মাওলানা ফজলুর রহমান। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সভাপতি। পাকিস্তানের একজন প্রভাবশালী আলেম রাজনীতিবিদ। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণের পরিমার্জিত অনুবাদ তুলে ধরেছেন মাওলানা মাহমুদ হাসান মাসরুর।
গত পর্বের পর
১৮৫৭ সালে বৃটিশরা আলিগড় ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ভার্সিটির কারিকুলাম থেকে কুরআন-সুন্নাহ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু এমনভাবে বিদায় করা হয়, যাতে আগামী প্রজন্মের মুসলমানরা হয়তো শুধু এতটুকুই জানবে তারা মুসলমান; এর বেশি কিছুই নয়। তখন বৃটিশদের এই দূরভিসন্ধি মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয় দীনী মাদরাসা। এখন আপনারাই বলুন, ইউরোপ-আমেরিকার যে চিন্তাধারা ও কর্মধারা, তা থেকে দীনী মাদরাসার প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ আছে বলে মনে হয়? কুরআন-সুন্নাহর ইলম বাকি রাখার কোনো সদিচ্ছা তাদের আছে কি? আমাদের বিশ্বাস, দীনী মাদরাসার প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই, তারা বরং এর বিনাশ কামনা করে।
এমতাবস্থায় আপনারা যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে সংস্কার-সমন্বয়ের কথা বলেন, তখন আপনাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা এবং আপনাদের প্রতি অনাস্থা আসা এক স্বাভাবিক ব্যাপার।
সুতরাং আপনারা প্রথম আমাদেরকে আস্থায় নিন যে, আপনারা আমাদের উন্নতির কথা ভাবছেন, কুরআন-সুন্নাহর ইলম হেফাজতের চিন্তা করছেন, এই ইলম থেকে যে আইন ও কানুন উৎসারিত হয়, তা দেশে প্রয়োগ করার অভিপ্রায় লালন করছেন। কিন্ত যদি ব্যাপারটা এরকম হয় যে, ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এমন সব ফর্মূলা প্রয়োগ করতে থাকবেন, যাতে এ শিক্ষা ব্যবস্থা একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাহলে আমাদের পক্ষে এ সমস্ত শ্রুতিমধুর প্রস্তাব মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
এমন প্রস্তাবনা আগেও এসেছে, এখনো আসছে। তখনও উদ্দেশ্য ছিলো এই শিক্ষাব্যবস্থার বিলোপ সাধন, এখনও তাই। সুতরাং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আমাদেরকে জ্ঞান দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এ প্রয়োজন আমরা নিজেরাই বুঝি। আমরা যখন রাষ্ট্র চালাবো, তখন রাষ্ট্রের সকল সেক্টর পরিচালনা করার জন্য এবং জনগণের সকল চাহিদা মেটানোর জন্য যোগ্য লোক আমাদের মধ্য হতেই সরবরাহ করতে হবে ।
আমার বিশ্বাস, যদি কেউ দীনী মাদরাসার নেসাব শেষ করে এবং এখন থেকে তরবিয়ত গ্রহণশেষে আধুনিক বিষয়ও অধ্যয়ন করে, তারপর রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশ গ্রহণ করে, তবে ইনশাআল্লাহ ধোঁকা-প্রতারণা, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি যতসব অনৈতিকতার নামগন্ধও মুছে যাবে। দীনী মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব না থাকায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যায় নি। এবং ইসলামের নামে পাকিস্তান হলেও তা ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে ওঠে নি।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা আরজ করছি। সাধারণ মানুষ যাতে দীনী শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে যায়, এজন্য বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর পক্ষ হতে দীনী শিক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। সমাজ থেকে আলেমগণকে বিচ্ছিন্ন করার মানসে চরমপন্থী, উগ্রপন্থী, জঙ্গী-সন্ত্রাসী ইত্যাদি অভিধা আবিষ্কার করা হয়েছে।
এ অপপ্রচারে আমাদের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা ভেবে কূল পাই না। উম্মতের বিরাট অংশ আমদের থেকে এবং কুরআন-সুন্নাহর ইলম থেকে দূরে সরে গেছে। আবার এদেরকে আমরা কাছে টানার চেষ্টা করছি, বিশ্ব সম্প্রদায়কে বুঝ দিয়ে চলছি যে, মাদরাসাগুলো শান্তিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, এগুলোতে ইনসাফ ও মধ্যপন্থার তালিম দেওয়া হয়। আর রাজনৈতিক ফ্লাটফরম থেকে এমন এমন কাজ আমাদের করতে হয়েছে, যার ফলে আপনজনরাও ভুল বোঝা আরম্ভ করেছিলো। তারাও বুঝতে পারছিলো না আমরা কী করছি! এমন কঠিন সময় আমরা পার করেছি এবং করে যাচ্ছি।
যেহেতু ১৯৮০ সনের পর থেকে আফগান জিহাদের উসিলায় আমাদের দেশে জিহাদী জযবাপূর্ণ একটি পরিবেশ বিদ্যমান। তখন আমাদের জোয়ানদেরকে উৎসাহ দিয়ে আফগান জিহাদে পাঠানো হতো। দুশমনেরা আমাদের সমাজের এই শক্তিটাকে টার্গেট করে নানা উপায়ে তাদের মাঝে ক্ষোভ তৈরির কৌশল হাতে নিয়েছে। যাতে তারা অস্ত্র ধারণ করে স্থানীয় সরকারের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
মাদরাসা ও দীনদার শ্রেণিকে দোষী সাব্যস্ত করে নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমেই তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার প্লান করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের ফলেই আজ কোথাও এধরনের অস্ত্র উঠলে মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে নির্বিচারে সবকিছ তছনছ করে দিতে তৎপর রয়েছে।
এজন্য আমরা আমাদের দেশে সশস্ত্র তৎপরতাকে আত্মঘাতী বলে আখ্যায়িত করলাম, শান্তিপূর্ণ তৎপরতার প্রতি সকলকে আহবান জানালাম। এতে দুশমনের ষড়যন্ত্র অনেকটাই ব্যর্থ হয়েগেলো। তাই আমাদের বিরুদ্ধে পুরো শত্রুজগতের অভিযোগ, আমরা কেন আমাদের লোকজনকে শান্ত থাকতে বললাম, অস্ত্র ধারণে বাধা দিলাম। মাদরাসা, দীনদার শ্রেণি ও যুবকদেরকে কেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম অস্ত্র ধরতে দিলো না!
অন্যথায় সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই ইসলামী আইন ও সংস্কৃতির দাবী চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়া যেতো! দুচারজন যুবক যাদের হাতে অস্ত্র রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই নেই দুশমনের, ওরা তো বরং শত্রুদের বড় কাঙ্খিত! কিন্তু যারা ইনসাফের সাথে বিচার-বিবেচনা করে কাজ করার কৌশল শেখায়, তারাই দুশমনের চোখে বেশি ভয়ংকর!
শত্রুপক্ষের কলামিস্টরা লিখছেও যে, এখন যারা শান্তিপূর্ণ রাজনীতি ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করে কাজ করছে, আমাদের লক্ষ বাস্তবায়নে তারাই বড় বাধা! কারণ চেতনাগতভাবে ইসলামী ভাবধারা অবশিষ্ট থাকার কারণ এরা, এদের কারণে দীনী মাদরাসা, শরঈ ইলমের চর্চা এবং ধর্মীয় তৎপরতাসমূহ রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।
এখান থেকে আপনারা বুঝে নিতে পারেন, আমাদের সামনে কত বড় বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে! কত গভীরে গিয়ে এসবের মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমাদের। ওদের চালগুলো ধরতে আমাদের অনেকের অনেক দেরি হয়ে যায়। প্রথম প্রথম তো আমাদেরও মাথায় ধরে না। কিন্তু ওদের প্রাত্যহিক তৎপরতার উপর নজর রাখলে পিছনে কোন এজেন্ডা কাজ বরছে ধরে ফেলা যায়। এজন্য দরকার হলো, এই ধরনের অবস্থায় আপনারা আপনাদের এই সেবকদের প্রতি আস্থা রাখবেন। আমি আপনাদের একজন খাদেম একথা মনে রাখবেন।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের শতবর্ষপূর্তি সম্মেলনে ৫০ লক্ষ মানুষ একত্রিত হয়েছে। এটা আমার কথা নয়; গোয়েন্দাদের রিপোর্ট। ১০/১৫ দেশ থেকে ওয়াফদ আকারে কিছু মেহমান এসেছেন আর সবাই পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। আলেম-ওলামা, ধর্মপ্রাণ মানুষ, বুজুর্গানে দীন এবং জনসমর্থনের এত বিশাল শক্তি সাথে নিয়ে আমরা যখন এক স্টেজে দাঁড়াই, তখন আমাদের পক্ষ হতে বিশ্ববাসীর সামনে হাজারো ম্যাসেজ পৌঁছে যায়।
দীন রক্ষার জন্য আমাদের লড়তেই হবে। কখনো জয়ের লড়াই কখনো শুধু বাঁচার লড়াই। বড় কঠিন পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করছি। ইমাম আবু হানিফা রহ. এর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে মানাযির আহসান গিলানী রহ. ২৫ বছরের অনুসন্ধান একত্রিত করে একটি কিতাব লিখেছেন। ইমাম আবু হানিফার জীবদ্দশায় যতজন শাসক এসেছে, তাদের কার্যকলাপের কী কী প্রভাব ইমাম আবু হানিফার জীবনে পড়েছে তার বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে ঐ কিতাবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাসকদের সঙ্গে ইমাম আবু হানীফা রহ. এর দ্বিমত ছিলো। কিন্তু তিনি তাঁর শিস্য-সমর্থকদেরকে ক্ষুব্ধ হতে বারণ করতেন, শান্ত্ব থাকার আদেশ দিতেন, এখনো সংঘাতে অবতীর্ণ হওয়ার সময় হয়নি বলে নিরস্ত্র রাখতেন। এভাবে ১৪ বছর গত হয়েছিলো। এই অবসরে তিনি ফিকহের কাজ শেষ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন।
আজ আমরা যারা রাজনীতির সাথে জড়িত, আমদের সামনেও অনেক অনেক বাধা, অনেক বিপত্তি। এগুলোর মোকাবেলা করে আমাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু আমরা আমাদের আকিদা ছাড়ি নি, মাসলাক ছাড়ি নি, আকাবিরের আমানত আমরা ছুঁড়ে ফেলি নি। আমাদের সব প্রয়াস এগুলো সংরক্ষণের জন্যই নিবেদিত। আগামী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দেয়াই আমাদের মিশন।
দেশের রাজনীতিতে আমরা যখন এতদূর এগিয়ে গিয়েছি, তখন দেশ পরিচালানায় অংশ গ্রহণের জন্য আপন মতাদর্শের লোক আমাদের খুব প্রয়োজন। এই জনবল কিভাবে তৈরি হবে, সময়ের এই চাহিদা কিভাবে পূরণ হবে, অন্তরে অনেক প্রশ্ন! এক্ষত্রে আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি। জামিয়াতুর রশীদ এই ধারার কাজ করার আগ্রহ রাখে, এটা আরও গতিশীল করা দরকার।
আজ এই সংক্ষিপ্ত আসরে আপন লোকদের সাথে মন খুলে কিছু কথা বললাম। আমি যা কিছু আরজ করেছি, তাই চূড়ান্ত নয়। প্রিয়জনদের কাছে শুধু আমার মতটা তুলে ধরলাম। এ বিষয়ে আরও বেশি পথনির্দেশ প্রয়োজন। মাওলানার সাথে আমার যখনই সাক্ষাৎ হয় এসব বিষয় আলোচনা হয়। সহমতের মানুষ হিসেবে মাওলানাকে আমার বড় ভালো লাগে। আল্লাহ তাআলা আমাদের কাজ আসান করে দিন। আমিন।
অনুবাদক : মুহাদ্দিস, দিলুরোড মাদরাসা, নিউ ইস্কাটন, ঢাকা-১০০
প্রথম পর্ব : যে কারণে পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে উঠলো না