অওয়ার ইসলাম : আমার ভাইটা যখন কাঁদে, তখন ওকে আমি কোলে নিতে পারি না। ভাইটাকে কোনোদিন কোলে নিতে পারলাম না আমি। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব ব্যথা হয়।’ কথাগুলো বলতে বলতেই হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে থাকা মুক্তামনির দুই চোখ বেয়ে গড়াতে লাগল পানি। সেই কান্না আর থামেই না। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো, ‘আমার মা যখন রান্না করে, তখন মা ভাইকে কোলে নিতে পারে না। ভাইটা তখন কাঁদে, আর আমি শুয়ে শুয়ে খালি দেখি। ও আমার কাছে এসে আপি আপি করে, কিন্তু কোনোদিন ওকে একটু আদর করতে পারলাম না।’
১১ বছর বয়সী মুক্তামনির এই হাহাকারে বেডের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বাবা ইব্রাহীম হোসেন, মা আছমা খাতুন আর মুক্তামনির জমজ বোন হীরামনিও কান্না থামাতে পারলেন না। কান্নার শব্দে তখন ভারি বার্ন ইউনিট। নিত্যদিন পুড়ে যাওয়া রোগীদের দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা চিকিৎসক-নার্সরাও সামলাতে পারলেন না নিজেদের। তাদের চোখেও তখন অশ্রু। এক অদ্ভুত নিরবতার মধ্যে মুক্তামনি কান্নার সঙ্গে বলে চলে, ‘আমার খুব ব্যথা, আমি যেন ভালো হয়ে যাই, আমি স্কুলে যেতে চাই।’
পাশে থাকা বাবাকে কাঁদতে দেখে আরও জোরে কেঁদে মুক্তামনি বলে, ‘এত বছরে আমার বাবা কোনোদিন আমার গায়ে হাত তোলে নাই, আমাকে আমার বাবা আম্মাজান বলে ডাকে। আমাকে সবার চেয়ে বেশি আদর করে, আমি ভালো হতে চাই। আর ভালো হয়ে প্রথমেই ছোট ভাইটাকে কোলে নেবো।’
বুধবার (১২ জুলাই) সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি অজানা রোগে আক্রান্ত মুক্তামনির কেবিনে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে এমনটাই দেখা যায়। আজ সকাল থেকেই মুক্তামনির কেবিনে চিকিৎসক ও নার্সদের ভিড়। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) মুক্তামনির চিকিৎসায় গঠিত আট সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা এক এক করে কেবিনে এসে দেখে যাচ্ছেন মুক্তামনিকে। তারা নিজেদের মতামত দিচ্ছেন। অন্যদিকে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া হলো কয়েকবার। এতবার রক্ত কেন নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে কর্তব্যরত নার্স রাখি জানালেন, ‘কয়েকবার রক্ত নেওয়া হয়নি। ওর শরীরে রক্তশূন্যতার মাত্রা এত বেশি যে কোথাও সিরিঞ্জের নিডল পুশ করেই আমরা রক্ত পাচ্ছি না। তাই রক্ত নেওয়ার জন্য বারবার হাতের এখানে-ওখানে নিডল পুশ করতে হচ্ছে আমাদের।’
মঙ্গলবার থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি। কিন্তু বুধবার মুক্তামনির কেবিনে গিয়েই পাওয়া যায় দুর্গন্ধ। হঠাৎ করেই দুর্গন্ধ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে রাখি বলেন, ‘আজ (বুধবার) সকালে মুক্তামনির হাতের সামান্য ড্রেসিং করা হয়েছে। ওর ব্যান্ডেজ খোলার কারণেই এত দুর্গন্ধ বেরিয়েছে।’ পাশে থাকা হীরামনি তখন বলে ওঠে, ‘বাড়িতে সবসময় এমন গন্ধই বের হতো। তাই এলাকার মানুষ কেউ বেশি আসত না আমাদের কাছে।’
এরই ফাঁকে মুক্তামনির চিকিৎসায় গঠিত আট সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খানকে নিয়ে মুক্তামনির কেবিনে ঢোকেন বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. সামন্ত লাল সেন। কেস হিস্ট্রি নিয়ে তারা নিজেদের মতো করে আলোচনা করেন। এসময় ডা. সেন বলেন, ‘রোগটা কমপ্লিকেটেড, আবার নেগলেকটেড। হাতের এ অবস্থা কেন হয়েছে সেটা এখনও বলতে পারছি না। তবে মেয়েটি যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেত, তাহলে আজ তার এই অবস্থা হতো না। সে ভুল আর অপচিকিৎসার শিকার। মেয়েটির শরীরের সব রক্ত তার হাতের ঘায়ে চলে যাওয়াতে ওর শরীরে রক্ত নেই বললেই চলে। তবে এতকিছুর পরও আশাবাদী মেডিক্যাল বোর্ড।’ ডা. সেন বলেন, ‘আমরা ওর চিকিৎসার বিষয়ে আশাবাদী। ওর হাতের ফাংশন ঠিক আছে, হাত মুঠি করতে পারে। বাকিটা দেখা যাক।’
-এজেড