মুহাম্মদ সেলিম: ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা ছুঁই ছুঁই। মাদরাসা মসজিদে চলছিল মুয়াজ্জিনের আজানের প্রস্তুতি।
ঠিক একই সময় এর লাগোয়া মন্দিরের পুরোহিতও ব্যস্ত ছিলেন পূজার প্রস্তুতি নিয়ে। মুয়াজ্জিন-পুরোহিত একই জায়গায় একই সময় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের আরাধনার প্রস্তুতি নিলেও কেউ কারও প্রার্থনার ব্যাঘাত ঘটান না কখনো। দুই তরফ থেকেই সচেতন দৃষ্টি রাখা হয়- যেন অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রার্থনায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। এ কারণে হাটহাজারী সদরে অবস্থিত কওমিদের শীর্ষ মাদরাসা ‘দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা’ এবং ‘শ্রী শ্রী সীতাকালী মন্দির’ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছেন স্থানীয় লোকজন।
হাটহাজারী মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, ‘হাটহাজারী মাদরাসা অন্য ধর্মের অনুসারীদের সব সময় সম্মান করে। শত বছরের অধিক সময় ধরে ভিন্ন ধর্মের দুটি প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি থেকে যার যার মতো করে ধর্মীয় রীতি পালন করছে। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসাধারণ একটি উদারহরণ। ’
শ্রী শ্রী সীতাকালী মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক উদয় সেন বলেন, ‘হাটহাজারী মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সব সময় মন্দিরের ব্যাপারে আন্তরিক। তারা কখনো আমাদের ধর্মের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় না। আমরাও চেষ্টা করি, যাতে আমাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের কোনো ক্ষতি না হয়। শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম যার যার অবস্থানে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। ’
হাটহাজারী সদর বাজারের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মাদরাসা। এর ক্যাম্পাসে রয়েছে একাধিক মসজিদ ও দেশের আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। শত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসার সীমানা দেয়ালের সঙ্গে গড়ে উঠেছে সনাতন ধর্মের কালীমন্দির। একশ বছরেরও আগে কয়েকজন জমিদার শ্রী শ্রী সীতাকালী নামে এ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে দুই ধর্মের অনুসারীরা সহঅবস্থানে থেকে যার যার মতো করে ধর্মীর আচার-অনুষ্ঠান পালন করছেন। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে এ নিয়ে কারও মধ্যে কোনো বৈরী অবস্থা তৈরি হয়নি। বাবরি মসজিদ ভাঙা, কিংবা গুজরাটের দাঙার রেশ, কিংবা হালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলেও— এখানে ছিল ব্যতিক্রমী চিত্র। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়ও একে-অপরের ওপর হামলা তো দূরে থাক, উল্টো মাদ্রাসা ছাত্ররা পাহারা দিয়ে মন্দিরকে রক্ষা করেছেন। এসব কারণেই হাটহাজারী মাদ্রাসা এবং মন্দিরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন সচেতন সবাই।
প্রায় দুই যুগ ধরে সীতাকালী মন্দিরে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছেন ভানু প্রসাদ ভট্টাচার্য। তিনি প্রতিবেশী অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। হাটহাজারী মাদরাসা ও সীতাকালী মন্দিরের পাশাপাশি অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে এ মন্দিরের সেবা করছি। কখনো হাটহাজারী মাদরাসার কেউ, কিংবা আশপাশের কোনো মুসলমান আমাদের প্রার্থনার সময় ডিস্টার্ব করেননি। বরং তারা সব সময় আমাদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করেছেন। মন্দির ও মাদরাসা পাশাপাশি অবস্থান করাটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ’
তিন যুগের অধিক সময় ধরে হাটহাজারীতে সাংবাদিকতা করছেন কেশব কুমার বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘হাটহাজারী মাদরাসা ও মন্দিরের অবস্থান পাশাপাশি হলেও কখনো হামলা কিংবা ঢিল ছোড়া-ছুড়ির মতো ঘটনাও ঘটেনি। বরং সব সময় তাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক আচরণ দেখেছি। যা এক কথায়— অনন্য। ’
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী বলেন, ‘কওমি আলেমরা অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল— তার জ্বলন্ত উদাহরণ হাটহাজারী মাদরাসা ও মন্দিরের পাশাপাশি অবস্থান।’
দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার মুখপত্র মাসিক মঈনুল ইসলাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা মুনির আহমদ বলেন, ‘এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন ইসলাম শিক্ষাকেন্দ্র হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান জামে মসজিদের মাত্র ৫ গজের মধ্যেই হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রী শ্রী সীতাকালী মায়ের মন্দির। মসজিদ-মন্দিরের পাশাপাশি এই প্রতিচ্ছবিটিই বলে দেয়— বাংলাদেশের মুসলমানরা কতটা সুন্দর সহনশীল জাতি এবং কত বেশি উদার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলেন।
হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ১১৭ বছরে হিন্দু সম্প্রদায় ও জামিয়ার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার ইতিহাস নেই। মন্দিরকে ঘিরে হিন্দুদের অনেক দোকানপাট আছে। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা সেসব দোকানপাট থেকেই নিত্য বাজার-সদাই করে থাকেন।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন