আনাস বিন ইউসুফ
শিক্ষার্থী ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বকে কেন্দ্র করে আরাকনের চলমান সমস্যা নতুন নয়৷ অনেক দিন থেকে চলে আসা দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট এটি৷ তো সংকট যখন স্থায়ী এর সমাধানও হতে হবে স্থায়ী৷
প্রথমত নিরাপত্তা চৌকিতে হামলাকে ইস্যু করে বিশাল এক জানগোষ্ঠিকে তাদের নিজ আবাস ভূমি থেকে এভাবে উচ্ছেদ করার কি যৌক্তিকতা তা আমার বোধগম্য নয়৷ অথচ, বাস্তব সত্য হলো, সম্প্রতি রোহিঙ্গা মুসলিমদের কিছু যুবক সেনাচৌকিতে একেবারে অহেতুক হামলা করেনি৷
এর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা আরাকানে ঢুকে অভিযানের নামে বিনা কারণে কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবককে হত্যা করে৷ যার অর্থ, কিছু যুবককে হত্যার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের উস্কে দেয়া, যাতে তারা প্রতিশোধের উসিলায় অ্যাকশনে যেতে পারে। যার পরিনতিতে আজকের এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং একটি জাতিকে তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ অভিযান৷
আর এ অভিযানকে কেন্দ্র করে কত শত নিরস্ত্র যুবক ও নারী-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে৷
মিয়ানমারের মগের মল্লুক দস্যু হায়েনাদের কারণে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান নিজ ঘড় বাড়ি হরিয়েছে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রধানত দুটি বিষয় সামনে আসে৷
এক. দিনের পর দিন না খেয়ে, আদরের অবোলা-অবুঝ শিশুগুলোকে সাথে নিয়ে যেসব অসহায় নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ নদী সাঁতরে, হেঁটে এপারে এসেছে প্রথমে তাদের আশ্রয় দিতে হবে৷ প্রাথমিক আশ্রয় হিসেবে তাদের থাকা-খাওয়া এবং অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এপারের সরকার, জনগন এবং প্রশাসন সকলেই সাধ্যমত তাদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে হবে৷ তবে এ ক্ষেত্রে মানবিক আবেগ ও ধর্মীয় চেতনাবোধের সাথে সাথে দেশের নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে৷
মনে রাখতে হবে, সব হারানো এই মানুষগুলোকে দিয়ে যেকোন ধরনের অপকর্ম করানোও সম্ভব৷ দেশের নিরাপত্তা বিনাশে সচেষ্টরা আশ্রয়ের নামে ডেকে নিয়ে এদের দিয়ে যেকোন উগ্রবাদকেও জীবন্ত করার চেষ্টা করতে পারে৷ এসব দিক লক্ষ করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ব্যাপকভাবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ দেয়াও বোকামি হবে৷ বরং তাদের একটি নির্দৃষ্ট স্থানে জায়গা দিয়ে আপাতত থাকার ব্যবস্থা করাই উত্তম সিদ্ধান্ত হবে৷ যে স্থানে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সাহায্য-সহায়তা নিয়ে যেতে পারবে এবং আবেগী মানুষগুলো নিজ হাতে ত্রাণ বিতরণ করতে পারবে৷
প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে, দেশ-বিদেশ থেকে আসা ত্রাণের সুসম বিতরণের ব্যবস্থা করা৷ এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগটি প্রশংসা করতে হয়৷ সরকার সব ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য একটা এলাকা নির্ধারণ করেছে শরণার্থী শিবির হিসেবে৷ যেখানে বিভিন্ন ব্লকে ক্যাম্প খোলে তাদের জন্য অস্থায়ী নিবাসের ব্যবস্থা করা হবে৷ এর অর্থা হল, বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গারা সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে৷
[একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকাই কাম্য৷ তবে এখানকার কিছু মানুষের চরিত্র তো ভিন্ন৷ ক্যাম্পে থাকার ফলে সারাদেশ থেকে যারা সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে যাবে তারা নিজ হাতে বিতরণ করতে পারবে না এটা প্রায় নিশ্চিত৷ যদিও এখনো অনেকে বিতরণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ ইতিমধ্যে ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রশাসন থেকে৷ যে যা নিয়ে যাবে সব দায়িত্বশীলদের হাতে দিতে হবে৷ আর বাংলাদেশের দায়িত্বশীলরা কতটা আমানতদার সে বিষয়ে অতীতের রেকর্ড সুখকর নয়৷ তাই এখানেও একটা উদ্বেগ থেকেই যায়]
এর পরের কথা হল- এই পাড়ে আসা রোহিঙ্গারা কিন্তু মানবশক্তি নয়, বরং এক ধরনের মানববোঝা হয়েই আমাদের কাছে এসেছে৷ আরো আসছে৷ তাদের বরণ করেই কোন কাজে লাগানো সম্ভব না৷ একদিকে নিরাপত্তা বিবেচনায় দেশের সর্বত্র গণহারে বাসস্থান দেয়ার সুযোগ নেই৷ অন্যদিকে কাজে লাগিয়ে তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করাও কঠিন৷ আর স্থায়ী বসবাসের কোন সুযোগই নেই৷ এমতাবস্থায় তাদের একমাত্র পরিচয়, তারা আমাদের মেহমান৷
এখন এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে কতদিন মেহমানদারি করা সম্ভব সেটাও ভাবার বিষয়৷ জাতিসংঘসহ যেসব বিদেশি সংস্থা ও দেশ সহায়তা পাঠাচ্ছে সেসবের সুসম বণ্টন হবে কিনা, ইঁদুর-বিড়ালের হাত থেকে রেহায় পাবে কিনা সে বিষয়েও অনেকের মনে যথেষ্ট শংকা রয়েছে৷ যদিও এসব ত্রাণ নিতান্ত অপ্রতুল্য৷ ফলে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মেহমান বা মুহাজির হিসেবে সাময়িক আশ্রয় দিলেও এর মাধ্যমে তাদের শান্তির ব্যবস্থা হবে না৷ একটা অশান্তি থেকেই যাবে৷
দুই. প্রাথমিক করণীয় হিসেবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সাময়িক থাকতে দিলেও তাদের জন্য স্থায়ী সমাধান হচ্ছে- তাদের নিজ ভূমিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা৷ মিয়ানমার সেনাবাহিনী মঙ্গলবারের (১০ সেপ্টেম্বর) মধ্যে আরাকান ক্লিন করার যে অভিযান শুরু করেছিল তা প্রায় অনেকাংশে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে ইতিমধ্যে৷
পালিয়ে আসা লোকদের ভাষ্য মতে আরাকান এখন জনশূন্য৷ প্রায় দশ হাজারের মত যুবককে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা জানাচ্ছে৷ ঘর-বাড়ি হারিয়ে যারা তাবু গেড়ে থাকছে গত রোববার থেকে তাদেরও হটিয়ে দিচ্ছে৷ গরম পানি ও জলকামান ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের উপর৷
এদিকে মিয়ানমার সরকার জনশূন্য আরাকানে মিল-ফ্যাক্টরিসহ বিভন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান করার ঘোষণা দিয়েছে৷ যার অর্থ হল- সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে পূনর্বাসন করা না হলে পরবর্তীতে আর সুযোগ থাকবে না৷ কোন চিহ্নই থাকবে না সেখানে। মুসলমানদের কোন অস্তিত্ব যাতে বাকি না থাকে সে জন্য প্রতিনিয়ত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও ফেসবুক লাইভে সেই পুড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য আমরা সরাসরি দেখেছি৷ বোলডোজার দিয়ে সব স্থাপনাগুলোও গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা না করলে তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার ও অনিশ্চিত৷ বাংলাদেশেও নাগরিকত্ব দেয়ার সুযোগ থাকছে না৷ ফলে তাদের পরিণতি ফিলিস্তিনীদের চেয়েও করুণ হতে পারে৷ অবশ্য নির্যাতনের মাত্রা হিসেবে হয়তো ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনকে ছাড়িয়েছে৷
এখন প্রশ্ন হল, পূনর্বাসন কিভাবে হবে? কোন প্রক্রিয়ায় তাদের আবার নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নেয়া যেতে পারে? এর উত্তর হল- বিশ্বের মুসলিম শ্বাসক গোষ্ঠী এক হয়ে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে৷
বাংলাদেশ যেহেতু এক্ষেত্রে আক্রান্ত তাই বাংলাদেশই প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে৷ দেরি করে হলেও ইতিমধ্যে সরকারের তৎপরতা চোখে পড়েছে৷ কিন্তু হতাশার বিষয় হল, গণতন্ত্রের পোশাক পরিহিত যেসব মুসলিম শ্বাসক ক্ষমতায় বসে আছেন তারা ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু বলবে না যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো মুখ খুলে৷
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারও এর বাইরে নেই৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ তবে মিস্টার এরদোগান একটু ভিন্ন৷ তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করছেন, সাহস করে প্রকাশ্যে মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য৷ তাঁর দেখাদেখি আরো কিছু মুসলিম শ্বাসক সাহসী ভূমিকা পালন করছেন৷ যদিও এরদোগান কতক্ষণ তার সাহস দেখাতে পারবেন সেটা নিয়েও যথেষ্ট বাক্য রয়েছে৷
অতএব, বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এই আন্দোলনের অর্থ এই না যে, শুধু রাজপথ গরম রাখা হবে৷ বরং এর পাশাপাশি আদর্শিক আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে৷ সেইসাথে বিশ্ব মিডিয়াকে দেখাতে হবে, স্বজাতি রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে সারা বিশ্বের মুসলমানরা জেগে উঠেছে৷ আর এ আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম প্রধান প্রতিটি দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসন বিষয়ে দ্রুত আলোচনায় বসতে৷ প্রয়োজনে তারা বিভিন্ন দেশ সফর করবেন!!
আমাদের করণীয়
আমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে- শুধু রোহিঙ্গা মুসলমান নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর এই মহা সংকটকে তার প্রকৃত বাস্তবতাসহ সাধারণ মুসলমানদের কাছে সবিস্তার বর্ণনা করা। যারা এখনো নিজেদের এই সমস্যা সম্পর্কে অনবগত তাদের সচেতন করা৷ বক্তাগণ বক্তৃতায়, খতীবগণ মিম্বারে আর কলম যোদ্ধারা লেখার মাঠে এই কাজ করবেন৷
এরপর যে মহা সত্যটি থেকে আমরা দূরে সরে আছি সেটার প্রয়োজনীয়তা সবার কাছে তুলে ধরতে হবে৷ আলেমগন বুঝতে পারবেন সে সত্যটি কী এবং এর হাকিকত কী৷ অর্থাৎ, মুসলিম উম্মাহর এই সংকট থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব৷ আর এর জন্য ইসলামি শ্বাসন ব্যবস্থার অপরিহার্য- এ বিষয়টি সবাইকে বুঝাতে হবে৷ তবেই মুসলিম বিশ্বের সংকটময় পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান আসবে৷
আমাদের দ্বিতীয় করণীয়- কালক্ষেপন না করে যার যে সাধ্য আছে সে অনুযায়ী শরনার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া৷ তাদের সুস্থ জীবন যাপনের প্রাথমিক ব্যবস্থা করা৷
এক্ষেত্রে প্রশাসন ত্রাণ বিতরণে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সেটা সাধারণ মুসলমানদের আবেগকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করছি৷ সাধারণ মানুষ অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত হবে৷ কারণ, যাদের হাতে ত্রাণ জমা দিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ তাদের বিশ্বাস করার আগে কিছু সময় ভাবতে হয়৷ এটা তাদের অতীত অভিজ্ঞতা৷
আমাদের তৃতীয় করণীয় হচ্ছে- কার্যকরি উদ্যোগ নিতে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি সহযোগিতাও করা৷ আর মিডিয়াগুলো যেহেতু পেটের দায়ে একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি তাই বিকল্প মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষকে জাগিয়ে তোলা৷
তবে ফেসবুককে মূল হাতিয়ার হিসেবে না নিয়ে নিজের সমাজ ও আশপাশে নিজের যবানকে ব্যবহার করতে হবে৷ আগামির বিপ্লবের জন্য মুসলিম উম্মাহকে প্রস্তুত করতে হবে৷ শহর-নগর-বন্দরের সকল মানুষকে সচেতন করত তাদের অনুপ্রাণিত করে মিয়ানমারসহ সারা বিশ্বের সৈরাচারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