অতীতের সব ইতিহাস ছাপিয়ে এবারের রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ কোমল হৃদয় মানুষকে অভিন্ন মানবিক অবস্থানে একত্র করেছে। মানবিক মূল্যবোধ সাড়া জাগিয়েছে পুরো জাতির হৃদস্পন্দনে। দেশের সর্বশ্রেণির মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের। গণমানুষের এ আবেগ অনুভূতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ দেশের আলেম সমাজ। আলেমদের অসংখ্য কাফেলা কাজ করছে সেখানে।
এমনি একটি কাফেলার সদস্য হয়েছিলেন নন্দিত লেখক ও সাংবাদিক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। তিনি গত ১৮ সেপ্টেম্বর সেখানে যান এবং দুদিন কাছ দেখে দেখেন, পর্যবেক্ষণ করেন রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি। তার সে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে। পাঠকের সেবায় তার মূল্যবান পর্যবেক্ষণ ও ভাষ্যের লেখ্যরূপ দিয়েছেন আতাউর রহমান খসরু।
আমি টেকনাফে দুই দিন ছিলাম। দুই দিন সময় পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট নয় এবং সম্পূর্ণও নয়। কেউ দুই তিন সপ্তাহ থাকলে সে হয়তো যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারবে। তবুও চোখের দেখা ও মানুষের সাথে আলোচনা করে আমার অনুভূতিতে যা ধরা পড়েছে তা থেকে আমি বলছি।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। দীর্ঘ কয়েক দশকের এ সমস্য। তবে এবার রোহিঙ্গা সংকটে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় তাহলো উলামায়ে কেরামের অংশগ্রহণ। অতীতেও তারা মানুষের দুঃখ, দুর্যোগ ও দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এতোটা চোখে পড়ে নি। গত চার-পাঁচ বছর যাবত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগের মুহূর্তে উলামায়ে কেরাম অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনার থেকে বিষয়টি চোখে পড়ছে। সেখানে উলামায়ে কেরামের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিলো। তরুণ আলেম এবং কোনো কোনো প্রবীণ আলেমও রক্ত দিয়ে, ত্রাণ দিয়ে রানা প্লাজার উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এরপর বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ছোট ছোট সংকটে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের উলামায়ে কেরামের অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতা আমরা লক্ষ্য করছিলাম।
উলামায়ে কেরামের সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণের একটি ইতিবাচক বিস্ফোরণ টেকনাফ-উখিয়াসহ মুহাজিরদের আশ্রয় অঞ্চলে এবার দেখা গেলো। এতো সংখ্যক উলামায়ে কেরাম সেখানে গিয়েছেন এবং কাজ করছেন যা অভ‚তপূর্ব। এটা খুবই ইতিবাচক ও ভবিষ্যতের জন্য সুলক্ষণ। তরুণ আলেমদের অংশটি এখানেও বড়। আমি এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। সিনিয়র আলেমদেরও একটি গ্রুপ সেখানে গেছেন এবং যাচ্ছেন। দেশের ভবিষ্যত সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বিষয়টি সুফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি।
আলেমদের কাজগুলো এভাবে ভাগ করে বলা যায়, ইসলামি রাজনৈতিক দল, অরাজনৈতিক সংঘ, বিভিন্ন মাদরাসা, উলামায়ে কেরামের স্থানীয় ও আঞ্চলিক সংগঠন, মসজিদ ভিত্তিক দল নানাভাবে তারা সেখানে গিয়েছেন।
উলামায়ে কেরামের ব্যাপক অংশগ্রহণের বিষয়টি আমি এভাবে ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করছি, আলেমরা সেখানে গিয়েছেন ঠিক, কিন্তু তারাই সব দিয়েছেন বিষয়টি এমন নয়। বরং তারা বাংলাদেশের গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কোনো মসজিদের খতিব চার-পাঁচ জন লোক নিয়ে গিয়েছেন এবং দশ লাখ টাকা বিতরণ করেছেন। এ দশ লাখ শুধু তার একার নয়। এখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে। গণমানুষের প্রতিনিধিত্বই আলেমরা সেখানে করেছেন। তারা মানুষকে সচেতন করেছেন, তহবিল গঠন করেছেন এবং প্রতিনিধি হিসেবে তাদের আমানত পৌঁছে দিয়েছেন। এজন্য আমি আলেমদের অংশগ্রহণকে সমগ্র জাতির আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার প্রতিফলন বলবো।
আলেমগণ সেখানে অনেকভাবে কাজ করছেন। কেউ ছোট ছোট দল ও কয়েক লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে সেখানে যাচ্ছেন এবং কয়েকদিন কাজ করে চলে আসছেন। অনেকে আবার সেখানে ক্যাম্প করে বা মুহাজিরদের কোনো ক্যাম্প বেছে নিয়ে একটু বড় করে কাজ করার চেষ্টা করছেন। যেমন তাদের জন্য টয়লেট ও খাবার পানির ব্যবস্থা করছেন। ছোট দলের অনেকেই আবার তাদের সঙ্গে অংশগ্রশণ করছেন। কিছু কিছু জায়গায় মসজিদের মতো করে নামাজের ব্যবস্থা করছেন। এ জায়গাগুলো শুধু নামাজের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে এমন না। বরং যারা মাত্র আসছে তারা বিশ্রাম নিতে পারছে, বাচ্চাগুলোর আশ্রয় হচ্ছে, পড়া-লেখা করতে পারছে, সামাজিক মিলনকেন্দ্র বা পবিত্র অবকাশ কেন্দ্র হিসেবে মসজিদগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে।
তাবলিগ জামাতের অনেকগুলো দল সেখানে কাজ করছে। তারা প্রচার বিমুখ। তাদের অনেক কিছুই প্রচারে আসে না। আসছে না। ঢাকার একজন ডাক্তার আমাদের হোটেলে এসেছিলেন। তিনি আমাদের স্পষ্ট করেছেন যে, কাকরাইলের মুরব্বিরাই ঢাকার হালকাগুলোকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সেবায় আত্মনিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন। ঢাকা ও ঢাকার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের অনেকগুলো জামাত সেখানে কাজ করছেন। তাদের দলের অনেক ডাক্তার আছেন তারা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। তাদের অংশগ্রহণও এবার উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে।
আলেমদের সঙ্গে বাহ্যত সম্পর্ক নেই এমন অনেক কাফেলাও সেখানে কাজ করছেন। যেমন ঢাকার চাঁদনি চক মার্কেটের একটি অগ্রবর্তী দল মুহাজির রোহিঙ্গাদের চাহিদা সম্পর্কে জানতে উপস্থিত হয়েছেন। আমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কি আপনাদের পুরো মার্কেটের পক্ষ থেকে? তারা হ্যা বলেছেন। আমি হয়তো চাঁদনি চকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সারাদেশের বিভিন্ন নাগরিক শ্রেণী মুহাজিরদের সেবায় উপস্থিত হয়েছে।
সাধারণ মানুষের ভেতর এ স্ফূরণ অতীতে দেখা যায় নি। আমাদের মতো একটি স্বল্প সামর্থ্যরে দেশের মানুষ কোনো দিকে না তাকিয়ে প্রথম দিন থেকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় নেমে পড়া জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। সর্বশ্রেণীর মানুষের এ অংশগ্রহণ অনেক গর্বের ও অনুপ্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত।
আমি বলবো, মানুষের ভেতর মানুষের প্রতি এমন ভালোবাসা ও সহমর্মিতা আমাদের জন্য বরকতেরও। আল্লাহ তায়ালা কখনো কখনো কোনো জাতির অগ্রগতির জন্য, তাদেরকে আসন্ন দুর্যোগ ও বিপদ থেকে রক্ষার জন্য কিছু সেবা, সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টার সুযোগ করে দেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো আমার কাছে তেমন একটি সুযোগ মনে হয়।
মানুষের এই বিপুল সাড়ার কারণ হতে পারে এবারের ঘটনা তাদের বেশি স্পর্ষ করেছে। মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানবিক স্পৃহা জাগ্রত করার মতো প্রচার-প্রচারণা ও অনুভ‚তির বিনিময় বেশি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অনলাইন পোর্টাল, মসজিদ-মাহফিলের বয়ান গণজাগরণে ভ‚মিকা রেখেছে।
মূলধারার পত্রিকা ও নিউজপোর্টালগুলো ভ‚মিকা এ ক্ষেত্রে দুঃখজনক। তারা রাখাইনে মুসলিম নিধন, গণহত্যা ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমনের কিছু সংবাদ তারা ছেপেছে সত্য কিন্তু বাংলাদেশে তাদের মানবেতর জীবন, বিপুল সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা ও মানুষের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তেমন কোনো সংবাদ পরিবেশন করে নি। সমাজে যারা নিজেদের সুশীল ও মূলধারার নাগরিক মনে করে, মিডিয়াগুলো যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন তারাও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চেতনা জাগরণ ও সচেতনতা তৈরি কাজগুলো করেন নি।
মিডিয়া ও সুশীল সমাজের মুখ বুঝে থাকার পরও আলেম সমাজের জাগরণ, মসজিদ-মাদরাসায় তাদের সক্রিয় ভ‚মিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অব্যাহত প্রচার ও অনুভ‚তির বিনিময়, তরুণ প্রজন্মের ছোট ছোট উদ্যোগ এবং রোহিঙ্গাদের করুণ গল্পগুলো উঠে আসার কারণেই মানুষের মাঝে বিপুল সাড়া জেগেছে।
