পলাশ রহমান
অতিথি লেখক
বাংলাদেশে এখন সব হয়। বাংলাদেশিরা এখন সব করে। যুবক-যুবতীরা অবাধে প্রেম করে। অভিভাবকরা বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড কালচাল মেনে নিয়েছেন। পরকীয়াও বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে।
সেলিব্রেটি পরকীয়ার এখন বেশ কদর। ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে লিভটুগেদার চলছে দেদার। কেউ দেখে না, বোঝে না, তা কিন্তু নয়। সবাই মেনে নিয়েছে। গা'সওয়া হয়ে গিয়েছে।
মেয়েরা জিন্স, টিশার্ট, স্কাট, থ্রিকোয়াটার, ছেলেরা হাফপ্যান্ট পরতে শুরু করেছে অনেক দিন থেকে। তরুণ যুবকরা বাংলিশে কথা বলে। ভাত, ভাজি, ভর্তা তাদের কাছে 'পেইন' মনে হয়। তারা পিজা, বার্গারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
ছোট বড় সব শহরেই এখন মদের দোকান আছে। ডিস্কো বার, ক্লাব, সবই আছে। ছেলে মেয়েরা লেট-নাইট পার্টি করে। ডিজে করে। আরো কতো কি!
অফিস আদালত থেকে শুরু করে ঘরোয়া পার্টি, কোথাও এখন মদ ছাড়া চলে না। মদ ছাড়া কোনো পার্টি হয় না। পতিতালয়, মদের কারখানা, এসব তো অনেক পুরনো বিষয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশে এখন সব হয়।
সম্প্রতি সুন্দরী প্রতিযোগিতা করা হয়েছে। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও করা হয়েছে। তখন হালকা বিরোধিতার মুখে পড়তে হলেও এবার হয়নি। কোনো মহল থেকে বিশেষ কোনো প্রতিবাদ বা বিরোধিতার কথা শোনা যায়নি। বিশেষ করে দেশের ইসলামি মহল থেকেও প্রতিবাদ উঠতে দেখা যায়নি।
হতে পারে তারাও 'আধুনিক' হয়ে উঠেছে। তাদেরও গা'সওয়া হয়ে গিয়েছে। অথবা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত যে অন্য কোনো দিকে তাকানোর ফুসরত তাদের নেই। থাকবেই বা কি করে, তারা তো মূলধারা থেকে অনেক দূরে। তাদের বসবাস অন্য জগতে, নিজস্ব গণ্ডিতে।
সে যা'ই হোক, বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার জন্য বাছাই করা বাংলাদেশের সেরা সুন্দরী নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া এখন বেশ গরম। প্রথমে যাকে সেরা সুন্দরীর মুকুট পরানো হয়েছিল, তিনি ছিলেন ডিভোর্সি।
২৩ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। বেশি দিন সংসার করা হয়নি। স্বামীর ঘর ছেড়ে তিনি রঙ্গিন আলোর সাথে ঘর বেঁধেছেন। আর এতেই ঘটে যায় যতো বিপত্তি।
সুন্দরী প্রতেযোগিতার অন্যতম শর্ত হলো 'বিবাহিতা' হওয়া যাবে না। সে কুমারী, কি অকুমারী সেটা বড় কথা নয়। কথা হলো বিবাহিতা হতে পারবে না। সন্তান থাকা চলবে না।
প্রথম সুন্দরীর বিয়ে হয়েছিল। তিনি সেটা গোপন করে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তার প্রথম হওয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বিচারকদের বিচারে তিনি প্রথম হননি, প্রথম হয়েছেন আয়োজকদের ম্যানেজ করে।
কিন্তু এসব অভিযোগ পেছনে ফেলে সব থেকে বড় হয়ে দেখা দেয় তার সাবেক 'বিয়ে'। ওই বিয়ের খবর প্রচার হয়ে গেলে তিনি ওটাকে বাল্য বিয়ে বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছেন। মানুষের সহানুভুতি কুড়াতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তার মুকুট কেড়ে নিয়ে অন্য একজনকে পরানো হয়েছে।
এখন যাকে সুন্দরীর মুকুট পরানো হয়েছে তার সৌন্দর্য, যোগ্যতা নিয়েও এরই মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এসব নিয়ে নয়। আমার প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ কেনো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যাবে? বাংলাদেশে কেনো সুন্দরী প্রতিযোগিতা হবে?
