বিন আলি ইলদিরিম : তুরস্ক প্রজাতন্ত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত সন্ত্রাসী হামলার এক বছর অতিবাহিত হলো। তুরস্ক এই এক বছরে ধৈর্য, পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা ও শক্তির প্রমাণ দিয়েছে। আমরা যার মুখোমুখি হয়েছি, আমাদের উচিত তার মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করে সামনের দিকে তাকানো।
প্রথমত, আমাদের মনে রাখা উচিত, আমরা কিসের ভেতর দিয়ে গিয়েছি। সে রাতে যা ঘটেছিল তা ছিল তুর্কি সেনাবাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী বিশ্বাসঘাতকদের তুরস্ক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ। হামলাকারীরা এক বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তির অনুগত, যে নিজেকে ‘মহাবিশ্বের ইমাম’ বলে দাবি করে। আমরা সেদিন আক্রান্ত হয়েছিলাম নৃশংস হত্যাকারীদের দ্বারা, যারা নিজেদের জাতীয় সংসদে বোমা হামলা চালিয়েছে, ধ্বংস করেছে পুলিশের বিশেষ বাহিনীর সদর দপ্তর, ট্যাংক দিয়ে পিষ্ট করেছে নিরস্ত্র জনতাকে, গুলিবর্ষণ করেছে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে। ইতিহাসে এমন নৃশংসতার মুখে আমরা আগে কখনো পড়িনি। এই সন্ত্রাসী সংগঠন আমাদের ২৫০ জন নাগরিককে হত্যা করেছে এবং দুই হাজারের বেশি নাগরিককে আহত করেছে।
এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে দুটি গৌরবের বিষয় বের হয়ে এসেছে। প্রথমত, তুর্কি জাতির সাহসিকতা ও দৃঢ় সংকল্পতার প্রমাণ। আমাদের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। অভ্যুত্থানকারীদের হুমকি ও অভিযান সত্ত্বেও আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার কার্যক্রম চালিয়েছে। সমগ্র তুর্কি জাতি এক হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তুর্কি জাতি সারা বিশ্বকে দেখিয়েছে, তারা গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে এবং রক্ষা করে যাবে। আমাদের জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে যে শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের ইচ্ছায় আসা সরকার তুরস্ক পরিচালনা করবে, সশস্ত্র কোনো গোষ্ঠী নয়। গণতন্ত্রের এই কঠিন পরীক্ষায় দেশ হিসেবে আমরা আমাদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পেরেছি। কিন্তু ওই রাতে আমার শিশু নাতি-নাতনির সরলভাবে করা প্রশ্ন আমার বা অন্য কারও মন থেকে মুছে যাবে না। তা হলো ‘দাদু, ওরা আমাদের সৈনিক না?’ আসলে এ কেমন মানসিকতা, যা একজনকে নিজের জনগণ, নিজের প্রতিষ্ঠান, নিজের প্রতীক, নিজের নেতার বিরুদ্ধে আক্রমণে প্ররোচিত করে?
এ প্রশ্নের উত্তর বিশ্বাসঘাতক এক সংঘের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে। ওই রাতে আমরা সম্মুখীন হয়েছি এক সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের, যার সদস্যরা তাদের প্রধান নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে এক ধর্মতত্ত্ব অধ্যাপকের মাধ্যমে অন্ধের মতো অনুসরণ করে। আমরা কথা বলছি এক বিশ্বাসঘাতক চক্রের, যা গৌরবান্বিত ইতিহাসের অধিকারী তুর্কি সেনাদের সমর্থন করে না। এই চক্র স্যালুট প্রদর্শন করে গুলেনিস্ট টেরর অর্গানাইজেশনের (ফেতো) মালিক এবং এদের মালিকানায় পরিচালিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও স্কুলকে। এরা সেনানিবাসে অবস্থিত স্কুলকে এদের সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
আমাদের সরকার ফেতুল্লাহ গুলেনের মুখোশ উন্মোচন আগেই করতে পেরেছিল এবং যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। আমরা এই চক্রের অবস্থান নিশ্চিহ্ন করার জন্য সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু ১৫ জুলাই সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা আমাদের দেখিয়ে দেয় যে এই হুমকি আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক ব্যাপক। এদের অবস্থান আরও গভীর ও প্রাণঘাতী। ৪০ বছর ধরে করা তুরস্ক দখলের পরিকল্পনা প্রকাশ পেয়ে যায়। ফেতো সদস্যরা ফেতুল্লাহ গুলেনের কথা অনুসারে কারও কাছে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ না করে প্রশাসনের কৈশিক নালি পর্যন্ত ঢুকে পড়ে এবং আস্তে আস্তে শরীরের প্রধান অঙ্গের বিনষ্টকারী এক ভাইরাসের মতো সংক্রমণের মাধ্যমে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তদন্তে যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায়, এই সংঘই অভ্যুত্থানের মূল নীলনকশাকারী।
প্রমাণাদি আরও উপস্থাপন করে যে ফেতুল্লাহ গুলেন অপ্রচলিত বিশ্বাস ও গোঁড়ামি মতবাদের একটি গুপ্ত সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠনের স্কুল ও হোস্টেলগুলো ব্যবহার করা হতো মগজ ধোলাই ও জঙ্গি জোগাড়ের কাজে। এই সংগঠনের সদস্যরা তাঁদের নেতা, পরিকল্পনাকারী ও তথাকথিত মুক্তিদাতার দাবিদারের অনুগত থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুপ্রবেশ করেন। যেকোনো অপরাধমূলক ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে প্রস্তুত এই ফেতো অনুসারীরা পদোন্নতির মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে।
এই ফেতো অনুসারীরা সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অসাধু উপায়ের ব্যবহার, ব্ল্যাকমেল করা, মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক মামলাসহ আরও অনেক অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই সংগঠনটির যাবতীয় খরচ তথাকথিত দাতব্য সংস্থার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হতো। বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংকের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের অবৈধ অর্থ এরা এ পর্যন্ত পাচার করেছে।
এই সংগঠনের মিডিয়া সংস্থাগুলো তাদের প্রচারণার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পরিচয়ের জন্য সাংকেতিক নামের ব্যবহার, যোগাযোগের জন্য এনক্রিপশনসম্পন্ন অ্যাপ্লিকেশন বানানো, সদস্যদের গোয়েন্দাবিরোধী প্রশিক্ষণ এবং নিজেদের কর্মকাণ্ড লুকিয়ে শেখানো কি কোনো ‘শিক্ষা আন্দোলন’ হতে পারে?
এই নতুন সন্ত্রাসী সংগঠন তাদের বিরোধীদের ধ্বংস করার জন্য সব কৌশল ব্যবহার করেছে। তারা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ারও চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তুর্কি জাতি এই ভয়ংকর প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমরা যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছি। কিন্তু এই হুমকি শুধু তুরস্কের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে অনেক দেশে একই ধরনের সংগঠন এবং তারা এখন সেসব দেশে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ বুনছে। এই সময় তারা টিকে থাকার জন্য সক্রিয়ভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহারের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আমি পুনরায় আমার সব বন্ধুকে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। তুর্কিরা, কষ্টে অর্জিত গণতন্ত্রের জন্য জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার মতো এক জাতি হিসেবে নিজেদের সারা বিশ্বের সামনে পরিচিত করেছে। আমাদের প্রথম দায়িত্ব হলো এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
আমরা শাসনতন্ত্র বজায় রেখে এই কঠিন সময়ে চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্রকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অলংকৃতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক : প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী
সূত্র : প্রথম আলো