বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
রোজা কত বরকত ও রহমতের, একজন মুসলমানের কাছে কত সৌভাগ্যের তা কজনই বা জানে। আরেকটা রমজান পাবে কিনা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। অথচ এবার মাহে রমজানের প্রথম জুমায় পুলিশের খুতবা শুনে ভীষণ মর্মাহত হয়েছি।
ঢাকায় থাকলে মোহাম্মদপুর কলেজ গেট মসজিদে নিয়মিত জুমার নামাজ আদায় করি। সেই স্বাধীনতার পর শুরু করেছি, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ১৬ বছর নির্বাসনে থাকায় যেতে পারিনি। আবার প্রায় ২৬-২৭ বছর হতে চলল একই মসজিদে নামাজ পড়ি। যিনি ইমামতি করেন বেশ জানাশোনা। স্বাধীনতার আগে থেকেই ছাত্র হিসেবে এখানেই ছিলেন। সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের, চিনু খাঁ এবং আমি মোহাম্মদপুর হানাদারদের ভাঙা মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল সব ধীরে ধীরে চলার উপযোগী করেছিলাম। তাই কলেজ গেট মসজিদের জন্য বেশ মায়া লাগে।
রমজানের প্রথম জুমায় আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার আশায় রোজা সম্পর্কে চমৎকার খুতবা শুনব তেমন আকুলতা নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি সাধারণত বারান্দায় নামাজ পড়ি। কবরে কোথায় এসি পাব, তাই ঘরে যাই না। সেদিনও বারান্দায়ই ছিলাম। অসংখ্য নামাজি তাদের বারান্দার সাথী হিসেবেই জানে। খুতবা শুনছিলাম ভালোই লাগছিল। হঠাৎ শুনি অন্য গলা। ভাবলাম রোজার প্রথম জুমা তাই কোনো বড়সড় আলেম এসেছেন। কয়েক মিনিট কিছুই বুঝলাম না। তারপর যখন শুনলাম মিরপুরে জঙ্গি দমন, দারুসসালামে হাইজ্যাকার ধরা, আরও কী কী, তখন বুঝলাম পুলিশের কেউ খুতবা দিচ্ছে। ক্ষোভে দেহমন নাড়া দিয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল তখনই বুরবক নির্বোধকে বের করে দিই। কিন্তু অনেক দূরে ছিলাম তাই পারিনি। পরে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রোজার পয়লা জুমায় পুলিশ দিয়ে খুতবা না দিলে হতো না? তিনি তাড়াহুড়া করে বললেন, ‘নামাজের সময় হয়ে গেছে। এ বিষয়ে পরে বলব। ’ পরে আর কী বলবেন। আগে ইমামতি করতেন সমাজের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব যাদের তারা, এখন ইমামতি করেন বেতনভোগী কর্মচারীরা। তাই আগের ইমাম আর এখনকার ইমামের পার্থক্য লাখো-যোজন।
ইমামের কিছুই করার নেই। মসজিদ পরিচালনা পরিষদ হয়তো কিছু বলতে পারে। পুলিশের কাজ রাস্তাঘাটে, মসজিদে কেন? হ্যাঁ, মসজিদেও যদি কিছু করতে বা বলতে হয় সুন্দরভাবে অজু করে সময়মতো বলা দরকার। একজন মুসলমান রোজার জন্য, তারাবির জন্য, জুমার জন্য কত আকুল হয়ে থাকে। রোজার প্রথম জুমায় আল্লাহর দিদারের আশা না করে কোনো সরকারের দিদারের চেষ্টা কতখানি যুক্তিযুক্ত? জানি না, সারা দেশে সরকারি নির্দেশে অমনটা হয়েছে, না মোহাম্মদপুর পুলিশের অতিতত্পরতার ফল। তবে কাজটি প্রশংসিত হয়নি, বরং কাজটি খুুবই নিন্দনীয় হয়েছে। যা সরকার বা পুলিশ বাহিনীর করা উচিত নয়। আল্লাহর ঘর মসজিদ পুলিশের দখলে চলে গেলে আর থাকে কী? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখতে বলছি।
১০ জুন আমার জন্য, কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালের ১০ জুন সখীপুরের বহেরাতলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম শপথ করিয়েছিলাম। সব সময় আমার ভয় ছিল, আমি পারব তো! আমার মতো একজন নগণ্যের পথ ধরে মানুষ চলবে তো! কত নেতা-উপনেতা-পাতিনেতা কত বড় প্রতিশ্রুতি দিল, কত বক্তৃতা করল, কিন্তু যুদ্ধ শুরুর আগেই তারা আমাদের ফেলে পগারপার হয়ে গেল। হতাশা কাটতে বেশ সময় লেগেছিল। তারপর আল্লাহর নাম স্মরণ করে জয় বাংলার ধ্বনি তুলে আলী আলী বলে রাস্তায় নেমেছিলাম। সত্যিই বিশ্বস্ত ত্যাগী লোক পেতে খুব একটা সময় লাগেনি, কষ্ট হয়নি। অভিজ্ঞতা ছিল না, নিজের ওপর নিজেরই তেমন ভরসা ছিল না— এ রকম অবস্থায় ৩ এপ্রিল সাটিয়াচরা নাটিয়াপাড়া প্রতিরোধযুদ্ধে হেরে গিয়ে চর-বন-পাহাড় সীমান্ত কোথায় যাইনি। আবার গুটিকয় ইপিআর নিয়ে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী এসেছিলেন। কালিহাতী একটা যুদ্ধ হয়েছিল। তবে সে যুদ্ধ তেমন জুতসই হয়নি। বরং হতাশাই বেড়েছিল বেশি। কাজের কাজ তেমন হয়নি। অনেক হানাদার মারা গিয়েছিল, আমাদেরও বেশ ক্ষতি হয়েছিল। দিশাহারা হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সবার সঙ্গে পালিয়েছিলাম।
কোথাও কোনো আলো ছিল না। যেদিকে তাকিয়েছি নিকষ অন্ধকার। হতাশা আর হতাশা। প্রাণ বাঁচাতে ছুটে চলা মানুষ দেখে পাগলপ্রায় অবস্থা। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ঠিক এখনকার মতো একেবারে দিশাহারা। ওর মধ্যেই সিলেটের ছোট্ট ফারুককে নিয়ে রাত-দিন ছুটেছি। মানুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছি। সব জায়গায় উৎসাহ পেয়ে সাহসী হয়েছি। চরম ভয়াবহ হতাশার মধ্যে সহপাঠী কামার্তির সাইদুরকে চিঠি দিয়েছিলাম, কয়েকজন সবল স্বাস্থ্যের কর্মী নিয়ে মরিচাতে একত্র হতে। অন্যদিকে কস্তূরীপাড়ার মনিরুল ইসলাম এসেছিল গুপ্তধনের সন্ধান নিয়ে। সেটা ছিল ৪ মে। অনেক কষ্টে গলাসম পানি ঠেলে গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছিলাম। সেখানে ছিল একটা এলএমজি, ১৬-১৭টা গ্রেনেড, ৪টা রাইফেল, কয়েক হাজার গুলি। মরিচা যাওয়ার পথে কস্তূরীপাড়ায় পেয়েছিলাম এক অসম সাহসী যোদ্ধা ছোট্ট শামসুকে। মুক্তিযুদ্ধে কতজন কতভাবে আমার থেকে ছিটকে পড়েছে, কারও অসুখ হয়েছে। কিন্তু শামসুকে কেউ আমার গা-ছাড়া করতে পারেনি। সে যেন আল্লাহ-প্রদত্ত ছায়া।
৫ মে মরিচাতে শুরু হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা গঠন প্রক্রিয়া। এরপর সংগ্রামপুর অবাঙালিদের পাতার ক্যাম্প অভিযান। খবর ছিল এলএমজি, রাইফেল, পিস্তল আরও কত কী আছে। কিন্তু কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। খবর পর্যন্তই সার। সেখান থেকে উল্কার মতো ধেয়ে গিয়েছিলাম সখীপুর। রাত কাটিয়েছিলাম সখীপুর প্রাইমারি স্কুলে। তারপর আমরা সময়ের চে৬য়ে দ্রুত ছুটেছি। আঙ্গারগারা পরশুরাম মেম্বারের বাড়িতে পিলখানা থেকে পালিয়ে আসা ইপিআরদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এনে কাদেরনগরে সালাম ফকিরের হেফাজতে রেখে পরদিন শুরু করেছিলাম আনুষ্ঠানিক মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ। কত আর হবে, ১০-১২-১৫ দিনে হাজার তিনেকের মতো যোদ্ধা সংগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু তারা যুদ্ধ জানে না, অস্ত্র চালাতে পারে না। দিনকে রাত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের অস্ত্র ধরতে শিখিয়েছিলাম।
