রোকন রাইয়ান
চলতি বছরে প্রথমবারের মতো কওমি মাদরাসায় ৬ বোর্ডের সম্মিলিত দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৫ জুলাই এর ফলাফল প্রকাশের পর কিছু বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক চলমান। কে কার থেকে এগিয়ে, সফলতায় পিছিয়ে কারা- তার হিসেব নিকেশ চলছে এখনো। কারো সাফল্যকে চাপিয়ে রাখতে আবার দেয়া হচ্ছে ভুল ম্যাসেজ।
এই ভুল ম্যাসেজের শিকার হয়েছেন মুহাম্মদ ইয়াসীন। রাজধানীর মাদরাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর থেকে তিনি দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধা তালিকায় ১ম স্থান অধিকার করেছেন। তবে তার ব্যাপারে কারও কারও বক্তব্য, তিনি বছর দুয়েক আগে সিলেটের দরগাহ মাদরাসা থেকে দাওরা পরীক্ষা দিয়েছেন এবং এটা তার দ্বিতীয় বারের মতো পরীক্ষা। সিলেটিরা আবার তাকে ভুল করে সিলেটের দাবি করে ক্রেডিট নিতে চেয়েছেন।
এসব নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করলেন মুহাম্মদ ইয়াসীন। তিনি বলেন, আমি দ্বিতীয়বার নয় প্রথম বারই দাওরা পরীক্ষা দিয়েছি এবং আমার বাড়ি সিলেটে নয় নেত্রকোণায়।
মাওলানা ইয়াসিন মনে করেন, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই অন্যের সফলতা নিয়ে এমন বিরুপ মন্তেব্যের সৃষ্টি। তার পরামর্শ- সাফল্য নয়, পড়ালেখার মান নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেই সফলতা আসবে।
প্রথম বারের মতো মাস্টার্সের স্বীকৃতি প্রাপ্ত দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম হিসেবে অনেকের টার্গেট ছিল ভালো রেজাল্ট করা এবং ভালো ফলাফল ধরে রাখা। এ কারণেই ফলাফল নিয়ে ব্যাপক প্রতিযোগিতা ও উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গেছে।
যা নিয়ে বিভ্রান্তি
গত ২৫ জুলাই ফলাফল প্রকাশের পরপরই অনলাইন অফলাইনে প্রচুর আলোচনা সৃষ্টি হয়। কোন প্রতিষ্ঠান কয়টা মুমতাজ আর মেধা তালিকায় স্থান করতে পারল তা নিয়ে চলে তর্ক বিতর্ক। বিষয়গুলো নিয়ে অনেক জলঘোলা হলেও বিভ্রান্তি শেষ হয়নি। বরং অনলাইনে এগুলোর আলোচনা কিছুটা স্তিমিত হলেও অফলাইনে এখনো অব্যাহত। আলাপে আলোচনায় উঠে আসছে প্রসঙ্গটি। আর এসবে অবধারিতভাবেই থাকছে ভুল ধারণাগুলো।
ভুল ধারণাগুলো নিরসনের জন্য অনেকেই আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন বিষয়টি সঠিক তদন্ত করে সত্যগুলো সামনে আনতে। সে কারণে দেরিতে হলেও বিষয়টি পুনরায় সামনে আনতে হলো।
প্রথম স্থান অধিকারকারী মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াসীনের প্রতি অভিযোগ- এর আগে তিনি সিলেটের জামিয়া দরগাহ থেকে দাওরা পড়েছেন, দাওরায়ে হাদিসের সনদের সরকারি স্বীকৃতি হওয়ায় আবারও তিনি ঢালকানগর থেকে পরীক্ষায় অংশ নেন।
এ বিষয়ে আমরা প্রথমেই যোগাযোগ করি ঢালকানগর খানকায়ে আশরাফিয়া’র পীর সাহেব ও মাদরাসা বাইতুল উলুমের মুহতামিম মাওলানা মুফতি জাফর আহমদের সঙ্গে। তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, কারও কারও থেকে এ অভিযোগটি আমার কানেও এসেছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট তথ্য।
তিনি বলেন, একজন ছাত্র একই জামাতে দুইবার পরীক্ষা দেবে এটা আমাদের প্রতিষ্ঠানের নীতিবিরুদ্ধ। আর আমরা নিয়মের প্রতি এতই শ্রদ্ধাশীল যে আমার ছেলে পরীক্ষায় বাইতুল উলুমে থাকার নির্ধারিত নম্বর থেকে কিছু কম পাওয়ায় তাকেও এখানে পড়ার সুযোগ দেইনি।
বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে আমরা বেফাকের ৩৯ তম (গত বছরের) কেন্দ্রীয় পরীক্ষার রেকর্ড বই দেখি। সেখানে ফজিলত (মেশকাত) শ্রেণিতে মুহাম্মদ ইয়াসীনের নাম রয়েছে। এ রেকর্ড বইয়ের পর আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না তিনি এবারেরই দাওরা পরীক্ষার্থী।
নেত্রকোণার ছেলে মুহাম্মদ ইয়াসীন
মুহাম্মদ ইয়াসীনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ থানার নলজুরী। তবে বিষয়টি নিয়েও হয়েছে জলঘোলা। ফলাফল প্রকাশের পরপর তাকে নিয়ে সিলেটবাসীরা তাদের ছেলে বলে প্রচার দিয়েছেন। কিন্তু তথ্যাটি ছিল ভুল।
