মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব :
সম্পদ মানুষের জীবনের এক অনিবার্য প্রয়োজন। দ্বীনের ওপর চলার জন্য পার্থিব জীবনে অর্থেরও প্রয়োজন আছে। এই প্রয়োজন শুধু আমাদের এই আধুনিক কালেরই নয়; বরং আদিকাল থেকেই মানুষ উপার্জননির্ভর জীবনযাপন করছে। আত্মমর্যাদার সঙ্গে সামাজিক জীবনযাপনের জন্য অর্থসম্পদকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সৎ ও আদর্শবান মানুষের জন্য কপর্দকশূন্য জীবনযাপন করা ও জীবন-জীবিকার অর্থনৈতিক ভার অন্যের ঘাড়ে চড়ানো বা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সমীচীন নয়। সন্তানদের ভিখারিবেশে রেখে যাওয়াও মানমর্যাদার পরিপন্থী।
তবে ইসলাম মানুষের এই প্রয়োজন ও আত্মমর্যাদাকে উপেক্ষা করেনি। হাদিসের ভাষ্য দেখুন, হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজের সময় সেই অসুখে আল্লাহর রাসুল সা. আমাকে দেখতে এলেন, যে অসুখে আমি মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়াই। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার যন্ত্রণার অবস্থা আপনি দেখেছেন। আর আমি একজন সম্পদশালী মানুষ। আমার একমাত্র কন্যা ছাড়া কোনো ওয়ারিশ নেই। আমি কি আমার দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করে দেব? রাসুল সা. বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে কি অর্ধেক সম্পদ দান করে দেব? বললেন, না। এক-তৃতীয়াংশ (দান করে দাও) আর এক-তৃতীয়াংশ অনেক। আর তুমি তোমার ওয়ারিশদের অসহায় এবং মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছে এ অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে ধনী অবস্থায় রেখে যাওয়া ভালো। (মুসলিম : ১৬২৮, বুখারি : ১২৯৫)।
হাদিসটিকে আমরা এ বিষয়ে মূলনীতির মর্যাদা দিতে পারি। এ হাদিসের শিক্ষা হলো, সম্পদ সঞ্চয় করা অবৈধ নয়। সন্তানের জন্য সঞ্চয় করে রেখে যাওয়াকে ইসলামও উৎসাহিত করেছে। উদারপ্রাণে সবকিছু বিলিয়ে দেয়া, যাতে পরক্ষণেই অন্যের কাছে হাত পাততে হয় তা কাম্য নয়। রাসুল সা. ও সম্পদ সঞ্চয় করেছেন বলে আমরা দেখতে পাই। যেমন_ বোখারি শরিফের একটি হাদিসে আছে, হযরত উমর রা. থেকে বর্ণিত, হযরত রাসুল সা. বনু নজিরের খেজুর গাছ বিক্রি করে দিতেন আর পরিবারের জন্য এক বছরের খোরাক রেখে দিতেন। (বোখারি : ৫৩৫৭)।
এ সম্পর্কে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। হযরত লাকীত ইবনে সাবুরা রা. বলেন, আমি বনু মুন্তাফিকের প্রতিনিধি কিংবা প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে হযরত রাসুলকে সা. এর খেদমতে গিয়েছিলাম। যখন রাসুল সা. কাছে এলাম তাকে তখন ঘরে পেলাম না। ঘরে পেলাম উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা রা. কে। তিনি আমাদের জন্য গোশত ও ছাতুর মিশ্রণে 'খাজিরা' নামক খাবার তৈরির আদেশ দিলেন। আমাদের জন্য সেই খাবার রান্না হলো। আমাদের সামনে পাত্রে করে তা পরিবেশিত হলো। তারপর রাসুল সা. আগমন করলেন। বললেন, তোমরা খাবার কিছু পেয়েছ? যা কিছুর আদেশ করা হয়েছে? আমরা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! পেয়েছি। আমরা রাসুল সা. এর দরবারে বসে আছি, এরই মধ্যে রাখাল তার ছাগলগুলো ছাগলশালার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে এলো। আর তার সঙ্গে ছিল একটি ছাগলছানা। যা ম্যাঁ ম্যাঁ করছিল। হযরত রাসুলে অাকরাম সা. রাখালকে ডেকে বললেন, ওহে কী বাচ্চা দিলে? বলল, মেয়ে ছানা। নবীজি বললেন, এর জায়গায় আমাদের জন্য একটি ছাগল জবাই করে ফেল। তারপর আমাকে বললেন, তুমি মনে করো না আমরা তোমার জন্য ছাগল জবাই করেছি। আসলে আমাদের ১০০টি ছাগল রয়েছে। আমরা এর সংখ্যা আর বাড়াতে চাই না। তাই আমাদের রাখাল যখন একটি বাচ্চা দেয় আমরা তার জায়গায় একটি ছাগল জবাই করে ফেলি। (সুনানে আবু দাউদ : ১৪২)।
হাদিসটিতে আমরা পেলাম যে, রাসুল সা. পরিবারের জীবিকার জন্য ১০০টি ছাগল পালতেন। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন রাখালও নির্দিষ্ট করা ছিল। সেকালের জীবনমান হিসাব হয়ত এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। কাজেই আজকের দিনের জীবনমানের বিবেচনায় উপার্জন ও সঞ্চয় করা দোষণীয় কিছু হবে না। তবে একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা হলো, ইসলাম সম্পদের পাহাড় গড়তে অনুৎসাহিত করেছে। যা কামাই করব তা শুধুই সঞ্চয় করে রেখে দেব আর সম্পদের পাহাড় নির্মাণ করব_ এটা ইসলামের দৃষ্টিতে চরম অপছন্দনীয়। ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়ার সঞ্চয়ের চেয়ে আখেরাতের সঞ্চয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইসলাম অকৃপণ হাতে খরচ করতে উৎসাহিত করেছে। নবী-পরিবারের মহান মুখপাত্র উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা রা. এর জবানিতে পাওয়া যায়, নবী-জীবনের জীবনযাত্রার মান ও জীবিকার রূপ। হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসুল সা. দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন অথচ একই দিনে জয়তুনের তেল দিয়ে পেট ভরে দুইবার রুটি খেয়ে যাননি। (মুসলিম : ২৯৭৪)।
নবীজির ক্ষুধা ও অর্থদৈন্যের কথা ফুটে উঠেছে হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর বাণীতে। তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে দেখেছি। ক্ষুধায় বাঁকা হয়ে পুরো দিন পার করে দিচ্ছেন। উদরপূর্ণ করার মতো এক টুকরো খেজুরও তাঁর ঘরে ছিল না।
সম্পাদক, মাসিক আলহেরা