আতিক ফারুক
বার্মা স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে। এরপর ১৯৬০ সালে যে নির্বাচন হয় তখন কিন্তু রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব ছিল। চারজন পার্লামেন্ট মেম্বারের মধ্যে তিনজন ছিল মুসলমান। এর একজন ছিলেন সুলতান আহমদ। যার ছেলে কো নিকে এ বছরের ২৯ জানুয়ারি ইয়াঙ্গুনে হত্যা করা হয়।
কো নি সংবিধান আইনে বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মী ছিলেন। কো নি হত্যার পর থেকে পরিস্থিতি ঘনীভূত হতে থাকে। মিয়ানমারের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিয়াংসির প্ররোচনায় তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ উঠে।
১৯৮২ সালে সামরিক সরকার আটটি উপজাতিকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দেয়া হয়নি। তাদের রোহিঙ্গা নয় বেঙ্গলি সেটেলার বা বাংলাদেশ থেকে আসা বসতি স্থাপনকারী এমন যুক্তি দিয়ে নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে না। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্তমান কমান্ডার ইন চিফ বলছেন, আগের সরকারগুলো বেঙ্গলি ইস্যু সমাধান করতে পারেনি এখন যে সরকার আছে তারা এই বেঙ্গলি ইস্যু সমাধান করবে। এর অংশ হিসেবে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চলছে।
স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনে খানিকটা প্রশ্ন জাগতে পারে, অংসান সুচি যাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলা হয় সে কিভাবে এতো পৈশাচিক নির্যাতন আর বর্বরতারর চরমসীমা অতিক্রম করতে পারে!
প্রকৃতপক্ষে, মিয়ানমারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে। এর দায়িত্ব পালন করছেন সেনাবাহিনীর কর্মরত তিনজন প্রভাবশালী লেফটেন্যান্ট জেনারেল। মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে জাতিগত নির্মূল অভিযানে এদের হাত আছে। এদের মধ্যে যিনি সিনিয়র জেনারেল বা সিএনসি, তারও এমন ভূমিকা আছে।
দেশটির বর্ডার ম্যানেজমেন্ট মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে। এখানে সু চি বা তার এনএলডি পার্টির কিছু বলার বা ভূমিকা রাখার কিছু নেই। এরা সু চির কথা শোনার লোক নন। কারণ, সাংবিধানিকভাবে তারা এসব পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সু চি কিছুই করতে পারবে না। তিনি তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্র। আসলে মিয়ানমারে একটি দ্বৈত সরকার আছে। যার মূল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে।
এখন যা দেখা যাচ্ছে, একটি জনগোষ্ঠী যারা ১৫ থেকে ২০ লাখের মতো ছিল তাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া চলছে। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে। এসব লোক কোথায় যাবে?
দুনিয়াতে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের মধ্যে যাদের সামান্য অর্থ ছিল তারা বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে চার লাখ রোহিঙ্গা এসেছে। এবার জাতিসঙ্ঘ বলছে দুই লাখ ৭০ হাজার এসেছে। সব মিলিয়ে ছয় থেকে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে যদিও সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। তবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই জনসংখ্যাই অনেক বেশি।
এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদে সরকার মিয়ানমার বা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে সরকার কী করবে, তা ঠিক করতে পারছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মনে হয় এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছে।
মূল সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজন আছে, সঙ্ঘাত আছে। জাতীয় কোনো বিষয়ে ঐকমত্য নেই। এক নীতি বা সুর নেই। সরকারের সহযোগিতা চাওয়া বা সরকারকে সহযোগিতা করার কোনো মানসিকতা নেই; যে কারণে এ মুহূর্তে সরকারে আরো যেসব সমস্যা আছে রাজনৈতিক সমস্যা, সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে সমস্যা আছে। এমন পরিস্থিতিতে এত বড় একটি সমস্যা নিয়ে সরকার এখনো ঠিক করতে পারছে না কোন পথে যাবে!
আমরা তো দেখছি তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি এসেছেন, এর আগে ইন্দোনেশিয়ার পররারষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন। মনে হচ্ছে তারা বাংলাদেশকে একধরনের চাপ দিচ্ছেন। এ সমস্যা নিয়ে যেন সরকার এগিয়ে যায়।
তারা এই বার্তা দিচ্ছে তোমরা এগিয়ে যাও আমরা সমর্থন দিচ্ছি। সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। চেচনিয়ার গ্রোজনিতে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে, উজবেকিস্তান থেকে মিয়ানমারের ফুটবল টিমকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মালদ্বীপ বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। মালয়েশিয়া কড়া প্রতিবাদ করেছে। অর্থাৎ চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশকে এগুলো কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশের চেয়েও তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া অনেক বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ, এই দুই দেশে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। এ ছাড়া এ ধরনের একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে তাতে যেকোনো দেশ এর প্রতিবাদ করবে। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে মুসলমান হিসেবে নির্যাতিত করা হচ্ছে। তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া এ কারণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে যে এসব দেশের ভেতর থেকে সরকারের ওপর চাপ আছে।
চীন এক সময় মিয়ানমারের বড় সহায়ক ছিল। সু চির উত্থানের পরে এখন সেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। ভারত ও জাপানের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাড়ছে। নতুন নতুুন শহর গড়ে উঠছে। যেহেতু মিয়ানমার বিশাল রাষ্ট্র এবং অনেক সম্পদ আছে। বিপুল প্রমাণিত জ্বালানি তেলের মজুদও আছে।
এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারের আরো অনুপম কিছু করা উচিৎ। কিন্তু, আসলে দেশের ভেতরে থেকেও তো সরকারের ওপর কোনো চাপ নেই। অনেক সময় সরকার চায়, তাদের ওপর চাপ আসুক। কিন্তু বামপন্থী-ডানপন্থী কারো তো কোনো কথা নেই। কোথায় সাংস্কৃতিক জোট, কোথায় হেফাজত। শক্ত অবস্থানে তো কাউকে দেখছি না। শত শত লোক মারা যাচ্ছে। একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা হচ্ছে, কিন্তু সবাই নিশ্চুপ। এরা তো মানুষ।
মানবিকতার দিক থেকেও তো কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। ইসলামপন্থী দলগুলোও তেমন কিছু করতে পারছে না। অভ্যন্তরীণ চাপ থাকলেও তো সরকার কিছু করার জন্য তাগিদ বোধ করত।
মিয়ানমার অনেকটা বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র। ১০ বছর আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে তারা বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ছিল। সামরিক সরকার দেখছে তারা কারো সাহায্য ছাড়া এভাবে টিকে থাকতে পারে। এখন মিয়ানমারে এক ধরনের দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক বাড়ছে। আর এর মূলে আছে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ।
চীন এক সময় মিয়ানমারের বড় সহায়ক ছিল। সু চির উত্থানের পরে এখন সেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। ভারত ও জাপানের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাড়ছে। নতুন নতুুন শহর গড়ে উঠছে। যেহেতু মিয়ানমার বিশাল রাষ্ট্র এবং অনেক সম্পদ আছে। বিপুল প্রমাণিত জ্বালানি তেলের মজুদও আছে।
এ ছাড়া চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাড়তি সুবিধা দিয়েছে মিয়ানমারকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে চীনের প্রভাব কমাতে। অন্য দিকে ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। সু চি ভারতে বড় হয়েছেন, লেখাপড়া করেছেন। ভারতের প্রতি তার এক ধরনের দুর্বলতা আছে।
রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা শুধু দেশের সরকারের দায়িত্ব এটা আমাদের প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব, মানব হিসেবে মানবিক দায়িত্ব, নীতি হিসেবে নৈতিক দায়িত্বের ভেতরে পরে।
তাই আসুন, আমরা সকলে নিজ সামর্থ্যনুযায়ী আমাদের নির্যাতিত ভাইবোনদের মুখে একমুঠো অন্ন তুলে দিই। হয়ত এটাই হবে আমাদের জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম।
আল্লাহ'তায়ালা আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।