অস্ত্র ধরতে শেখা বা চালাতে শেখা আর যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর দিক থেকে অবিশ্রান্ত গুলি আসার সময় শত্রুর বুকে গুলি ছোড়া এক কথা নয়। তবু নির্বোধের মতো সাহস করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। বুকে ভয় ছিল, যোদ্ধাদের সুপথে রাখতে পারব তো! কোনো অসুবিধা হবে না। বুকের দুরদুর দূর করতে পারছিলাম না। সব সময় একটা দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছিল। কোনোভাবেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। মনে করেছিলাম আমাকে অস্বীকার বা না মানলেও একবার ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ করলে সবাই তা অবশ্যই রক্ষা করবে। ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারব না, কেন কীভাবে মনে হয়েছিল একটা আঁটসাঁট শক্ত বাঁধনে বাঁধা উচিত। তাই ১০ জুন, ১৯৭১ বহেরাতলীতে শপথের আয়োজন করেছিলাম।
সময় কেমন নিয়ামক শক্তি। ’৭১-এর ১০ জুন বহেরাতলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ ছিল শ্রেষ্ঠ ঘটনা। এবার সেই বহেরাতলীতে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম। ভাবছিলাম, অল্প পথ একবার ঘুরে আসি। কিন্তু তা হলো না। ১০ জুন ছিল ঢাকায় লি-মেরিডিয়ানে সৌদি অ্যাম্বাসির ইফতার মাহফিল। খুব যত্ন করে তারা ইফতারের দাওয়াত করেছিলেন। বেশ কয়েকবার তাদের জাতীয় এবং ইফতার মাহফিলে গেছি। কার্ড পাঠিয়েছিলেন একটা। ইদানীং দলের লোকেরা দলগত কিছু হলে দাওয়াত না পেলে, যেতে না পারলে অনুযোগ করে, মন খারাপ করে। এটাই স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বাসির পাবলিক রিলেশন অফিসার জনাব আহমাদুল হককে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘শুক্রবার অফিস বন্ধ। না হলে এখনই কার্ড পাঠিয়ে দিতাম। আপনারা যে কজন খুশি আসবেন। আমরা গেটে থাকব। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। ’ আসলে কোনো অসুবিধা হয়ওনি। একেবারে বিমানবন্দরের কাছে চমৎকার হোটেল লি-মেরিডিয়ান। সময়ের ৫-১০ মিনিট আগেই গিয়েছিলাম। বসেছিলাম প্রবীণ সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিনের পাশে। তার পাশে ছিলেন গাড়ি ব্যবসায়ী আবদুল হক ও কাজী শামসুল হক।
আবদুল হক এক অসাধারণ ব্যক্তি। তার সঙ্গে সড়ক ও সাধারণ পরিবহন নিয়ে আলোচনা করে দারুণ মুগ্ধ হয়েছি। যেমন একবার মুগ্ধ হয়েছিলাম ১/১১-র সময় আইন সচিবের ঘরে বেকার বসে থাকতে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে ইন্টারনেট নিয়ে আলোচনা করে। কীভাবে এক-দেড় কোটি মানুষের দেশে বসে বিদেশে কর্মসংস্থান করা যায়। স্বাধীনতার পর কামালের সঙ্গে সালমান এফ রহমান কত আসত। তখন যদি সেই জ্ঞান দিত বঙ্গবন্ধুকে, তবে হয়তো কিছু করতে পারতাম। কিন্তু এখন আর জ্ঞানে কী হবে? এখন তো জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানের কদর বেশি। পাশের টেবিলে বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার পাশে স্পিকার, সৌদি রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গহর রিজভী ও বিএনপির মঈন খান। আমাদের ঘরে উপচেপড়া ভিড় ছিল না, যেহেতু পাশে আরেক ঘরে ব্যবস্থা ছিল। একেবারে শেষ পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ আবদুল্লাহ এসেছিলেন। তার শরীর অত খারাপ ভাবতেই পারিনি।