সেটি খোলাসা করলেন মুহাম্মদ ইয়াসীন। বলেন, সিলেটের দরগাহ মাদরসায় বছর দুয়েক আগে এক শিক্ষার্থী দাওরা পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সে পরের বছর বাইতুল উলুম ঢালকানগরে উলুমুল হাদিসে ভর্তি হয়। এজন্যই সিলেটের মাদরাসা শিক্ষার্থীরা প্রথমে মনে করছেন এই ইয়াসীনই হাইআতুল উলয়ায় দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়েছেন এবং মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে দরগাহ মাদরসার মুহাদ্দিস মাওলানা জুনায়েদ কিয়ামপুরী আওয়ার ইসলামকে বলেন, হ্যাঁ এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। ১ম স্থান অধিকারকারী মুহাম্মদ ইয়াসীন আমাদের ছাত্র নয়, বরং সে মাদরাসা বাইতুল উলুমেরই ছাত্র। তবে একই নামে আমাদের একজন শিক্ষার্থী বছর দুয়েক আগে ফারেগ হয়েছেন।
দরগাহ মাদরাসার দাওরা ফারেগ মাওলানা ইয়াসিন বর্তমানে জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগে ইফতা পড়ছেন। তাকে নিয়ে বিভ্রান্ত্রি ছড়িয়ে পড়ায় সেও বিরক্ত। বাইতুল উলুম ঢালকানগরের মুহাদ্দিস ও ইফতা বিভাগের মুশরিফ মুফতি হাবিবুল্লাহ মিসবাহ’র কাছে মাওলানা ইয়াসিন জানিয়েছেন, যাচাই ছাড়া এমন প্রচারে সত্যিই অবাক হয়েছি এবং এ কারণে আমি দুঃখিত। অতি আবেগী আমার কিছু সহপাঠী ও বন্ধুরা এ কাজটি করেছে।
অন্য পরীক্ষাতেও সফল ইয়াসীন
নেত্রকোণার এক মাদরসায় মিজান পর্যন্ত পড়ার পর বাইতুল উলুম ঢালকানগরে মুতাওয়াসসিতায় ভর্তি হন ইয়াসীন। সেটি ছিল ২০১১ সাল। বেফাকের ৩৪ তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। এ বছরই সফলতার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। সারা বাংলাদেশে তিনিই ১ম স্থান অধিকার করেন।
দাওরার আগে বেফাকের আরও দুটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষাতেও হতাশ করেননি মুহাম্মদ ইয়াসীন। সানাবিয়্যাহ উলয়া’য় মেধা তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান এবং ফজিলতে মেধা তালিকায় অর্জন করেছেন ৩য় স্থান। এভাবেই তিনি নিজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে দাওরায়ে হাদিসে ১ম স্থান অর্জন করেন।
ধারাবাহিক সাফল্যের বিষয়ে মুহাম্মদ ইয়াসীন আওয়ার ইসলামকে বলেন, নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছা, মেধাকে কাজে লাগানো, শৃঙ্খলা মেনে পড়াশোনা করা এবং উস্তাদদের সঠিক নেগরানিই একজন শিক্ষার্থীকে উচ্চতার মাপকাঠিতে নিয়ে যেতে পারে। মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার শর্টকার্ট কোনো পন্থা নেই। এর জন্য আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ও মেহনতই বড় করে দেখতে হবে।
বাইতুল উলুম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কি পূরণ হচ্ছে?
বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের পরীক্ষায় প্রতিবছরই মেধাতালিকায় প্রথমদিককার স্থানগুলো দখলে রাখে বাইতুল উলুমের শিক্ষার্থীরা। ধারাবাহিক এ সাফল্যের পেছনে কী কারণ? এ নিয়ে পূর্বে একটি প্রতিবেদন করা হয়েছিল। পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বাইতুল উলুমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আধ্যাত্মিক রাহবার পীরে কামেল হজরতওয়ালা করাচি রহ. এর হাত ধরে। প্রতিষ্ঠাকালীন চিন্তা ছিল অল্প শিক্ষার্থী নেয়া হবে যাদের সবাইকে গড়ে তোলা হবে যোগ্য শিক্ষক ও মুহাক্কিক রব্বানি আলেম হিসেবে। যারা পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করে দীনের খেদমত করে যাবে। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের দিকে তাকালে ঠিক তাই দেখা যায়। বাইতুল উলুম তার লক্ষ অর্জনে অটল ও অবিচল।
এ উদ্দেশ্য এখন কতটা সফল এ বিষয়ে কথা হয় মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম ও খানকার পীর মুফতি জাফর আহমাদের সঙ্গে। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ বাইতুল উলুম যে উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে তা অর্জনেও পিছিয়ে নেই। এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মাদরাসার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে বাইতুল উলুমের ফুজালা। আছে অনেক ফতোয়া বিভাগের দায়িত্বেও। এছাড়াও প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন মাদরাসা থেকে ফোন করে আমাদের কাছে শিক্ষক চাওয়া হয়। মূলত বাইতুল উলুমের প্রতি সবার একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা ইলম ও আমলে যথেষ্ট অগ্রগামী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ প্রতিষ্ঠানের খেদমতকে আমাদের সবার জন্য সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
আরও পড়ুন: আমি কী ক্ষমারও যোগ্য নই?