প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে? তাদের উপর নির্মম নির্যাতনে আমরা সীমাহীন ব্যথিত এবং তাদের সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা আমরা অবশ্যই করি। ভুললে চলবে না, ভোলা উচিৎ হবে না আরাকান তাদের মাতৃভূমি। তাদের সমস্যার সমাধান স্বভ‚মিতে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই। তা যেভাবে হোক এবং যতোটুকু আংশিক ও পূর্ণ তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়াটাই সমাধান। তাদের মাতৃভূমি তারা কেনো ত্যাগ করবে? বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল মধ্যআয়ের দেশের পক্ষে তাদের দীর্ঘকাল এখানে রেখে দেওয়া কঠিন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগী না হলে বাংলাদেশেও তাদের অবস্থান খুব স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে করি না। আমি সরকারকে তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে অনুরোধ করবো যেনো এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে।
এটাও ঠিক রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কখন হবে, কিভাবে হবে আমরা ঠিক জানি না। সমস্যা সমস্যাই। মানুষ ও মুসলিম হিসেবে যেনো তারা আত্মপরিচয় হারিয়ে না ফেলে, তাদের মানবিক আত্মপরিচিতি ও মুসলিম আত্মপরিচিতি যেনো বিপন্ন না হয়, শিশুদের জীবন যেনো বিপন্ন না হয় সেজন্য বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলগুলোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিশেষত মুসলিম দেশগুলো যেনো বিনিয়োগ করে।
উলামায়ে কেরাম ও দীনদার মানুষ যে সেখানে কাজ করছেন, ঘর করছেন, পানির কল বসাচ্ছেন, টয়লেট করছেন বা মসজিদ ও মক্তব করার চিন্তা করছেন তাদের উদ্দেশ্যও রোহিঙ্গাদের মানবিক ও ধর্মীয় প্রয়োজনগুলো পূরণ করা। কল ও টয়লেট করার উদ্দেশ্য শুধু প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ নয়; বরং নারীর পর্দার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। মসজিদগুলোতে যেনো দীন শেখানো যায়, মক্তব পরিচালনা করা যায় সে চিন্তাও আলেম ও দীনদার মানুষের ভেতর কাজ করছে।
যারা এখন কাজ করছেন এবং সামনে করবেন তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, তারা যেনো রোহিঙ্গাদের বৃহত্তর মানবিক ও ধর্মীয় বিষয় সামনে রেখে কাজ করেন। যেমন, ধর্মীয় শিক্ষাসমৃদ্ধ স্কুল করা, কুরআনি মক্তব করা, মসজিদগুলো দীনি আয়োজনে সজীব রাখা, শিশুদের লেখাপড়া-মানবিক উৎকর্ষ সাধন। ইত্যাদি। বিশেষত এখন যারা শ্রম দিচ্ছেন, চেষ্টা করছেন তারা যেনো শ্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন সে অনুরোধ আমার থাকবে।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মুসলিম সাহায্য সংস্থাগুলো এখানে কাজ করতে পারেন। যারা মুসলিম সাহায্য সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখেন তারা যেনো তা করেন। আমি মনে করি, সরকারের এখানে আরও কিছু করার আছে। সরকার মুসলিম দেশগুলোর কাছে রোহিঙ্গাদের মানবিক ও ধর্মীয় প্রয়োজন তুলে ধরতে পারেন। শুধু খাদ্য-পানীয়-চিকিৎসাই সমাধান নয়। তাদের দীনি শিক্ষা, তাদের মসজিদ-মক্তব ইত্যাদি বিষয়ে যদি সরকার উদ্যোগ নেন, তাহলে আমি আশা করি বিত্তবান মুসলিম দেশগুলো থেকে সহযোগিতা আসবে।
রোহিঙ্গাদের স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা জাগিয়ে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেনো তাদের দেশটাকে ভুলে না যায় সে উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। সরকার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের মাঝে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এমন যেনো না হয়, তারা জাতীয় মুক্তির চিন্তা না করে বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করলো। রোহিঙ্গা যুবকরা যেনো দেশটা নিয়ে ভাবে, তাদের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে- ইতিবাচক ও আইনসিদ্ধ এমন প্রস্তুতিরও প্রয়োজন রয়েছে। রোহিঙ্গা অধিকার আদায়ের প্রেরণা জাগিয়ে রাখতে দেশের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীর পরামর্শে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করলে কিছু সুফল পাওয়া যাবে। কারণ, আন্তর্জাতিক ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি যদি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার প্রচেষ্টা দৃষ্টিগোচর হয়, তবে সমস্যার সমাধানে তা গতি আনবে।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কিছু মিডিয়া নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির চেষ্টা করছে বলে আমার মনে হয়েছে। তারা বলার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করছে। আমি বলবো, বাস্তবেই হয়তো কিছু সমস্যা রয়েছে। হয়তো বন উজার হচ্ছে, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তারা যে বিপন্ন পরিবেশ থেকে আসছে তাতে কিছু রোগ-ব্যধি তাদের সাথে আসাও অসম্ভব কিছু নয়। সবকিছুর পরও সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা নির্ধারিত এলাকার মধ্যেই থাকবে। বাইরে আসবে না। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে ঝুঁকিগুলো বড় করে দেখার সুযোগ নেই। তাছাড়া কয়েক লাখ মানুষের জীবনের চেয়ে পাহাড়-প্রকৃতির মূল্য তো বেশি হতে পারে না। এমন মানবিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে এসব বিষয়ে খোঁচাখুঁচি করা ক্ষুদ্রতার পরিচয়।
যেসব মিডিয়া মানবিক বিপর্যয়ের চেয়ে পাহাড়-পরিবেশকে বড় করে তুলতে চাইছে তাদের প্রবণতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ সচেতন। মুসলিম ইস্যুতে তারা সব সময় নাক উঁচু আচরণ করে। মুসলমান নির্যাতিত হলে তাদের কাছে নির্যাতন মনে হয় না। মুসলমান বিপন্ন হলে তাদের কাছে খারাপ লাগে না। যদি দুই কোটি মুসলমান বিপন্ন হয় এবং সে বিপন্ন মুসলমানের কারণে এক কিলোমিটার বনে ক্ষতি হয়, দশ বিল্ডিংয়ের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, তাহলে তারা সেটাকেই বড় করে দেখানোর চেষ্টা করে। তারা বিএসএফের হাতে একজন বাংলাদেশির মৃত্যুর চেয়ে ভারত থেকে আসা হাতির খবর বড় করে দেখিয়েছে। মূলধারার দাবিদার এসব গণমাধ্যম বারবার আমাদের জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, মুসলিমদের প্রতি অসহানুভ‚তিশীল আচরণ করেছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চুলকানিমূলক লেখা, বিভিন্ন সমস্যা সংকট সামনে এনে মানুষের মনবিষিয়ে তোলার প্রচেষ্টা তাদের সেই প্রবণতারই অংশ।
আগত রোহিঙ্গা নর-নারী-শিশুদের নিয়ে অনেক নেতিবাচক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড স্থানীয় সুযোগ সন্ধানী একটি শ্রেণি করছে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারী-কিশোরী মেয়েদের ব্যাপারে একটি দালালচক্র সেখানে সক্রিয় আছে। শিশু পাচারের চেষ্টা করছে। নানা ফাঁদ পাতছে। ত্রাণ জায়গা মতো পৌঁছাতে না দেয়া, ছিনিয়ে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। সরকারের আইন-শৃংখলা বাহিনী ও ইতিবাচক গণমাধ্যম সেখানে মনোযোগ দিলে এ অপরাধগুলো রোধ করা যাবে। কোনো কোনো গণমাধ্যম ও টিভি চ্যানেল চমৎকার কাজ করছেন। তারা বিষয়টি আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতা হলো, পৃথিবীর কোনো মুসলিম দেশই এখন আর নিরাপদ নয়। এখন আমাদের প্রয়োজন শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য, অভ্যন্তরীণ সমৃদ্ধ মানবিক শক্তি, দীনি সচেতনতা বাড়ানো, দীনি শিক্ষা, মূল্যবোধ দৃঢ় করা। আর প্রয়োজন আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে হীনমন্যতায় না ভোগা, মুসলমানদের একক ধর্মীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত কয়েক দশকে কোনো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব পাওয়া যায় না। যদি আরাকানে গত কয়েক দশকে শক্তিশালী ধর্মীয়, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক লড়াই ও আত্মপরিচয় উদ্ধারে যোগ্য নেতৃত্ব গত চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর থাকতো তবে আজকের বিপর্যয়ের রূপটি অন্তত এমন হতো না।