সেই ’৯০ সালে প্রথম যখন টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলাম আমাদের জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন। ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের এক রাত থাকা-খাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নেতা-কর্মীরা সেদিন সেই অসাধ্য সাধন করেছিল। পরে শেখ আবদুল্লাহ তার বাড়িতে বেশ কয়েকবার খাইয়েছেন। তার স্ত্রী একজন অসাধারণ মহিলা। খুবই ভালো রান্না করেন। তাই অনেক দিন পর তাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি, খুবই ভালো লেগেছে।
ইদানীং কোথাও ইফতারের আয়োজন হলেই খাবারের ব্যবস্থা হয়। বিষয়টা মোটেই ভালো না। রোজা রেখে ইফতার করে সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া যায় না। সৌদি অ্যাম্বাসির খাবারও তেমনি অনেকে খেতে পারেনি। কিন্তু ব্যবস্থা ছিল অসাধারণ চমৎকার। রাষ্ট্রদূত জনাব আবদুল্লাহ এইচ এম আল-মুতাইরি সবার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা বাঙালিরা যতটা অতিথিপরায়ণ তার চেয়ে আরবীয়রা কোনো অংশে কম নন। আমি তাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা একখণ্ড ‘স্বাধীনতা ’৭১’ উপহার দিয়েছি। তাই ১০ জুন কাদেরিয়া বাহিনীর শপথ দিবসে বহেরাতলীতে না গিয়ে সৌদি অ্যাম্বাসির ইফতার মাহফিলে গিয়েছিলাম। সময় সত্যিই এক অমোঘ শক্তি। কোন সময়ের গুরুত্ব কতটা আগে থেকে ঠিক করা যায় না।
৫ জুন ছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ইফতার মাহফিল। আসলে ওই কদিন বাইরের কোথাও ইফতারিতে যাইনি। আমার তেমন ভালোও লাগে না। রোজা রাখি, ইফতার করি আল্লাহর দয়া পাওয়ার আশায়। রোজা-নামাজ-ইফতার সবই কেমন যেন অনেকটাই লোক দেখানো ব্যাপার হয়ে গেছে। বছর কয়েক আগে কার এক ইফতারি থেকে ফিরে জন্ডিস হয়েছিল। আমার জীবনটা সেখানেই শেষ হয়ে গেছে। জন্ডিস কত বড় মারাত্মক রোগ আমরা কেউ জানি না।
জন্ডিস সম্পর্কে আমাদের কারও কোনো ধারণা নেই। ডায়াবেটিস এক মারাত্মক রোগ, ক্যান্সারের চাইতে ভয়াবহ। কিন্তু চিরসাথী ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিস কোনো অসুখই নয়। বরং নিয়ম মানার কারণে সে হয় এক আশীর্বাদ। রবীন্দ্রসংগীতের প্রবাদপুরুষ নেত্রকোনার জর্জ বিশ্বাস। সবাই যাকে জর্জ দা বলে ডাকতেন। নির্বাসিত জীবনে তার সঙ্গে অনেক দেখা হয়েছে। তিনি হাঁপানিতে আক্রান্ত ছিলেন। অনেক সময় শ্বাস নিতে পারতেন না। তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘বাঘা দা, আমার হাঁপানি না হলে হয়তো আমি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হতে পারতাম না। পান থেকে চুন খসলে শ্বাসকষ্ট, একটু বাতাস লাগলে বিগড়ে যায়, হাতে-পায়ে পানি লাগলে দম আটকে আসে। সব সময় যত্নে, সতর্ক থাকতে হয়। এখন দেখছি, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টই আমাকে দীর্ঘ জীবন দিয়েছে, সাবধানে থাকতে শিখিয়েছে। ’
বেশ কয়েক বছর নানা কারণে তেমন কোনো ইফতারিতে যাই না। তাই বিএনপির রাজনৈতিক ইফতারেও যাইনি। দলীয় নেতারা বেশ কয়েকজন গিয়েছিল। বিএনপির নেতৃবৃন্দ, এমনকি বেগম খালেদা জিয়া যথেষ্ট যত্ন করেছেন। শুনে খুবই খুশি হয়েছি। আমি যাইনি, কোনো রাজনৈতিক দলের ইফতারিতে যাব না। এমনকি আমার নিজ দলের ইফতারিতেও না। কালিহাতী-সখীপুর-বাসাইল তিনটি উপজেলা পর্যায়ে ইফতারিতে যাব। অন্যদিকে নাটোরে শহীদ মুন্সীর ইফতারিতে যাওয়ার কথা।
আল্লাহ যদি সুযোগ দেন নিশ্চয়ই যাব। তাই বিএনপির ইফতারিতে না যাওয়া কোনো বড় কথা নয়। তবে সেখানে আরও অসুবিধা হয়। ইফতারির মূল টেবিলে বেগম খালেদা জিয়ার দুই পাশে রাজনৈতিক নেতারা বসেন। আমি গেলে আমারও জায়গা হওয়ার কথা সেখানে। কিন্তু আমি সেখানে বসি না। কারণ জামায়াতের আমির অথবা তাদের প্রতিনিধি সেই সারিতে থাকেন। দুবার মূল টেবিলে না বসে নিচে বসেছি। সংসদেও জামায়াত সদস্যদের নিয়ে বলেছিলাম, বাংলাদেশের এই সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের সদস্যরা আছেন। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের এখানে পাঠিয়েছেন। তাই কিছু বলতে বা করতে পারছি না; কিন্তু এটা আমাদের কাম্য ছিল না।
টাঙ্গাইল পুলিশ সুপারের এক চমৎকার ইফতারি ছিল। টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনসে অমন চমৎকার ঘর-দুয়ার আছে জানা ছিল না। এখনো নির্মাণ চলছে। দেশে নানা জায়গায় অনিয়ন্ত্রিত বাড়ি-ঘর উঠলেও সরকারি টাকায় সে যে কী বিশাল নির্মাণযজ্ঞ চলছে বলে শেষ করা যাবে না। গত বছর শুনেছিলাম, আমাদের প্রত্যেকের ওপর বিদেশি ঋণ ২২-২৩ হাজার টাকা। ইদানীং শুনছি, মাথাপিছু ৪০ হাজার। এক-দুই বছরেই যদি প্রত্যেকের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের বোঝা এমন বাড়ে তাহলে কিছু দালানকোঠা তো হবেই। রাস্তাঘাট, দালানকোঠা এসব না হলে তো কমিশন পাওয়া যায় না। ১ টাকার ঘোড়াকে ১০ টাকার দানা খাওয়ানোর মতো। ১০০ টাকার কাজ হাজার টাকায় করলে; যারা করে তাদেরও লাভ, যারা করায় তাদেরও লাভ। তাই যেখানে-সেখানে সুন্দর দালানকোঠা, মসজিদ, মন্দির এটাওটা দেখে এখন আর তেমন উৎসাহবোধ করি না। অনেকটা কেমন যেন ‘মহাজনের মাল দরিয়ায় ঢাল’। কারও কোনো আকার-বিকার নেই।
সেই কবে ’৭১ সালের ২৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় আমাদের নেতৃবৃন্দ টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনসে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ৩০-৪০ জন আর্মড পুলিশ টাঙ্গাইল সার্কিট হাউস অভিযানে আমাদের সাথী হয়েছিল। যদিও সার্কিট হাউস থেকে আসা মেশিনগানের প্রথম গুলিতেই তারা পালিয়েছিল। কত বছর পর সেদিন সেই পুলিশ লাইনসে গিয়ে কিছুই চিনতে পারিনি। এসপি মো. মাহবুব আলম খুবই যত্ন নিয়েছেন। নতুন ডিসি এসেছেন জানতাম না। নতুন ডিসিকে বেশ প্রাণচঞ্চল মনে হলো। যে টেবিলে বসেছিলাম, সে টেবিলে ডিস্ট্রিক্ট জজ এবং স্পেশাল ডিস্ট্রিক্ট জজ দুজনে গিয়ে তাদের টেবিলে নিয়ে এসেছিলেন। সখীপুরের এমপি শাজাহানের ছেলে জয়ের বসার জন্য সাংবাদিক জাফরকে সিট ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। জাফর সানন্দে সিট ছেড়ে দিয়েছিল। জজ সাহেবরা খুবই সমাদর করেছেন। একদিন তাদের ঘরে গিয়ে চা খেতে অনুরোধ জানিয়েছেন। বেঁচে থাকলে রোজার পর অবশ্যই যাব তাদের অনুরোধ রক্ষা করতে।
লেখক : রাজনীতিক। সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।
এসএস/