয় সদাশয় সরকারের বিশেষ করে সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্ররণালয়ের সবচেয়ে বেশি ভাল জানার কথা। মানুষের সহজ চলাচলের ফুটপাত/রাস্তা দখলমুক্ত করা জরুরি। মাস্তান বা দলীয় ক্যাডার যতই শক্তিশালী হোক নিয়মনীতির কাছে তুচ্ছ।
নিয়মনীতি করাই হয় জনগণের কল্যাণে, এমনিক মাস্তানরাও এ কল্যাণের ভাগিদার।
নিয়ম হচ্ছে ফুটপাথ দিয়ে মানুষ হাঁটবে, রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলবে। ফুটপাথ দখলের কারণে মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটে, ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়ি ভাংচুর হয়। সেটাও আবার সামাল দেয় মাস্তানরাই। চাঁদাবাজী একটি সামাজিক অপরাধ, এর দাতা গ্রহীতা উভয়কেই দণ্ডের আওতায় আনা দরকার।
নিয়মনীতির তথা আইনের কঠোর প্রয়োগ শুরু হলে ফুটপাথের মাস্তান যেমন ঠাণ্ডা হবে তেমনি রাস্তা-ঘাটও ঠাণ্ডা হবে। মানুষ শান্তি পাবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক
এই লেখকের আরও লেখা
মাস্তানতন্ত্র জিন্দাবাদ, নিয়মনীতি মুরদাবাদ-১
বার্মার বর্বরতার চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি
লিবিয়ায় হলে মিয়ানমারে কেন জাতিসংঘের নেতৃতে বোমা বর্ষণ নয়?