আমি মনে করি কথিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে আমাদের সংস্কৃতির 'নিজস্বতা' নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা এসব করছে তারা আর যাইহোক, আমাদের সংস্কৃতির মানুষ নয়। তারা আমাদের মানুষ নয়।
বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। আমাদের প্রতিটি আচার-আচারণের সাথে ধর্মীয় প্রভাব মিলে মিশে আছে। আমরা সামাজিক, পারিবারিকভাবে ধর্মীয় আচার বান্ধব সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত।
তাছাড়া ধর্মের বাইরে গিয়েও আমাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। আমাদের সংস্কৃতির নিজস্ব একটা রুপ আছে। যেখানে নগ্নতা, উগ্রতা বা যৌনতার বিশেষ কোনো জায়গা নেই।
আমাদের সব কিছুতে একটা নিজস্ব বলয় আছে। একটা ভাব আছে, আভিজাত্য আছে। ভারসাম্য আছে। আমি মনে করি কথিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে আমাদের সংস্কৃতির 'নিজস্বতা' নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা এসব করছে তারা আর যাইহোক, আমাদের সংস্কৃতির মানুষ নয়। তারা আমাদের মানুষ নয়।
সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কী হয়, কিভাবে হয় তা প্রায় সবারই জানা। ১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যের এরিক মোরলে মিস ওয়ার্ল্ড বা বিশ্ব সুন্দরীর প্রতিযোগিতা শুরু করেন।
বলা হয় মেয়েদের মেধা এবং দেহ সৌষ্ঠবের জন্যেই এই প্রতিযোগিতা। কিন্তু আসলেই কি তাই? মেধা বা নিজের লাবণ্য, সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য কাপড় খুলতে হয়? বিকিনি পরে নেচে গেয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়? প্রতিটা স্টেপে শরীরের মাপ দিতে হয়? যদি হয়ও, এটা কি আমাদের সংস্কৃতি?
আমাদের সংস্কৃতির সাথে সুন্দরী প্রতিযোগিতা নামের কথিত সংস্কৃতির কোনো মিল আছে? এটাকে কি আমাদের সংস্কৃতির সাথে মেলানো যায়?
বিশ্ব এখন প্রতিযোগিতা মুখর। সব কিছুতেই প্রতিযোগির হুড়পাড় চলছে। তাই বলে নিজস্বতা বলে কিছু থাকবে না? রুচি, আদর্শ বলে কিছু থাকবে না? একটা কিছু পেলেই ঝাপিয়ে পড়তে হবে? আমার আদর্শ, রুচি, সংস্কৃতির সাথে যায় কি না তার কোনো বাছবিচার হবে না? এ কেমন অসুস্থতা? এ কেমন মানষিক রুগ্নতা?
যারা কথায় কথায় নীতি কথা বলেন, নারীবাদের কথা বলেন, মানবতার কথা বলেন তারা কি খেয়াল করেছেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের শর্তই হলো অবিবাহিতা হতে হবে। সন্তান থাকা চলবে না। এটা কি এক ধরনের নারী নির্যাতন নয়? নারী কে অসম্মান করা নয়?
আমি যখন প্রথম বিদেশে আসি সে সময়ের কথা- ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি। আমাকে প্রথম প্রশ্ন করা হলো বিবাহিত কিনা? বললাম, না, বিবাহিত না। আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হলো- সন্তান আছে কি না? এই প্রশ্ন আমাকে এতটাই অবাক করেছিল যে আমি কোনোভাবেই মেলাতে পারছিলাম না, কেনো আমাকে এমন প্রশ্ন করা হলো? আমি তো বলেছি, অবিবাহিত। তবু কেনো সন্তানের প্রশ্ন উঠলো?
যারা সুন্দরী প্রতিযোগিতা করে তারা এক একজন নারী নির্যাতক। মুখোশের আড়ালে এক একজন দাঁতাল ধর্ষক।
পরে জেনেছি, ইউরোপীয় সভ্যতায় সন্তানের পিতা বা মাতা হওয়ার সাথে বিবাহের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা দুইটা বিষয়কে আলাদা করে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তো এখনো আলাদা করা হয়নি। আমরা কেনো এই শর্ত মেনে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যাবো? আমাদের মেয়েরা কেনো কাপড় খুলে তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করবে?
মজার বেপার হলো- যারা বাঈজি প্রথার নিন্দা করে, ওটাকে নারী নির্যাতনের সাথে তুলনা করে, তারাই আবার সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে সুন্দরীদের নগ্নতা উপভোগ করে।
আমি মনে করি এটা এক প্রকারের শষ্ঠতা, ভণ্ডামি। যারা সুন্দরী প্রতিযোগিতা করে তারা এক একজন নারী নির্যাতক। মুখোশের আড়ালে এক একজন দাঁতাল ধর্ষক। তাদের ফাঁদে পা দেয়া কোনো ভাবেই ঠিক হবে না নারীদের।
কোনো যুক্তিতেই বাংলাদেশে সুন্দরী প্রতিযোগিতা হতে পারে না। বাংলাদেশকে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যেতে দেয়া যায় না। শুধু সুন্দরী প্রতিযোগিতা কেনো, এমন কোনো প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে পারে না যে প্রতিযোগিতার সাথে আমাদের সভ্যতা, আদর্শ, নিজস্ব সংস্কৃতির কোনো মিল নেই।
যে প্রতিযোগিতায় মনের, মস্তিষ্কের সৌন্দর্যের চেয়ে যৌনাঙ্গের সৌন্দর্য প্রাধান্য পায় সে প্রতিযোগিতা আমাদের জন্য নয়। সে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ যাবে না, যেতে দেয়া যায় না।
লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি