মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম
আল্লাহ পাক তার ইবাদতের জন্য মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা দিন-রাত মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পথে।
কিন্তু উম্মাতের সব মানুষ নবী তাঁদের দাওয়াত কবুল করেনি। বরং সিংহভাগ মানুষ তাদের আহবান প্রত্যাক্ষাণ করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাদের নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছে। তাঁদের ইবাদতে-দাওয়াতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। এমনকি তাদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে এবং হত্যার যড়যন্ত্র করা হয়েছে।
মাতৃভূমির আকর্ষণ ত্যাগ করে, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে আল্লাহর রাহে বাড়ি-ঘর ত্যাগের এই মহান গুরুত্বপূর্ণ আমল যেমন বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাঁদের জন্য খোদার প্রেমের কঠিন পরীক্ষা তেমনি তার অভ্যন্তরে নিহিত থাকে আল্লাহর সাহায্যের সূচনা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশেষে যখন রাসূলগণ নিরাশ হয়ে পড়েন এবং কাফিররা ভাবল যে, তাদেরকে মিথ্যা ধমকই দেওয়া হয়েছিল, তখন তাদের কাছে নেমে এল আমার সাহায্য। সূরা ইউসুফ : ১১৬
যে সকল নবীর জীবনে হিজরতের ঐশী আদেশ এসেছে, তা এসেছে চূড়ান্ত পরীক্ষা ও বিজয়ের সূচনা হিসেবে। এই ধারায় রাসূলুল্লাহ সা. এর জীবনেরও হিজরতের মহান ত্যাগের স্বাক্ষর রাখতে হয়।
মুসলমানদের উপর কাফিরদের নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সাথে তারা সাহাবীদের ঘরের কোণের ইবাদত-বন্দেগীতেও বাধার সৃষ্টি করছে। তখন তিনি আল্লাহর নির্দেশে নিরাপদভাবে আল্লাহর ইবাদতের নিমিত্তে সাহাবীদের মধ্যে যাদের পক্ষে সম্ভব হয় তাদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের পরামর্শ দিলেন।
নবীজীর পরামর্শে নবুওয়তের পঞ্চম সনে প্রথমবারের মতো প্রায় পনেরজন মুসলমানের একটি ছোট্ট কাফেলা আবিসিনিয়ার পথে মক্কা থেকে হিজরত করেন। পরবর্তী বছর আরো প্রায় এক’শ জনের একটি বিশাল কাফেলা একই দেশে হিজরত করেছেন।
নানা নির্যাতনসহ নামাযের সময় সিজদারত নবীজীর কাঁধে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ তুলে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়ে তারা নবীজী ও সাহাবীদের ইবাদতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
তায়েফে প্রিয় নবীজী রক্তাক্ত হয়েছিলেন শুধুমাত্র দাওয়াতের অপরাধেই (!)। তবুও নবীজী তাঁর কাজে নিমগ্ন, আপন মিশন নিয়ে ব্যস্ত।
এভাবে কেটে যাচ্ছে নবুওয়ত প্রাপ্তির প্রায় বারো-তেরটি বছর। যখন কাফিরদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তখন আল্লাহ তার সাহায্য ও নুসরত, দ্বীনের বিজয়, কালেমার বিশ্বময় প্রসারের জন্য মুমিনদের সর্বশেষ পরীক্ষার আয়োজন করেন। নবীজী আল্লাহর হুকুমে তাঁদের নির্দেশ দিলেন মদীনায় হিজরতের।
সহীহ বুখারীর বর্ণনা মতে, ‘হযরত আবু বকর রা.ও অন্য সাহাবীদের মতো হিজরতের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু নবীজী তাঁকে বললেন, অপেক্ষা করো, আশা করছি, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেওয়া হবে। ... অতঃপর হযরত আবু বকর রা.ও নবীজীর সঙ্গী হতে রয়ে গেলেন মক্কায়। আর সফরের প্রস্তুতিস্বরূপ প্রায় চার মাস যাবত দুটি উষ্ট্রী বাহনের পরিচর্যা করতে লাগলেন।-সহীহ বুখারী হাদীস : ৩৯০৫
হিজরতের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে নিজ বাড়িতে আপন চাচাতো ভাই হযরত আলী রা.কে রেখে নবীজী বের হলেন। হযরত আবু বকর রা.কে সাথে নিয়ে পরদিন বের হলেন মদীনার পথে। রওনা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নবীজী বললেন, ‘হে মক্কা! খোদার কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার মাওলার কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিতো, আমি কখনোও বের হতাম না। তিরমিযী- ৩৯২৫
হিজরতের ফলে নবীজীর প্রাপ্ত সুসংবাদ ছিলো এরূপ- ‘সুতরাং যারা হিজরত করেছে, নিজেদের ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে, জিহাদ করেছে এবং শহীদ হয়েছে। আমি অবশ্যই তাদের পাপসমূহ মাফ করে দেব এবং তাদেরকে এমন বাগানে প্রবেশ করাব, যার তলদেশে বইবে নহর। এই প্রতিদান আল্লাহর পক্ষ হতে। আর আল্লাহর কাছেই রয়েছে উত্তম প্রতিদান। (সূরা আল ইমরান ১৯৫)
হাদীসে এসেছে, ‘হিজরত তার পূর্ববর্তী সকল পাপসমূহকে মিটিয়ে দেয়।’ সহীহ মুসলিম-১২১
হিজরত বাহ্যত একটি সামান্য ঘটনা বলে মনে হলেও ফলাফলের দিক দিয়ে এটা পৃথিবীর ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর সাথে তুলনীয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ঐসব ঘটনাবলীর মহিমাকেও ম্লান করে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইতিহাস বিশ্লেষক অধ্যাপক পি.কে. হিট্টি বলেন, ‘হিজরত মক্কা যুুগের অবসান ঘটিয়ে এবং মদিনা যুগের সূত্রপাত করে মহানবী সা.-এর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন।’ হিজরত শুধু মহানবী সা.-এর জীবনের পরিবর্তন আনেনি, ইসলামের ইতিহাসেও এটা বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক জোসেফ হেলার (১৯২৩-১৯৯৯) বলেন- ‘হিজরত’ ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ টার্নিং পয়েন্ট। তার ভাষায়- Hijrat is the Greatest Turning Point in the History of Islam.
হিজরতের মতো ঘটনা সংঘটিত না হলে ইসলাম মক্কার পৌত্তলিকদের মধ্যে স্বল্প পরিচিত একটি ধর্ম হিসেবে হয়তো সীমাবদ্ধ থাকত। মহানবী সা. মদিনায় আগমনের পর থেকে ইসলাম দিন দিন শক্তি লাভ করতে লাগল।
অধিকাংশ মদিনাবাসী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে এর ভিত্তি দৃঢ় করেছিলেন। পরবর্তীকালে ইসলাম যে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছিল তা হিজরতের ফলেই সম্ভব হয়েছিল।
হিজরত মহানবী সা. এবং নবদীক্ষিত মুসলমানদের জন্য এক চির কল্যাণকর দিক। নবদীক্ষিত মুসলমানরা যদি প্রথমে আবিসিনিয়ার এবং পরে মদিনায় স্থায়ীভাবে হিজরত না করতো তাহলে তাদের জীবন, জান, মাল হুমকির মধ্যে পড়তো হয়তো-বা জীবন নিঃশেষ হয়ে যেত
ইসলাম তথা বিশ্বের ইতিহাসে হিজরতের প্রত্যক্ষ ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। মদিনায় ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ও ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও নীতি মক্কায় অবতীর্ণ হলেও এটি মদিনায় হিজরত করার পর একটি সংগঠিত ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিজরত মহানবী সা. কার্য পদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। তাই বলা হয়, মহানবী সা. মক্কায় নবী ও রাসূল ছিলেন পক্ষান্তরে মদিনায় তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
