জহির উদ্দিন বাবর : নিকট অতীতে বাংলাদেশে প্রভাবশালী আলেমদের তালিকায় তাঁরা দুজনই শীর্ষে ছিলেন। কৃতিত্বপূর্ণ অবস্থানের দিক থেকে দুজনই ছিলেন ঝলমলে একটি জায়গায়। দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমাদৃত ছিলেন দুজনই। দুজনেরই ছিল নিজ নিজ রাজনৈতিক গণ্ডি ও বলয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তারা হয়ে উঠেছিলেন দেশের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অভিভাবক।
ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানের রূপ পেয়েছিলেন দুজনই। জাতির যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে আলেমরা তাকিয়ে থাকতেন তাঁদের দিকে। তাঁদের ব্যক্তিত্বের উচ্চতা ও ব্যাপ্তি এই পর্যায়ে ছিল যে, কেউ আর তাদেরকে কোনো দলীয় বা বলয়ের আয়তনে মাপতেন না।
সবার শিরোমনিতুল্য এই দুই মনীষী নানা আন্দোলন-সংগ্রামে একসঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘকাল। কাকতালীয়ভাবে দুজনই একই তারিখে চলে গেছেন দুনিয়া থেকে। একজন ২০১২ সালে আরেকজন ২০১৬ সালে। ১৯ রমজান দুজনেরই ওফাত দিবস। বলছিলাম শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ও আল্লামা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর কথা।
তাঁরা দুজনই আমাদের আলোর মিনার, চেতনার বাতিঘর। এই দুই মনীষীর কাছে কোনো না কোনোভাবে ঋণী আমরা সবাই। তাদের রেখে যাওয়া সম্পদ আমরা ভোগ করছি। তাদের মাড়ানো পথে আমরা নির্বিঘ্নে গমন করছি। আমরা চাইলেও তাদের সেই ঋণ কোনোদিন পূরণ করতে পারবো না। তবে ঋণ পূরণের চেষ্টা সবার মধ্যে থাকা উচিত। আল্লাহ যেন এই দুই মনীষীকে তাদের বিশাল কর্মের উপযুক্ত বদলা দেন সে দোয়া অব্যাহত রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব।
এক.
গত চার দশক ধরে বাংলাদেশে আলেম সমাজের সম্মিলিত এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যেখানে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর প্রত্যক্ষ বা পারোক্ষ ভূমিকা ছিল না। ছদর সাহেব ও হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর পরবর্তী সময়ে তিনিই ছিলেন আলেম সমাজের অবিসংবাদিত নেতা।
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে শায়খুল হাদিস রহ.-এর সরব উপস্থিতি ছিল না। জাতীয় ও ধর্মীয় ইস্যুতে সারা দেশের আলেম-ওলামা চাতকের মতো তাকিয়ে থাকতো শায়খুল হাদিসের নির্দেশনার প্রতি। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ লংমার্চ থেকে শুরু করে ফতোয়াবিরোধী রায়ের প্রতিবাদে সর্বাত্মক জাগরণে শীর্ষ ভূমিকা পালন করেছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই মহান নেতা।
দীর্ঘ ৯৪ বছরের জীবনে তিনি হাদিসের মসনদ থেকে শুরু করে রাজনীতির মঞ্চ পর্যন্ত সবখানে দেশ ও জাতিকে দিয়েছেন অগণন। কর্মের ব্যাপ্তি ও অবদানের বিশালতায় শায়খুল হাদিস ছিলেন এদেশের আলেমদের মধ্যে অনন্য-অসাধারণ। বহুমুখী পরিচয়ের যোগসূত্রতা সম্পৃক্ত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। এর ফলে তিনি ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। ‘শায়খুল হাদিস’ বললে একক কোনো ব্যক্তি নয়, মনে হতো এটি একটি সফল প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উপকার ভোগ করেনি এমন মানুষ আলেম সমাজে খোঁজে পাওয়া মুশকিল।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ হয়ত শায়খুল হাদিসকে ততটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও উঁচু হিম্মতের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত ছিল না।
আজকে যারা এদেশের ইসলামী রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে শায়খুল হাদিসের শাগরেদ বা ভাবশিষ্য। সুতরাং আগামী কয়েক দশকও এদেশের ধর্মীয় অঙ্গনে শায়খুল হাদিস রহ.-এর সুস্পষ্ট ছাপ অনুভব করা যাবে।
