সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
চিকিৎসকরা বছরে দুইবারের বেশি বিদেশ যেতে পারবেন না ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের

জার্মান নির্বাচনে নব্য নাৎসির উত্থান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আনিস আলমগীর

জার্মান সংসদের নির্বাচন হয়ে গেলো সম্প্রতি। দেশটির সংসদীয় আসন সংখ্যা ৭০৯। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩৫৫ আসন। গত সংসদ নির্বাচনেও কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়নি। এবারও কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। পুনরায় কোয়ালিশন সরকার হবে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে। কারণ তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।

জার্মানে এবারের সংসদ নির্বাচনে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি আসন পেয়েছে ২৪৬টি, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি আসন পেয়েছে ১৫৩টি, ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি পেয়েছে ৮০টি, অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড পার্টি পেয়েছে ৯৪টি, গ্রিন পার্টি পেয়েছে ৬৭টি আর দ্য লেফট পেয়েছে ৬৯টি আসন।

সমগ্র ইউরোপ উদ্বিগ্ন হয়েছে জার্মান নির্বাচনে অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড পার্টির (এএফডি) উত্থানে। এ নির্বাচনে তারা ৯৪টি আসন পেয়েছে। তারা হচ্ছে নব্য নাৎসি দল। নাৎসিদের উত্থানও হয়েছিল হঠাৎ করে। ক্ষমতা লাভের দুই বছর আগেও অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির নাগরিক প্রজা পর্যন্ত ছিলেন না। হিটলার একজন জার্মান অস্ট্রিয়ান। সৈনিক হিসাবে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

জার্মানির একজন প্রসিদ্ধ দার্শনিক ছিলেন। তার নাম অসভাল্ড স্পেংলার। তিনি বলপ্রয়োগ নীতিতে বিশ্বাসী ও বলপ্রয়োগ নীতির প্রচারক ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ হচ্ছে একটি শিকারি পশু, সাহসী, ধূর্ত ও নিষ্ঠুর’, ‘আদর্শবাদ মানেই কাপুরুষতা’। শিকারি জন্তুই হচ্ছে জীবন্ত প্রাণশক্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তার ভাষায়–‘সহানুভূতি, আপস ও শান্তি হচ্ছে দন্তহীন অনুভূতি’। ‘ঘৃণা শিকারি পশুর সবচেয়ে খাঁটি জাতিগত চেতনা’।

স্পেংলারের মতে মানুষকে হতে হবে ‘সিংহের মতো, তার গর্তে নিজের সমান শক্তিশালী আর একজনের অস্তিত্ব সে কিছুতেই বরদাস্ত করবে না। শান্তশিষ্ট গরু পালে মিশে থাকে, তাকে যে দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, সে দিকেই চলে। তার মতো হলে মানুষের চলবে না। সেই সিংহতুল্য মানুষের পক্ষে যুদ্ধই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ ও আনন্দের’। অনেকে মনে করেন, দার্শনিক স্পেংলারের ‘জবরদস্তবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিটলার নাৎসি পার্টি গঠন করেছিলেন। ভার্সাই সন্ধি নিয়ে হিটলারের মনে দুঃখ-বেদনা ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়কে আর দাসত্বমূলক ভার্সাই সন্ধিকে কোনোভাবেই হিটলার মেনে নিতে পারেননি।

সে কারণেই প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহায় হিটলার মাত্র ৬ জন সহকর্মী নিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসে তার নাৎসি পার্টি গঠন করেছিলেন। তার দলের চিহ্ন ছিল ব্রাউন শার্ট। ইতালির ফ্যাসিস্টদের ছিল ‘ব্ল্যাক শার্ট’। হিটলার ছিলেন বাগ্মী। তার বাগ্মিতাই তার পার্টিকে সমগ্র জার্মানিতে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ভেঙে দেওয়া জার্মান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দলে দলে তার দলে যোগ দিয়েছিলেন। জার্মানিতে ইহুদি সম্প্রদায় ছিল শীর্ষ স্থানীয়। ধনে-জনে-জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তাদের তুলনা ছিল না। তাদের প্রতি জার্মানিদের বিদ্বেষ ছিল প্রবল। হিটলার এ বিদ্বেষকে তার বক্তৃতায় উস্কিয়ে দিতেন। তিনি বলতেন ‘জার্মানিরা আর্য। জার্মান জাতির জীবনমান কলুষিত হয়ে যাচ্ছে ইহুদিদের সংস্রবে’। তিনি জার্মান জাতির সম্ভ্রম উঁচুতে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিতেন।