হিজরতের পর মদিনাকে ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। ফলে মদিনার গুরুত্ব দেশ-বিদেশে বৃদ্ধি পায়, তেমনি বিভিন্ন গোত্র নিজেদের স্বার্থ ভুলে গিয়ে ইসলামের খাতিরে এক জাতিতে পরিণত হয়। সবাই ভাই ভাই- এ ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি বৃহৎ মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছিল যার কাছে পরবর্তীকালে পরাক্রমশালী রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, হিজরত মহানবী সা. এবং নবদীক্ষিত মুসলমানদের জন্য এক চির কল্যাণকর দিক। নবদীক্ষিত মুসলমানরা যদি প্রথমে আবিসিনিয়ার এবং পরে মদিনায় স্থায়ীভাবে হিজরত না করতো তাহলে তাদের জীবন, জান, মাল হুমকির মধ্যে পড়তো হয়তো-বা জীবন নিঃশেষ হয়ে যেত।
ইসলামে এতো সহজে বিস্তার লাভ করতো না। হজরত মুহাম্মদ সা. ইসলামী রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা গঠন করতে খুবই কষ্টকর হতো। তাই আল্লাহর অশেষ রহমতে হিজরত হওয়ার ফলে মহানবী সা. ইসলামকে মদিনায় ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং শক্তি সঞ্চয় করে নিজ মাতৃভূমি মক্কাকে জয় করে বিজয়ীর বেশে রক্তপাতহীনভাবে ফিরতে পেরেছিলেন।
চাঁদের পূর্ণ বিবরণসহ ২০১২ সালে ছাপা বাংলাদেশের একটি ক্যালেন্ডার
হিজরতের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে। হিজরতের থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন।
প্রকাশ্যে আজান, নামাজ, ঈদ সবকিছু হিজরতের পর থেকেই শুরু হয়েছে। হিজরতের বছরই মসজিদে নববী নির্মিত হয়। যা মূলত ইসলামে প্রচার ও প্রসারের কেন্দ্র বা মারকায হিসেবে বিবেচিত।
সর্বোপরি হিজরত ইসলামের ইতিহাসে সতন্ত্র একটি মাইল ফলক। তাই সাহাবয়ে কেরাম হিজরতের বছর থেকেই ইসলামী সালের গণনা শুরু করার সিদ্ধান্তে ঐক্যমতে পৌঁছেন। ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তটি গৃহিত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর।
ঐতিহাসিক বদর বিজয়, মক্কা বিজয় এবং বিদায় হজ্জসহ ইতিহাস ঐতিহ্য ও জাতীয় সমৃদ্ধির আরো অনেক ঘটনাই ছিল যা থেকে ইসলামী সাল গণনার সূচনা হতে পারত। কিন্তু বাহ্যত হিজরত মূলত মুসলমানদের কমজোরী শক্তিহীনতার প্রকাশ করে। তা সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম রা. সর্বম্মতভাবে এ বিষয়টিকেই ইসলামী বর্ষগণনার কেন্দ্রবিন্দু নির্বাচিত করেন।
এটি সাহবায়ে কেরামের দূরদর্শিতা ও তীক্ষ্ণ মেধার সাক্ষর বহন করে। হুদাইবিয়ার সন্ধির সাথে তুলনা করলেই বিষয়টিকে সহজে বোধগম্য হয়। সন্ধিচুক্তিটি বাহ্যত ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য পরাজয় বা অবমাননাকর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল ‘ফাতহে মুবিন’ বা সমূহ বিজয়ের অবতরণিকা।
ঠিক তেমনিভাবে বাহ্যিক দৃষ্টে হিজরতকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, কার্যত এটিই ইসলাম এবং মুসলমানদের উন্নতি অগ্রগতির সোপান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
ইসলামের সকল প্রকার বিজয়, প্রচার ও প্রসারের উৎসমূল ছিল এই ঐতিহাসিক হিজরত। কালক্রমে সেগুলো বিকশিত হয়েছে মাত্র। তাই হিজরত থেকেই শুরু হয় হিজরি সনের গণনা।
লেখক: মুহাদ্দিস, গবেষক