আতাউর রহমান খসরু
সংগীত মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সর্ব প্রাচীন সাহিত্যিক মাধ্যম। প্রাচীনকাল থেকে মনের ভাব প্রকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে সংগীতচর্চা হচ্ছে। সুর লহরীর সঙ্গে আবেগের যাদুচূর্ণ মিশিয়ে মানুষ সংগীতের ইন্দ্রজাল বুনে আসছে যুগ যুগ ধরে। সংগীতের বিচিত্র সুরে মুখর হয়েছে মানুষের দু:খ ও বেদনা, আনন্দ ও আবেগ, প্রেম ও পূজা, প্রার্থনা ও কীর্তন। অংকিত হয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজের আখ্যান।
ইতিহাসে সংগীতের যে সব প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই দেব-দেবীর প্রতি প্রার্থনা ও কীর্তন। অথবা রাজ-রাজরাদের স্তুতি। মানুষ ও মানবসমাজ, পরিবেশ ও প্রকৃতির তাতে স্থান পেয়েছে আশ্রিতের মতো। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদও বৌদ্ধ সহজিয়াদের প্রার্থনা ও সাধন সংগীত।
সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সংগীতে স্থান পেয়েছে অনেক পরে। এক্ষেত্রে আরব জাতি একটু ভিন্ন। তারা সংগীতচর্চার সূচনা থেকেই নিজ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী ছিলো। তাদের কবিতা জুড়ে যেমন ছিলো দেব-দেবীর স্তুতি, তেমন ছিলো স্বজাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরবদীপ্ত বিবরণ। খ্রিস্টাব্দ পনের শতকের পর বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী চেতনার ব্যাপক উম্মেষ হয়। যা শিল্প-সাহিত্যকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তখন শুরু হয় দেশত্ববোধক সংগীত চর্চার ধারা।
বাংলা সাহিত্যে মানুষেরই স্থান হয় পনের শতকের পর। সুতরাং বাংলা সাহিত্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটতে আরো সময় লাগে। দেশ ও স্বজাতি নিয়ে সংগীতচর্চা শুরু হতেই কেটে যায় বহুকাল। বাংলা সাহিত্যে ইসলামী সংগীতের আগমন হয় আঠারো শতকের দ্বিতীয়ভাগে। আর বাংলা সাহিত্যে ইসলামী সংগীত স্থায়ী আসন লাভ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরে। তিনি ছিলেন ইসলামী সংগীতে বিপ্লবের বাশিওয়ালা। ইসলামী সংগীতকে বহুমাত্রিক রূপ দান করেন তিনি।
ভক্তি ও শ্রদ্ধা, প্রার্থনা ও স্তুতির প্রচলিত ধারার বাইরে এসে তিনি ইসলামী সংগীতকে করে তোলেন দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও স্বাধিকার, মুক্তি ও প্রতিবাদের মুখপাত্র হিসেবে। পরবর্তীতে বহু শিল্পী ও গীতিকার তাকে অনুসরণ করে পথ চলেছেন। হয়ে উঠেছে যুগ ও সময়ের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। মরহুম আইনুদ্দীন আল আজাদ ছিলেন তাদের অন্যতম। দেশ, জাতি ও স্বাধীনতা বিষয়ে তিনি রচনা করেছেন বহু অমর সংগীত। অসংখ্য জাগরণের গান।
আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ. এর হৃদয়জুড়ে ছিলো বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মুসলিম জনগণ। তার শ্লোগান ছিলো মানুষ ও মানবতার মুক্তি। জীবনের শপথ ছিলো এদেশের আপামর মানুষকে চিন্তা ও চেতনা, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মুক্ত করা। তাদেরকে অপসাংস্কৃতির অন্ধকার থেকে ইসলামী সাংস্কৃতির আলোর পথে নিয়ে আসা।
দেশের অশিক্ষিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য তিনি ছুটে যেতেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। তার সংগীতের বিশাল জগত জুড়ে আছে দেশ ও জাতি, সমাজ ও সভ্যতা। দেশ নিয়ে তিনি অনেক সংগীত রচনা করেছেন; কিন্তু তার মূলভাষ্য ছিলো আপামর জনতার মুক্তি এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। আপামর জনতার আর্তনাদ তাকে ছুয়ে যেতো গভীরভাবে। ব্যাকুল করতো। পীড়িত করতো তার দরদি মনকে। অধীর হয়ে অপেক্ষা করতেন তাদের মুক্তির। তিনি গেয়েছেন,
কতো দিন কতো রাত চলে যায়,
তবুও ফুরায় না রাত আমার; ফুরায় না রাত আমার।’
তবে বেদনাবিদূর মন নিয়ে তিনি বসে থাকেন নি। তিনি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন বিপ্লবের প্রাণশক্তি দেশের যুব সমাজকে। আঘাত হেনেছেন তাদের বিবেকের দুয়ারে। জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন মুসলমানের আত্মমর্যাদাবোধ। তিনি গান,
যদি পরগাছার মতো বাঁচতে হয়,
যদি মায়ের ধর্ষিত মুখ দেখতে হয়,
তবে এমন বেঁচে আর লাভটা কী?
তুমি সে কথা ভেবোছো কী?
তাদের ভেতর গভীর জীবনবোধ জাগিয়ে তুলে বিবেকের আদালতে প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
কী হবে বেঁচে থেকে
অযথা বিদ্যা শিখে
যদি না গড়তে পাড়ি শোষণ বিহীন সমাজটাকে।
মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশের একটি বিশেষ পদ্ধতি ছিলো প্রতিবাদ। ‘জনতার আর্তনাদ’ এলব্যামে শাসক গোষ্ঠির জুলুম ও নির্যাতনের ধ্বনিচিত্র এঁকে কারাবরণ করতে হয় তাকে। তবু থেমে যান নি। সব সময় স্বরব ও প্রতিবাদমুখর ছিলেন মানুষের প্রতি চলা নানা অবিচারের বিরুদ্ধে। সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি ভাষা পেয়েছে তার গানের কথায়। যেমন, দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রধান একটি সমস্যা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি গেয়েছেন,
দুর্নীতির ঐ আখড়ায় বসে জাহির করে জ্ঞান,
কলম দিয়ে কামায় কাটা আবার ধরে সাধুর ভান,
ওরা শিক্ষিত শয়তান।
তার এই সংগীতে ফুটে উঠেছে, দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজ ও রাষ্ট্রের চিত্র।
সন্ত্রাস বাংলাদেশের আরেকটি মৌলিক সমস্যা। সন্ত্রাসের হাতে জিম্মি হয়ে আছে দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ। সন্ত্রাসের প্রতিবাদে তিনি গেয়েছেন,
সন্ত্রাস কাকে বলে জানো কী?
ওরাই দেশের সব মানো কী?
এ গানে তিনি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসের প্রকৃতি তুলে ধরেছেন গানের সুরে সুরে। তবে তিনি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব দেখে ভয় পেতে নিষেধ করেছেন।
মানুষ ও মানবতার মুক্তির জন্য নিবেদিত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আশা ও সাহস সঞ্চার করতে গেয়েছেন,
রক্তরাঙা আকাশ দেখে ভয় দেখো না,
ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে আলোর কণা।
অন্য একটি সংগীতে তিনি বলেন,
একদিন নিশ্চয় আসবে সেদিন,
শান্তির সুবাতাস বইবে যেদিন।
দীনের পথে আমরা চলবো যেদিন।
তবে আশার সূর্যোাদয় যে মানবরচিত কোনো পথ ও পদ্ধতির মাধ্যমে হবে না। এজন্য দীনের পথে তাও স্পষ্ট করে বলেছেন। অন্য একটি গানে তিনি জীবনের প্রকৃত সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে আল কুরআনের পথে চলার আহবান করেন,
সমাধান চাও যদি জীবনে মরণে,
খুজে যাও, বুঝে নাও, চোখ রাখো কুরআনে।
কুরআনের বাণী প্রচার করতে গিয়ে এবং সত্যের পতাকা উঁচু করার জন্য সংগ্রামী এই শিল্পী প্রয়োজনে জীবন দিতেও রাজি ছিলেন। পুঁথি কাব্যের সুরে সুরে বলেন,
তাই ধরলাম কলম
আমার জনম যদিও যায় দু:খে
সারা জীবন বলবো কথা দেশবাসীরও সুখে।
জীবনের প্রতি ধেয়ে আসা সব দু:খ বরণে তার কোনো দ্বিধা ছিলো না। কারণ, তিনি মনে করতেন মানুষ মানুষের জন্য। মানব জীবন স্বার্থক করতে হলে তাকে অবশ্যই মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, সর্বোত্তম মানুষ সে মানুষ যার দ্বারা উপকৃত হয়। রাসূলের এই বাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে তার গানে,
মানুষ মানুষের জন্য
তবেই তো জীবন ধন্য।
মরহুম আইনুদ্দীন আল আজাদের দেশের গানের অন্যতম প্রধান উপজীব্য হলো, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এ দেশের স্বাধীনতা যেমন তার কাছে ছিলো মূল্যবান তেমন মূল্যবান ছিলো তার সার্বভৌমত্ব। তিনি যখন দেখতেন বিদেশীদের হাতে দেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব হচ্ছে। দেখতেন বিদেশী দালালের আকুলি-ব্যাকুলি তখন তিনি দু:খ নিয়ে গাইতেন,
রক্তে কেনা বাংলা আমার লাখো শহীদের দান
তবুও কেনো বন্ধু তোমার বিদেশের প্রতি টান।
একইভাবে যখন স্বাধীনতার নামে সর্বত্র স্বেচ্ছাচারিতা ও ধর্মদ্রোহিতা ছড়াছড়ি দেখতেন। যেখানে নেই মানুষের অধিকার। নেই শান্তির কোনো উপকরণ। যেখানে শোষিত হয় মানুষ। মানুষের রক্ত খায় মানবপশু তখন চিৎকার করে বলতেন,
স্বাধীনতা চাই নি আমি এই স্বাধীনতা,
স্বাধীনতা পাই নি আমি সেই স্বাধীনতা,
যাহা চেয়েছি আমি পাই নি,
যাহা পেয়েছি আমি তাহা চাই নি।
কোনো মুসলিম শুধু জাগতিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে সামনে এগুতে পারে না। সে অবশ্যই আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী। সে বার বার ফিরে যায় মহান আল্লাহর দরবারে। শিল্পী আইনুদ্দীন আল আজাদও প্রিয় দেশকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হয়েছেন বার বার। গেয়েছেন,
দাও খোদা দাও এমন একটি দেশ আমাকে দাও।
যে দেশটাকে তোমার কাছে আপন করে নাও।
আর হে আল্লাহ! আমাদের যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে তুমি আমাদের পূর্বসূরীদের উসিলায় হলেও আমাদের রক্ষা করো।
এই পীর আউলিয়ার বাংলাদেশ
এই শহীদ গাজীর বাংলাদেশ
রহম করো আল্লাহ, রহম করো আল্লাহ।
আর দেশ, জাতি ও ধর্মের জন্য এতো ভালোবাসা যে মানুষটি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন; হে আল্লাহ! আপনিও তাকে কবুল করে নিন। আমিন।
লেখক : সহকারী সম্পদক, মাসিক নকীব
এসএস/