রোহিঙ্গা শিবিরে গেলে এইচএসসি, অনার্স পাশ, ডাক্তার বা ইঞ্জিয়ার কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না। তারা বঞ্চিত হয়েছে সত্য। তাদের স্কুলে-কলেজে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় নি সত্য। তবুও কোনো জাতিকে যদি দীর্ঘকাল বঞ্চিত করা হয়, তখন বিকল্প নেতৃত্ব ধারা তৈরি হওয়া আবশ্যক। যেনো নিজস্ব চিন্তা ও ব্যবস্থায় জাতিগঠনের কাজটি এগিয়ে যায় এবং উচ্চ শিক্ষার পথ খোলা থাকে। বিভিন্ন পেশার মানুষ থাকে। শুধু জেলে ও কৃষক -যেমনটি আগত রোহিঙ্গাদের মাঝে দেখা যায়- জাতীয় মুক্তি ও অধিকার করার সম্ভব নয়। যদি তাদের বিকল্প নেতৃত্ব থাকতো, সমাজে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারতো, তাহলে দেখা যেতো আজ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচটি ছেলে বা মেয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে ইংরেজি ভাষায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে নিজের দুর্দশার কথা তুলে ধরছে। তাদের একটি গ্রুপ ঢাকায় এসে কূটনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হতো, তারা বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে যেতো। পূর্বে থেকে নেতৃত্ব গড়ে উঠলে আজ সংকটকালে নেতৃত্ব অনেক সুন্দর ও গোছালো হতো।
তাদের থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমাদের জাতীয় ধর্মীয় সাংস্কৃতি নেতৃত্ব বলিষ্ঠ থাকা। জাতীয় ঐক্য, ধর্মীয় শিক্ষা ও সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। এগুলোর প্রতি এখনি মনোযোগ দেয়া দরকার। যেনো ভবিষ্যতে কোনো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে না হয় এবং আল্লাহ না করুন! যদি কোনো বিপর্যয় এসেই পড়ে তাহলে যেনো পঙ্গপালের মতো ছুটতে না হয়। জাতীয় পর্যায়ে সব ক্ষেত্রে আমরা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও নির্দেশনা পাই।
আমি মনে করি, সংকটকালীন সময়ে জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হলে দুটি বিষয়ই দরকার। এক. আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বিভিন্ন শ্রেণি যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ইসলাম জানা, মান্য ও আপন করে নেয়া প্রয়োজন। তাদের মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামি মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হওয়া দরকার প্রয়োজন।
দুই. ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের ব্যবধান যেনো খুব বেশি না হয়ে যায়, তারা যেনো সংকটকালে পৃথক হয়ে না যায়। জাগতিকভাবে বিষয়ে আলেমরা কিছুই করতে পারবে না আবার ইসলামি বিষয়ে আধুনিক শিক্ষিতরা বঞ্চিত থেকে যাবেন এটা যেনো না হয়। আমার মনে হয়, জাতীয় স্বার্থে একটি ইতিবাচক সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন ইসলাম কেন্দ্র করে। জাতীয় সংকট উত্তরণে উভয় শক্তি যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
আরেকটি বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেয়া দরকার। তাহলো, বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠিত অনৈসলামিক এনজিও এবং সন্দেহজনক দেশীয় এনজিও যারা নানা সময়ে নানা কাজে বিতর্কিত হয়েছে এবং যাদের মধ্যে ইসলাম বিরোধী প্রবণতা প্রবল তাদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। তাদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন মনে করছি। যেনো তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে না পারে। তাদের উপস্থিতি শুধু ধর্মের জন্য ক্ষতিকর নয়। তাদের অনেক কার্যক্রম দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষেও ক্ষতিকর। পার্বত্য অঞ্চলে সার্বভৌমত্ব বিরোধী তাদের অনেক তৎপরতা বারবার গোয়েন্দা রিপোর্টে এসেছে। তারা সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। দেশ, জাতি, স্বাধীনতা ও ইসলামের স্বার্থে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে এবং মানুষকে অসহায়ত্বের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। অসহায় মানুষের প্রয়োজন না মিটলে তাদের থেকে ফেরানো যাবে না।
সবশেষে যে বিষয়টি বলবো, অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে মংডুর পথে নামে একটি গল্প রয়েছে। লেখকের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি -বলতে দ্বিধা নেই তার লেখা আমার ভালো লাগে- গল্পে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। এ মন্তব্যটি আমাদের জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিরোধী। এ লেখা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় পর্যায়ে যেখানে যেখানে এমন মন্তব্য বা তথ্য রয়েছে তা সংশোধন করা প্রয়োজন। নতুবা আমাদের জাতীয় দাবি দুর্বল হয়ে যাবে।