জার্মানের পার্লামেন্টের নাম রাইখস্টাগ। এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হিটলারের নাৎসি পার্টির মতো নব্য নাৎসি দল অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড পার্টির উত্থান দেখে আমি হিটলার সম্পর্কে এত কথা লিখলাম।

এবারের নির্বাচনে এএফডি (নব্য নাৎসি) পার্টি আর্যবাদের স্লোগান তুলেছে। হিটলার যেমন ইহুদিবিদ্বেষ প্রচার করেছিলেন, এএফডি মুসলিমবিদ্বেষ প্রচার করছে। দশ লাখ মুসলিম শরণার্থী সম্পর্কে বহু রকমের কটু কথা বলছে। আবার জার্মানির সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এসব জঞ্জাল মুক্ত করার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে।

জানি না মুসলমানরা ইহুদিদের মতো ভবিষ্যতে গ্যাস চেম্বারের বলির পাঠা হয় কিনা! নব্য নাৎসি দল অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের প্রধান বলেছে, তারা জার্মানির রাজনীতি থেকে সবাইকে বিতাড়িত করে জার্মান জাতিকে ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনবে।

জার্মানির একটি পত্রিকা অন লাইনে ব্লক খুলে ভোটারকে প্রশ্ন করেছে, কেন আপনারা অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড পার্টিকে ভোট দিলেন? সব ভোটারই বলেছে, মুসলিম শরণার্থীদের কারণে। কারণ তারা জার্মান জাতির ঐতিহ্য ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিনষ্ট করবে। নব্য-নাৎসির শেখানো বুলি।

অথচ এখন জার্মান জাতির উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চাইলে তাদের বিদেশ থেকে ৮ লাখ শ্রমিক আনতে হতো। শরণার্থীরা তাদের শ্রমিক আনার ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

অ্যাঙ্গেলা ম্যারকেল পূর্ব জার্মানির অধিবাসী। তিনি পশ্চিম জার্মানদের সঙ্গে মিশলেন বার্লিন প্রাচীর ধ্বংস হওয়ার পর। প্রথমে হেলমুট কোল-এর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। পরে চ্যান্সেলর হয়েছেন। তার চ্যান্সেলরশিপের তিন টার্ম অতিক্রম করে এবার চতুর্থবার চ্যান্সেলর হলেন। এবার তার কোয়ালিশনে পার্টনার হচ্ছে ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি আর গ্রিন পার্টি। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবার তার কোয়ালিশনের পার্টনার হচ্ছে না। তারা বিরোধী দলে অবস্থানে নেবে। তারা রাইখস্টাগ-এ এবারের নির্বাচনে দ্বিতীয় বৃহত্তম আসনে বিজয়ী দল।

স্যোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির এ সিদ্ধান্ত অভিনন্দনযোগ্য। তাদের ভুলের কারণে হিটলারের উত্থান হয়েছিল। কারণ তখন সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সমর্থন করেছিল হিডেনবার্গকে। হিডেনবার্গ ছিলেন সামরিক বাহিনীর লোক। জেনারেল হিডেনবার্গও মনে মনে উৎফুল্ল হতেন হিটলারের কথায়।

স্বপ্নে বিভোর হতেন ভার্সাই সন্ধির প্রতিশোধ গ্রহণের আশায়। একজন পরাজিত জেনারেলের পক্ষে যা স্বাভাবিক ছিল। হিটলারের কোয়ালিশন কখনও ক্ষমতায় আসতে পারতো না, যদি হিডেনবার্গ তলে তলে তাকে সমর্থন না করতেন। এবার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ তারা কোয়ালিশনের পার্টনার হলে বিরোধী দলের আসনে বসবে নব্য নাৎসিরা।

তারাই হচ্ছে রাখাইস্টাগ এ তৃতীয় বৃহত্তম দল। তাদের মানুষ বিকল্প সরকার হিসেবে এখন চিন্তা করবে না। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটেরা আর সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা শক্তিশালী উদ্যোগ নিলে আগামী নির্বাচনে নব্য নাৎসিবাদের অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