পলাশ রহমান
সাংবাদিক
জলি আক্তার। একজন প্রবাসী নারী। স্বামীর সাথে ইতালিতে থাকেন। তার প্রবাস জীবন খুব বেশি দিনের নয়। মাস ছয়েক হবে। এর মধ্যেই তিনি দেখে ফেলেছেন জীবন কত সংকটময়। ইতালির চাকচিক্য, আধুনিকতা এখন আর তাকে টানে না। এই অল্প দিনেই তার মোহ কেটে গেছে। অথচ প্রবাসী ছেলের সাথে যখন বিয়ে হয়েছিল, কতই না পুলকিত হয়েছিল মন। সেই মন এখন আর নেই, ভেঙে গেছে। ইতালিতে আসার মাত্র ১৪ দিনের মাথায় দেশ থেকে খবর আসে তার শ্বশুর আর নেই, মারা গেছেন। প্রবাস জীবনের শুরুতেই এই ধাক্কা মেনে নিতে পারেননি জলি। তার মনের মধ্যে বাসা বাঁধে এক অদৃশ্য ভয়।
জলি উচ্চ শিক্ষিতা মেয়ে। অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে এমবিএও করেছেন। এলএলবি পড়েছেন এক বছর, শেষ করেননি। শেষ করতে পারেননি। এর আগেই বিয়ে হয়ে যায় প্রবাসী ছেলের সাথে। ইতালির ভিসাও মিলে যায় অল্প দিনে। এরপর আর দেরি করেননি। তুর্কি এয়ারলাইনের বোয়িং টিকে-৭১৩’য় চেপে সোজা চলে এসেছেন স্বামীর কাছে। অনেকেই বলেছিলেন, ল’টা শেষ করে যাও। স্বামীরও অমত ছিল না। কিন্তু জলি কারও কথায় কান দেননি। তার একটাই কথা, ক্যারিয়ারের জন্য, অতিরিক্ত সার্টিফিকেটের জন্য তিনি জীবনের চূড়ান্ত ছাড় দিতে পারবেন না। ঘর সংসার তার কাছে অনেক বড়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে ক্যারিয়ার অর্থে আমরা যা বুঝি তা থেকে একটুও কম নয়, বরং ঢের বেশি। জলি মনে করেন, আপন ঘরসংসার ছাড়া একজন মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা আসে না। তার মতে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে ঘর সংসার ঠিক রেখেও গড়া যায়। তাছাড়া একটা সুস্থ সুন্দর সংসার, পরিবার বিনির্মাণ করতে পারাও ক্যারিয়ারের বাইরে নয়। এর জন্যেও শিক্ষা, যোগ্যতা, সাহস এবং ইচ্ছা থাকা চাই।
জলি দেশ থেকেই জানতেন, তার স্বামী বিদেশে বেশ ভালো অবস্থানে আছেন। আর দশজন সাধারণ প্রবাসীর থেকে তিনি একটু আলাদাভাবে জীবনযাপন করেন। তার কাছে প্রবাসী হওয়ার প্রধান বা একমাত্র কারণ টাকা নয়, একটা উন্নত জীবন। স্বামীর এই চিন্তার জায়গা, লাইফ স্টাইল জলিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। নিজেকে সেভাবেই তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। বিয়ের পর কতজন যে কত কথা বলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সব থেকে বেশি বলেছে নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে থেকে। প্রবাসীরা এমন হয়, প্রবাসীরা তেমন হয়, কত যে খারাপ খারাপ কথা তা বলে শেষ করা যাবে না। জলি সে সব কথায় কান দেননি। তিনি নিজে এসে দেখতে চেয়েছেন প্রবাসের বাস্তবতা কী, কেমন? প্রবাসীদের নামে যে মানুষজন এত এত কথা বলে এর সত্যতা কতটুকু? অধিকাংশ প্রবাসীর নাকি দেশে একটা বউ থাকে, বিদেশে আরেকটা। প্রবাসীরা নাকি বিয়ে করে বউ বিদেশে নেয় না। ইচ্ছা করে দেশে ফেলে রাখে। চারিত্রিক দিক থেকে প্রবাসীরা ভালো হয় না। আরও অনেক অনেক কথা।
জলি কারও কথা কানে তোলেননি। তার শুধু বার বার মনে হয়েছে, যারা এসব কথা বলছে তারা তো কোনো দিন প্রবাসে যায়নি, প্রবাসী হয়নি। গল্প শুনে অথবা ধারণা করে এসব কথা বলছে। জীবনের বাস্তবতা জলি নিজেই দেখতে চেয়েছেন এবং এই অল্প দিনেই আত্মীয়স্বজনের বলা সব কথা তার কাছে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। জলি বুঝে গেছেন, দেশে থাকা মানুষরা প্রবাসীদের আসল সংকট জানে না। তারা প্রবাসীদের প্রকৃত সংকটের ধারেকাছেও যেতে পারে না। দেশে থেকে হয়তো প্রবাসীদের সংকট বোঝা সম্ভবও হয় না।
আর্ট ফেস্টিভ্যাল
জলির স্বামী একজন প্রবাসী চাকুরে। বছরে এক মাস ছুটি পান। গোটা সময়টা তিনি দেশে কাটানোর চেষ্টা করেন। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন। জলি ইতালিতে আসার আগেও তাই করেছেন। ছুটিতে দেশে গিয়ে জলিকে সাথে নিয়ে এসেছেন। শুরুর দিনগুলো খুব ভালো কাটছিল। একদম স্বপ্নের মতো। ডকুমেন্ট সংক্রান্ত কিছু ব্যস্ততার বাইরে সারাক্ষণ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ, পাখির মতো ওড়াউড়ি। মাত্র দু’সপ্তাহে জলি ইতালির কত কি যে দেখে ফেলেছেন তা লিখতে গেলে একটা মহাকাব্য হয়ে যাবে।
ইউরোপের জলকন্যা ভেনিস যে সুন্দর একটা নগর তা জলি আগে থেকেই জানতেন। অনেক গল্প শুনেছেন। বই পড়েছেন, ফিল্ম দেখেছেন। কিন্তু এখানে আসার পরে মনে হয়েছে তিনি যা জানতেন তা খুবই সামান্য। জলি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছেন রাতের ভেনিস দেখে। সান মারকোয় বেহালার সুর শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। তার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল, রাতের অন্ধকারে প্রিয়জনের হাত ধরে বেহালা শুনবেন। সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছে ইতালিতে পা রাখার মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই। জলি এতদিন জানতেন বেহালা মানেই করুণ সুর, নরম সুর। কিন্তু এখানে এসে তার সে ভুল ভেঙেছে। বেহালার সুরও যে মানুষকে নাচাতে পারে তা জীবনের প্রথম দেখেছেন ইউরোপের জলকন্যা ভেনিসে।
জলি যখন ইতালিতে আসেন তখন ভেনিসে বিশ্ব বিখ্যাত কার্নেভালে উৎসব চলছিল। মানুষ যে কতভাবে আনন্দ করে, জীবনকে উপভোগ করে কার্নেভালে না দেখলে বোঝা যাবে না। ছোট সময় জলিদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। যেমন খুশি তেমন সাজার একটা প্রতিযোগিতা থাকতো। কার্নেভালের উৎসব দেখে অনেক দিন পর জলি আবার সেই স্কুল জীবনে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশ থেকে এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। শহরের স্কুলগুলোতে তো নেই’ই, গ্রামের স্কুলগুলোতেও বিলুপ্তপ্রায়। অথচ এগুলোই আমাদের আসল সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য। এগুলো বাঁচিয়ে রাখার দরকার ছিল।
কার্নেভাল
কার্নেভালে শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল আন্তর্জাতিক আর্ট ফেস্টিভ্যাল। গোটা দুনিয়ার শিল্প এবং শিল্পবোদ্ধায় ভরে গেল ভেনিস। সনাতন ধর্মের মানুষরা যেমন বারো মাসে তেরো পূজা করেন, তেমনি ভেনিসেও বারো মাসে তেরো উৎসব লেগে থাকে। শিল্প চিন্তায় দুনিয়ার মানুষ যে কত এগিয়েছে তা ভেনিসের বিশ্ব আর্ট ফেস্টিভ্যাল না দেখলে হয়তো জানা হতো না। এত এত আনন্দঘন সময়ের মধ্যে হঠাৎ দেশ থেকে খবর এলো জলির শ্বশুর মারা গেছেন। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বিবর্ণ হয়ে গেল।
শ্বশুরের সাথে জলির খুব একটা মধুর সম্পর্ক ছিল। প্রতিদিন সকালে তিনি অপেক্ষা করতেন, কখন জলি ফোন করবে। কোনো দিন একটু দেরি হলে নিজেই ফোন করে বসতেন। অনেক অনেক গল্প করতেন। গল্প বলতেন, গল্প শুনতেন। নিত্যদিনের সব খোঁজখবর নিতেন। মৃত্যুর ক’দিন আগে থেকে তিনি বার বার জলিকে বলতেন, তোমার সাথে আমার কি আর দেখা হবে?
জলির খুব ইচ্ছা ছিল শ্বশুর-শাশুড়িকে একবার ভেনিসে নিয়ে আসবেন। তাদের সাথে রাতের ভেনিস দেখবেন। বেহালার সুর শুনবেন। গোনদোলায় চড়বেন। সাগরের পানিতে পা ভেজাবেন। এসপাগেত্তি কন গামবেরেত্তি খাবেন। কিন্তু তা আর হলো না। জলিকে সে সময় না দিয়েই পরপারে চলে গেলেন তার প্রিয় শ্বশুর।
জলি আক্তার
সেদিন সকাল বেলা। জলি রান্নাঘরে চা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। এমন সময় দেশ থেকে ফোনটা এলো। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। গরম চা পাতিলেই শুকিয়ে গেল। নুতেল্লা মাখানো রুটি পড়ে থাকলো এক পাশে। কি করবেন, কি করবেন না, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ঠিক এ সময়ই জলি উপলব্ধি করতে পারেন প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় সংকট। অসহায়ের মতো বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। শ্বশুর মারা যাওয়ার মাত্র দু’সপ্তাহ আগে দেশ থেকে এসেছেন জলি এবং তার স্বামী। ইচ্ছা করলেই এখন আবার দেশে যাওয়া সম্ভব না। কর্মস্থল থেকে ছুটি পাবেন না তার স্বামী। হুট করে টিকেট পাওয়াও সহজ নয়। কোনোভাবে ম্যানেজ করা গেলেও দেশে পৌঁছতে প্রায় দেড় দিন লেগে যাবে। ততক্ষণে শ্বশুরের দাফন হয়ে যাবে। জানাজায় শরিক হওয়ারও সুযোগ থাকবে না। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
জীবনের এত কঠিন বাস্তবতা জলি আর কোনো দিন দেখেননি। দেখতে চানও না। সে দিনের সেই সকাল থেকে তার মনের মধ্যে এক বিশাল পাহাড়সম ভয় বাসা বেঁধেছে। আর কিছুই তার ভালোলাগে না। ইউরোপের কোনো চাকচিক্যই তাকে আর টানে না। সব কিছু বিবর্ণ, নিরর্থক মনে হয়। একদণ্ডও দাঁড়াতে ইচ্ছা করে না প্রবাসে। শুধু বার বার মনে হয় প্রবাস জীবন কতই না সংকটময়। কতই না নিষ্ঠুর। এই নিষ্ঠুরতা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। বিস্তর আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। দূর আকাশে উড়ে যাওয়া প্লেন দেখেন। আর মনে মনে ভাবেন- মানুষের জীবন এত সংকটময় কেন?
প্রডিউসার: রেডিও বেইস ইতালি