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তাঁর মতো আলেমব্যক্তিত্ব প্রতি শতাব্দীতে দু’একজন জন্ম নেন কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিশেষ করে আমাদের অনুর্বর এই ভূখণ্ড যেখানে হীরকতুল্য ব্যক্তিত্বের সম্মান ও অবস্থান বোঝার মতো লোকের যথেষ্ট অভাব। আমরা যদি শায়খুল হাদিস রহ.কে বিগত এক শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলি তবে আমার মনে হয় একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না।
দুই
বাংলাদেশের হাতেগোনা যেসব আলেম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত তাদের একজন ছিলেন আল্লামা মুহিউদ্দীন খান রহ.। লিখনি ও চিন্তার জগতে সদর্প পদচারণা তাঁকে পরিচিত করেছিল বিশ্ববাসীর কাছে। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল সর্বপ্লাবী। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে আলেম-ওলামার এমন কোনো সামষ্টিক কর্মকাণ্ড বা জাগরণ নেই যেখানে উৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন না আল্লামা খান রহ.। দেশ ও জাতির যেকোনো সংকটমুহূর্তে যে কয়েকজন আলেমের দিকে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হতো তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। যুগসচেতন, প্রত্যুৎপন্নমতি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আল্লামা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন এদেশের আলেম-ওলামা ও দ্বীনদার মুসলমানদের অন্যতম কাণ্ডারী।
এ কজীবনে বিভিন্ন অবদানে সমৃদ্ধ করেছেন নানা অঙ্গন। তবে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান একডাকে পরিচিত ছিলেন মাসিক মদীনা সম্পাদক হিসেবে। সেই ষাটের দশকের শুরুতে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে তিলে তিলে গড়ে তুলেন দ্বীনি এই সাময়িকীটিকে।
মাসিক মদীনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন দ্বীনি বইপুস্তক অনবরত বের করতে থাকেন। এদেশের আলেম-ওলামার মধ্যে একটি যুগের প্রবর্তন করেন তিনি। তাফসির-হাদিসসহ শতাধিক গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি পঠিক তাফসিরগ্রন্থ তাঁর অনূদিত মারেফুল কোরআন। রাসূলের জীবনচরিত তথা সিরাত বিষয়ে বেশি গ্রন্থ তিনিই লিখেছেন এবং প্রকাশ করেছেন। সিরাত পাঠকে তিনিই এদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।
ইসলামিক অঙ্গন থেকে আজ অর্ধশতাধিক নিয়মিত-অনিয়মিত সাময়িকী ও ম্যাগাজিন বের হচ্ছে। টাকা থাকলে যে কেউ আজ সম্পাদক হয়ে পত্রিকা বের করতে পারছেন। কিন্তু মাওলানা খান যখন মাসিক মদীনার জন্ম দেন তখন বিষয়টি এতোটা সহজ ছিল না। তাঁকে অনেক বেশি সংগ্রাম ও সাধনা করতে হয়েছে মাসিক মদীনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে। তিনি পথ দেখিয়ে গেছেন, সেই পথে এখন চলছে সবাই। সারা দেশ থেকে আজ ইসলামী ধারার যত পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী ও বই-পুস্তক বের হচ্ছে এর পেছনে আল্লামা মুহিউদ্দীন খানের পরোক্ষ ভূমিকা আছে। আজকে ইসলামি অঙ্গনে যারাই একটু-আধটু লিখছেন সবাই কোনো না কোনোভাবে আল্লামা খানের দ্বারা প্রেরণা পেয়েছেন।
আল্লামা খান শুধু যে নিজেই লিখেছেন এবং পাঠযোগ্য ইসলামী উপকরণ যোগান দিয়েছেন তাই নয়, তিনি নিজ হাতে গড়েছেন অসংখ্য মানুষ। আজকে ইসলামিম ধারায় যাদের কলম সরব রয়েছে তাদের অনেককেই আল্লামা খান পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, হাতে-কলমে শিখিয়েছেন।
জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি নিজে কাজ করার চেয়ে করানোর প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁর আবাদ করা অঙ্গনটি পুরোপুরি আবাদ হোক, এ অঙ্গনের বিচরণটা আরও মসৃণ হোক এটাই তিনি চেয়েছেন জীবনভর। শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ার পরও শেষ বয়সে তিনি কলম হাতছাড়া করেননি। কলমের বলিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে তিনি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
-এআরকে