মুজাহিদ সগির আহমদ চেীধুরী
আলেম, লেখক ও কলামিস্ট
কে যেন বললেন, “মুসলমানদের স্বপ্ন দেখতে নেই”। আসলেই মুসলমানদের প্রতিটি স্বপ্নই আজ দুঃপ্নে পরিণত হয়েছে। আইএসের উত্থানে উল্লসিত হয়েছিলাম প্রথমে আবার তাদের ধ্বংসও কামনা করেছি, সউদীর তথাকথিত ইসলামিক সামরিক জোটে ইসলামের মহাজয়ের স্বপ্ন দেখেছি আবার সেই সউদীর কাতার অবরোধ দেখছি, আর হায়-হতাশ করছি। আমরা আসলে কী? কী চাই? কোথায় আমাদের গন্তব্য কিছুই আমাদের জানা নেই।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের আরবভূমি দখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৭ সালের মধ্যে দু’বার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়েছে। শেষের যুদ্ধে মাত্র ছয়দিনের যুদ্ধে সম্মিলিত আরব শক্তি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়, হারায় গুরুত্বপূর্ণ এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত বেশ বিশাল ভূমি। এই পরাজয় আরবদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে, পরাজয়ে প্রতিশোধ স্পৃহা তাদের মধ্যে জা্গ্রত করেনি, কোনো প্রস্তুতিও তারা নেয়নি।
ইসরাইল বিশ্বে তাবৎ মিডিয়া কব্জা করে রেখেছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বাজার, উৎপাদন ও ব্যবসাও ওদের দখলে। শিল্প-সংস্কৃতিও ওদের নিয়ন্ত্রণে। অর্থ-শক্তিতেও ওরা এখন সর্বসেরা। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পৌনে শতাব্দী হতে চললেও আরবরা কোনোই প্রস্তুতি নেয়নি। শিল্প-বাণিজ্যে, অর্থনীতিতে, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারে, প্রযুক্তির উন্নয়নে, মিডিয়ায় আত্মপ্রতিষ্ঠায়, সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণে ওদের কারোই নিজস্ব কিছুই নেই। ওরা শুধু প্রেট্রোডলার দিয়ে সব কিনে নেয়, পশ্চিমা প্রেসপ্রিকশন অনুযায়ী চলে এবং বিলাসিতায় দিন কাটায়।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর পশ্চিমা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই প্রস্তুতির ক্ষাণিকটা গ্রহণ করেছে একমাত্র ইরান। আমিরাত-সউদীর পরিচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাট, উঁচু উঁচু দালান-কোটা এবং সর্বত্র যে ব্যাপক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যায় এসবে ওদের নিজস্ব কোনোই অবদান নেই, সবই প্রেট্রো ডলার দিয়ে কেনা। অথচ ইরান! ওদের ব্যবহৃত প্রযুক্তির অধিকাংশই ওদের নিজেদের আবিস্কৃত, নিজেরাই অস্ত্র উৎপাদন করছে, বিমান-ড্রোন তৈরি করছে, এমনকি গবেষণায় পারমানবিক বোমা তৈরির প্রায় দোরগোড়ায় ওরা পৌঁছে গেছে। ইরানে দালান-কোটা আছে, মজার ব্যাপার হচ্ছে এসবের স্থপতিরা সকলেই ইরানি। রাস্তা-ঘাঁটে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে তাও নিজস্ব স্টাইলে, এজন্য এরা স্টাবলিস্ট করেছে ইসলামি ক্যালিগ্রাফিকে।
অনেকে বলে থাকে, ইরান নাকি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিয়া বিপ্লব রফতানি করে থাকে। কথাটা ভুল বলে থাকে। বরং ইরান ইসলামি বিপ্লব রফতানি করে। শিয়া হোক বা সুন্নি মুসলিম বিশ্বে ইরান একটি ইসলামি বিপ্লব কামনা করে। এজন্য মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল ইসলামি দলগুলোকে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকলকে তারা পৃষ্ঠপোষকতা, সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
মিসরের ইখওয়ান, বাংলাদেশের জামায়াত ও খেলাফতসহ অনেককে ইরান সহযোগিতা করে। এটা শিয়াবাদের রফতানি বললে ভুল হবে। অথচ এই কাজটা করা উচিত ছিল সউদী আরবের। ইসরাইলের মোকাবেলায় সউদী আরবেরই প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত ছিল ব্যাপকভাবে।
হ্যাঁ। ইরানেরও মোকাবেলা করা উচিত। কিন্তু তা পশ্চিমাদের কথায় কেন? উপরে আমি ইরানের প্রসংশা করেনি, ওদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছি। ইরানের মোকাবেলা করতে হলে ইরানের সেই অভিজ্ঞতা সউদীসহ আরববিশ্বকে অর্জন করতে হবে। তা না করে ইসলামিক সামরিক জোটের নাম করে বনভোজন করলেই ইরানের মোকাবেলা সম্ভব নয়। আজকে ইসলামিক সামরিক জোটে শামিলকরণের জন্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সউদী আরব হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সউদী আরব যদি সত্যি সত্যি ইরান বা কাতারে সামরিক আগ্রাসন চালায় তাহলে অধিকাংশ মুসলিম দেশই সেই আগ্রাসনে অংশ নেবে না।
আর কথিত এই সামরিক জোটের সক্ষমতাইবা কতটুকু? যদি পাকিস্তান ও তুরস্ক উক্ত সামরিক জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে সম্মিলিত গোটা সামরিক জোট মিলেও ইরানের একটি চুলও বাকা করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। আসলে ইরান নয়, সউদী বাদশা শঙ্কিত তার সিংহাসন নিয়ে। মক্কা-মদীনার পবিত্রতা রক্ষায় ইসলামিক সামরিক জোট হয়তো এগিয়ে আসবে, কিন্তু সউদী বাদশার সিংহাসন রক্ষায় এই জোট প্রাণপণ যুদ্ধ করবে একথা আমার বিশ্বাস হয় না।
সউদী বাদশার সিংহাসন তো দূরে থাক, কথিত শিয়াবাদের বিরুদ্ধে ইয়ামেনে সউদী সামরিক আগ্রাসনেও ইসলামি বিশ্ব অংশগ্রহণ করেনি, আসাদ বিরোধী লড়াইয়েও এগিয়ে আসেনি ওই সামরিক জোট। সউদী বাদশা ছোট ইয়ামেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেভাবে নাকাল হয়েছে সেই জায়গায় ইরানের নাম শুনলে তো তার ভেতরে কম্পনের সৃষ্টি হবেই। তাই এক ধরনের পাগলামি শুরু করেছে। আর এ পাগলামিই তার পতনের কারণ হবে।
আজকে যে ইরানের সাথে সুসম্পর্কের অজুহাতে কাতারের সাথে সম্পর্ক সউদী আরবসহ আরব পাঁচ দেশ অথচ সেই সব দেশ নিজেরাই ইরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। আর মোকাবেলাটা ইরানের সাথেইবা কেন? ইসরাইলের সাথে নয় কেন? আজকে যদি আরব দেশগুলো ইসরাইলের মোকাবেলার প্রস্তুতি নিত তাহলে তো ইরানের বিরুদ্ধেও প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে যেত! কি সূক্ষ্মভাবেই না বন্দুকের নলটা ঘুরিয়ে দেওয়া হলো তেল আববি থেকে তেহরানের দিকে!
আরব নেতাদের মাঝে ইরানফোবিয়া ঢুকিয়ে ইসরাইল নিজেদের কতইনা নিরাপদ করে নিল! ইরানফোবিয়া নয় ইসরাইলফোবিয়া থাকার কথা আরব নেতাদের হৃদয়ে। না, পশ্চিমাদের ভরসায় ইসরাইল এখন তাদের মিত্র হতে চলেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই ইহুদি-খ্রিস্টানরা কখনোই মুসলমানদের ওপর সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না আমরা নিঃশ্ব না হয়ে যাই আর যখন নিঃশ্ব হয়ে যাবো তখন হুশ ফিরলেও করার কিছুই থাকবে না আমাদের।
শাহ খাওয়ারজিম আর আব্বাসী দ্বন্ধের কথা স্মরণ করো মুসলমান। নিজেদের মাঝে দ্বন্ধ আর প্রতিদ্বন্ধিতার মধ্যে হানাদার চেঙ্গিস খান এবং তার উত্তরসূরি হালাকু খান খাওয়ারজিম সম্রাজ্য এবং আরও পরে তাদেরই মিত্র আব্বাসী খিলাফতের স্বর্ণ রাজধানী ধূলিস্যাত করে দিয়েছিল। সউদী বাদশারা ইরানকে ভয় পাচ্ছে শিয়াবাদরে জন্য নয়, ইখওয়ানকে যে কারণে সউদী বাদশারা ভয় পায় সেই একই কারণেই ইরানকে নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত সউদী আরব। শঙ্কিত সে তার সিংহাসন নিয়ে, সে মোটেও শিয়াবাদের ঈমান বিধ্বংসিতা নিয়ে শঙ্কিত নয়। সে শিয়াবাদ নিয়ে শঙ্কিত নয়, সে শঙ্কিত ইসলামী বিপ্লবে।
ইসরাইলের মোকাবেলায় ইখওয়ান, ইরান, কাতার, তুরস্ক, পাকিস্তান ও মালেশিয়ার চেতনা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারতো সউদী আরব। না, তা হবে কেন? পশ্চিমারা খুবই সূক্ষ্মভাবে কাজে লাগিয়ে দিল এক মুসলিমকে অন্য মুসলিমের বিরুদ্ধে। আজকে যে মেধা-মনন ও রাজনীতিক প্রজ্ঞার ছোট্ট বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর আছে তা সউদী বাদশাদেরও নেই। সেদিন সউদী দূতকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেই ফেলেছেন, “কি হবে এসবে? পশ্চিমাদের অস্ত্র ব্যবসা ছাড়া?” আহা একথাটা যদি সউদী বাদশা বুঝতে পারতেন?
এসএস/