আলমগীর নিষাদ
অনেকেই একমত হবেন যে, 'রিজওয়ান' নাটকের রস আস্বাদনকারীরা বৃথামাংসভক্ষণকারী। কারণ, প্রথমত এর তিনতলা মঞ্চ, কোরিওগ্রাফি, অধিবাস্তব আড়ম্বর দর্শককে নাটক থেকে সরিয়ে এর খোলস অর্থাৎ ফর্মের আলোচনায় উৎসাহিত করে। অন্যদিকে এসব অনুসঙ্গ হলের পুরোটা সময় দর্শককে জুলুম করেছে। কুশীলবদের ক্রমাগত তিনস্তরে নড়াচড়া, দড়ি বেয়ে ওঠানামা, অতি নাটুকেপনা দেখতে তামাশা লেগেছে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, এই নাটকের দর্শকের জন্য সিটবেল্ট আবশ্যক।
সৈয়দ জামিল আহমেদ সাবেককে আমি চিনি না। তবে মনে হয়েছে ভদ্রলোক 'কিছু একটা করা'র বাসনা থেকে এমনটা করেছেন। মনে করি, তিনি কিছু একটা করতে না চেয়ে যদি কাশ্মীরের সত্যটাকে ধরতে চাইতেন, তবে সার্থক হতেন।
আসলে কাশ্মীরের মতো অত্যুচ্চ ও প্রকাশ্য এক বেদনা বুঝাতে এমন আলো-আঁধারির কসরতের দরকার পড়ে না। নাটক দেখতে দেখতে আমার একবার মনে হয়েছিল, ভারত আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটা প্রেজেন্টেশনের জন্য বুঝি এই 'সান্ধ্যভাষার' আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কিন্তু তা মোটেই নয়, হল থেকে বেরিয়ে ব্রোশিয়ার পড়ে আমি শিউরে উঠেছি! তাতে লেখা আছে- এই নাটক ‘ধর্মান্ধতার কবলে ছিন্নভিন্ন এক ভূখণ্ডের বিপর্যস্ত মানবতার কথা।’ অর্থাৎ সৈয়দ জামিল আহমেদ প্রচার করতে চাইছেন, কাশ্মির সংকট- রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে এখানকার হত্যা-ধর্ষণ-অমানব জীবনের জন্য রাষ্টীয় আধিপত্য নয়, সেখানকার অধিবাসীদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনই দায়ী! (যদিও নাটক দেখে এই বক্তব্য ঠিক বুঝা যায় না, ব্রোশিয়ার পড়তে হয়)।তাহলে সৈয়দ জামিলের এই নাটক কাশ্মিরের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার এক প্রতিক্রিয়াশীল প্রযোজনা।
অর্থাৎ, সৈয়দ জামিলের রিজওয়ান নাটকের এই ফর্ম ভারতীয় সেন্সরের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের দর্শকের সাথে চালাকির জন্য। কাশ্মীর বিষয়ে অহৈতুকি শিল্পকলার আশ্রয়ে তিনি একই সাথে এদেশের কালচারাল আধিপত্যবাদবিরোধী গোষ্ঠীকে ঘোল খাওয়াতে চেয়েছেন, শহুরে মধ্যবিত্ত শিল্পরসবাদীদের কাছে চমক কুড়াতে চেয়েছেন, এবং ভারতীয় আধিপত্যের পক্ষে নৈতিক বয়ান হাজির করে নজরানা আদায় করেছেন। এই হলো রিজওয়ান আখ্যানের নিগূঢ় পাপ। বাংলাদেশের মঞ্চে কাশ্মির প্রেজেন্টেশনের সহজলভ্যতার এই হলো মূল কারণ! কাশ্মিরের মানুষের জন্য মায়াকান্নার আসল রহস্য।
কাশ্মিরি বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি আগা শহীদ আলী রচিত দ্য কান্ট্রি উইদাউট এ পোস্ট অফিস কবিতা অবলম্বনে এই নাটকটি পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।
২ সেপ্টেম্বর থেকে শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে এর প্রদর্শনী চলছে। চলবে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সরকার ও শিল্পকলা একাডেমির যৌথ সহযোগিতায় এটি প্রদর্শিত হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক