জাবের আল হুদা চৌধুরী
আমরা অনেক সময় কোন বিখ্যাত ব্যক্তির কীর্তি ও অবদানের মূল্যায়ণ করতে গিয়ে তাঁকে ব্যক্তিসত্ত্বার ঊর্ধ্বে তুলে স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলনের সাথে তুলনা করি।
মালিবাগ জামেয়ার সাবেক নায়েবে মুহতামিম ও স্বনামধন্য মুহাদ্দিস আল্লামা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া রহ: এর কর্ম ও অবদান বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টির বাস্তবতা পরিস্ফুট হয়ে উঠে। একজন ব্যক্তি কিভাবে 'ব্যক্তি' পরিচয় অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তৃত আবহে নিজেকে মেলে ধরে আদর্শিক জীবনের মাইলফলক হয়ে উঠেন তা প্রতীয়মান হয় দিবালোকের ন্যায়।
ব্যক্তি তাঁর চিন্তার উন্নয়ন, চেতনার নবায়ন, জ্ঞান, মণীষা, ত্যাগ ও সাধনার নান্দনিক প্রচেষ্টার ঘূর্ণাবর্তে নিজের আত্মিক শক্তি সঞ্চয় করেন। তার গণ্ডিবদ্ধ মেধা হয়ে উঠে সপ্রতিভ। আল্লামা ইয়াহইয়া সাধনার নান্দনিক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। চেতনার প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্জ্বলনে মরিয়া ছিলেন। শুদ্ধচারিতার নীরব সংগ্রামে তিনি ছিলেন একজন সাহসী সৈনিক।
তাঁর চিন্তায় প্রখরতা ছিল। জ্ঞান গরিমায় বৈচিত্র্য ছিল। প্রবাদতুল্য মেধার অধিকারী এই মানুষটি গোটা জীবনটাই ইলম অর্জন ও বিতরণ, বিচিত্র জ্ঞানের সাধনা ও গবেষণায় কাটিয়ে দিয়েছেন।
তাঁর এই অবিরাম সংগ্রামী সাধনার ফলে এই দেশ ও জাতি পেয়েছে অমূল্য সব রচনা ও গ্রন্থাবলী। ইলমের বর্ণিল কাননে তিনি সযতনে তৈরি করেছেন শত শত উলামা, মুফাচ্ছির, লেখক, বক্তা ও দ্বীনের সৈনিক। তারা এখন দেশ দেশান্তরে স্ব স্ব পরিমন্ডলে ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছেন।
তাঁর ভাবনায় নতুনত্ব ছিল। তাঁর চিন্তায় আবিস্কারের জাগৃতি ছিল। ধর্মীয় পরিমণ্ডলের চিন্তা চেতনার দুর্লেংঘ্য সীমাবদ্ধতা এবং 'মেজাযে শারইয়্যাহ্' এর রক্ষণশীলতা অটুট রেখেও তিনি নতুন কোন উপকারী আবিস্কারের নেশায় মেতে থাকতেন।
আর দশজন মানুষ চিরাচরিত কায়দায় যে জিনিসটিকে দেখেন এবং ভাবেন, তিনি এই দেখা ও ভাবনায় তুলনাহীন মেধা ও সৃজনশীল মননের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কর্মমুখর জীবনের পরতে পরতে, শিক্ষকতার বর্ণিল আয়োজনে, তাঁর লেখায়, রচনায় এবং দ্বীনী দায়িত্বসমূহের ক্ষেত্রগুলোতে এই মেধা ও মননশীলতা ফুটে উঠেছে।
হাদীস, তাফসীর, ফেকাহ ইত্যাদির দরস থেকে নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা, সাহিত্যমূলক বই লেখা এমন কি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তিনি তাঁর ব্যতিক্রমী অথচ উপকারী এই সৃষ্টিশীল মননের ইতিবাচক স্বাক্ষর রেখেছেন।
গবেষণার পাশাপাশি তিনি কবিতাও লিখতেন। ঘুমন্ত জাতিকে জেগে তোলার জন্য তিনি লিখেছেন- জেগে উঠ হে ঘুমন্ত শতাব্দী- নামক প্রেরণাসৃষ্টিকারী কবিতার বই। এভাবে একাধারে তিনি একজন বিদগ্ধ আলেম, মুহাদ্দিস, গবেষক, বহু গ্রন্থপ্রণেতা, কবি, ইমাম ও খতীব, সুবক্তা, প্রতিষ্ঠান পরিচালক এবং সুদক্ষ একজন সংগঠক।
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর সহকারী মহাসচীব হিসেবে দীর্ঘ ষোল/সতের বছর যাবত অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বেফাক বোর্ডের সিলেবাস ও টেকনিক্যালি আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে তাঁর যুগান্তকারী অবদান স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে।
মালিবাগ জামেয়ায় ছাত্র থাকাকালীন দীর্ঘ একটা সময় তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ধন্য হয়েছি তাঁর কাছ থেকে সহীহ মুসলিম শরীফের সবক ও সনদ গ্রহণ করে। শ্রদ্ধাভাজন উস্তাজ কে কাছ থেকে দেখে নিজের উপলব্ধি ও স্মৃতি থেকে কথাগুলো লেখা।
২০০৭/৮ শিক্ষাবর্ষে আমাদের ফুজালাদের উদ্যোগে সে বৎসর শিক্ষাসমাপণী উপলক্ষে একটি স্মারক ডায়রী প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। সে ডায়রীতে মালিবাগের সকল মুহাদ্দিস উস্তাদদের সংক্ষিপ্ত জীবনী সংযুক্ত করারও উদ্যোগ নেয়া হয়। সে মতে অন্যান্য উস্তাদদের পাশাপাশি আমরা হুজুরের কাছে আমাদের ইচ্ছে প্রকাশ করি।
হুজুর স্বভাবসুলভ বিনয় প্রকাশ করে প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পীড়াপীড়ির পর দুই দিনের সময় চেয়ে নিজেই লিখে দেয়ার কথা বলেন। পরে কথামত দুই দিন পর এক পাতার একটা কাগজে নিজের জীবনের সংক্ষিপ্ত কথা লিখে আমার কাছে দেন। (এ সংক্রান্ত দায়িত্ব আমার কাছে ছিল।) আমি পরবর্তীতে বিভিন্ন উৎস থেকে আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করে সংক্ষিপ্ত একটা জীবনী দাঁড় করিয়ে তা যথাসময়ে প্রকাশ করা হয়।
নিচে সেই ডায়রী থেকে হুজুরের জীবনের সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ: ১৯৫৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে সুবহে সাদিকের সময় ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা থানাধীন বালিখা ইউনিয়নের মালিডাঙ্গা গ্রামে এক ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা মরহুমা মেহেরুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত বিদূষী ও খোদাভীরু আল্লাহওয়ালা এক মহিলা।
পিতা: মরহুম মাও: মিয়া হোসাইন ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দ এর ফারিগ। একজন প্রাজ্ঞ ও প্রথিতযশা আলেম হিসেবে তিনি সারাদেশে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ৮ ছেলের সাতজনই প্রখ্যাত আলেম। লালবাগ জামেয়ার মুফতী তৈয়ব এবং মালিবাগ জামেয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা নজরুল ইসলাম তাঁর ছোটভাই। এক ভাই দ্বীনদার ডাক্তার। মাও: আবুল ফাতাহ ভাই বোনদের মাঝে সবার বড়।
পিতা মরহুম মিয়া হুসাইন দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে কোন এক গোধূলিলগ্নে স্থানীয় এক পাহাড়ের উপর বসে কুরআন তিলাওয়াতের সময় হযরত ইয়াহইয়া (আ:) এর খোদাভীরুতার বর্ণনায় অভিভূত হয়ে সংকল্প করেছিলেন, তিনি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম ইয়াহইয়া রাখবেন। সে মতে জন্মের পর বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন ইয়াহইয়া। ছাত্রজীবনে তিনি করিৎকর্মা ছিলেন বলে তাঁর এক প্রিয় উস্তাজ তাকে আবুল ফাতাহ নামে অভিহিত করেন। পরে তিনি "আবুল ফাতাহ মুহা: ইয়াহইয়া" এই যুক্ত নামেই পরিচিত হন।
পড়াশোনা
মা বাবা, গ্রামের মক্তব ও প্রাইমারী স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহের জামেয়া ইসলামিয়ায় (প্রাক্তন দারুল উলুম) ভর্তি হন। সেখানে তিনি উর্দু ও ফারসী খানার পাঠ সমাপ্ত করেন। স্বাধীনতা উত্তর মাদ্রাসা শিক্ষা ধারা ঝিমিয়ে পড়লে ১৯৭৪ সালে একটি হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করেন। তারপর পুনরায় মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে দ্বীনী শিক্ষা অর্জনে ব্রতী হন।
১৯৮১ সালে ফরিদাবাদ মাদ্রাসা থেকে মুতাওয়াসসিতাহ- (বর্তমান সানাবিয়্যাহ-১ ) জামাতে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরিক্ষায় ১ম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৯৮২-৮৩ শিক্ষাবর্ষে মালিবাগ জামেয়া থেকে তাকমীল জামাতের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ৪র্থ স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন।
কর্মজীবন
১৯৮৪ সালে সিলেট জেলার গাছবাড়ি আকনী মাযাহিরুল উলুম মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস পদে মুসলিম শরীফের উস্তাজ হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। পরবর্তী বছর মালিবাগ জামেয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ৪ বৎসর শিক্ষকতার পর তিনি সেখান থেকে জামেয়া শামছুল উলুম মতিঝিল (পীর জঙ্গী মাজার) মাদ্রাসায় যোগদান করেন। তিন বৎসর শিক্ষকতা করে ১৯৯৩ ইং সালে পুনরায় মালিবাগ জামেয়ায় যোগ দান করেন।
১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে তিনি অত্র জামেয়ার নায়েবে মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৮ সনে দীর্ঘ নয় বৎসর উক্ত দায়িত্ব সুনামের সাথে পালন করে সোবচ্ছায় ইস্তফা দেন। এরপর থেকে আজ তাঁর মৃত্যুঅব্দি তিনি মালিবাগ জামেয়ার একজন সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে আসীন ছিলেন।
এছাড়া দীর্ঘ দিন যাবত বেফাকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার পাশাপাশি ঢাকার শহীদবাগ জামে মসজিদে ৮ বৎসর এবং বায়তুত তাকওয়া জামে মসজিদে দীর্ঘ ১৭ বৎসর যাবৎ ইমাম ও খতীব হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে সর্বশেষ তিনি কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় একটি মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
জাতীয়, ধর্মীয় ও কওমী মাদ্রাসার স্বার্থসংস্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহা: রহ: এর হাত দিয়ে বেরিয়েছে অমূল্য ও অনবদ্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক গ্রন্থ। অমর এই গ্রন্থগুলো তাঁকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে দীর্ঘকাল।
গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি তিনি জাতীয় পত্র পত্রিকা ও স্মারক গ্রন্থে প্রায় শতাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছেন। অগণিত বই ও স্মারকের সম্পাদনা করেছেন।
বুখারী শরীফ (আংশিক) সহ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের অনুবাদ কর্মও আঞ্জাম দিয়েছেন।
রচনাবলী
তিনি অনেক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি।
১/ দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান। ( এটি ফজীলত ২য় জামাতের পাঠ্যভূক্ত)
২/ ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন। (ফজীলত ২ জামাতে একসময় সিলেবাসভূক্ত ছিল)
৩/ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইসলাম (মালিবাগ জামেয়া সহ কিছু কিছু মাদ্রাসায় এটি হেদায়া জামাতে পাঠ্যভূক্ত)
৪/ হাদীস অধ্যয়নের মূলনীতি
৫/ স্রষ্টা ও তাঁর স্বরূপ সন্ধানে (দর্শন ও গবেষণামূলক)
৬/ ইসলামের দৃষ্টিতে পীর মুরিদী
৭/ মুজাহাদা ফী সাবীলিল্লাহ
৮/ ইসলামে যৌন বিধান।
৯/ জেগে উঠ হে ঘুমন্ত শতাব্দী (কবিতা)
(এ সকল মূল্যবান গ্রন্থগুলোর গুরুত্ব, আবেদন ও মূল্যায়নের জন্য বিস্তৃত আলোচনার দাবী রাখে, যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়।)
ব্যক্তিগত জীবন: কেমন ছিলেন তিনি?
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন বিদূষী নারীর স্বামী। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের আদর্শ জনক। পারিবারিক জীবনে অত্যন্ত সুখি ছিলেন। ছেলে মেয়েদের কেউ হাফেজ আলেম হয়েছেন বা হচ্ছেন।
কর্মজীবনে বিভিন্ন দ্বীনী ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী হওয়া সত্বেও চলনে বলনে ছিলেন খুব সাধারণ। সাদা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পরতেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। মাঝারি গড়ন। সুস্বাস্থ্য ও দীপ্তিমান নুরানী চেহারা। পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল প্রবল। প্রয়োজনে রাশভারী ও গম্ভীর হতেন, প্রায়সময় থাকতেন হাসিখুশি।
আমাদের দাওরায়ে হাদীসের ক্লাসে তিনি মুসলিম শরীফ পড়াতেন। আমরা হুজুরের মজাদার এবং অনেক ক্ষেত্রে চটকদার দরস শোনার জন্য উন্মূখ হয়ে থাকতাম। দরসে হাদীসে তাঁর অনেক স্বাতন্ত্র্য এবং নিজস্বতা ছিল।
বিশেষত: শরহে হাদীস বা হাদীসের ব্যাখ্যামূলক আলোচনায় তাঁকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমকালীন মুহাদ্দিসকুলে অদ্বিতীয়ই বলা যায়। হাদীস পড়ানোর সময় ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোর উদ্ধৃতির সাথে সাথে তিনি প্রায় সময়ই তাৎপর্যপূর্ণ, যৌক্তিক এবং সমকালীনতা সমন্বয় করে নিজস্ব একটা বিস্লেষণ দাঁড় করাতেন। আমার উপলব্ধি এবং বোদ্ধামহলের মতামত হলো- এ ক্ষেত্রে তিনি অনেক সফলতা অর্জন করেছেন।
একদিন আমাদের মুসলিম শরীফের দরসে হাদীসের একটি শব্দ "উতরুজ্জা" বা মাল্টা/কমলালেবুর পরিচিতি ও এর চিকিৎসাবিজ্ঞান নির্ভর গুনাগুন আলোচনা করেছিলেন প্রায় দেড় ঘন্টা যাবত। হুজুর তাঁর ছাত্রদের সামনে রসিকতা করে নিজেকে "আল্লামা" বলতেন। হুজুর রসিকতা করলেও সেদিনের আলোচনায় আন্দাজ করেছিলাম এই আল্লামা শব্দটা তাঁর জন্য মানানসইও বটে। জ্ঞানের বিস্তৃত ভান্ডারে তাঁর পদচারণা ছিল। তিনি পারতেনও। দ্বীনী ইলমের জটিল জটিল মাসআলা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান,
অর্থনীতি থেকে সমাজনীতি, রাজনীতি থেকে তাসাউফ সর্ব বিষয়ে তিনি সমান পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। ব্যক্তি বিশেষের হীনমন্য মানসিকতা দূরীকরণে এবং বিভেদপূর্ণ যে কোন ইস্যুতে তিনি ত্রাতার ভূমিকা রাখতে পারতেন। অনেক জটিল জটিল বৈষয়িক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে খুব সহজেই কার্যকরী রাস্তা বের করে ফেলতেন। এ সংক্রান্ত সভা/মীটিংয়ে তিনি শুনতেন বেশি, কথা বলতেন কম। যা বলতেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর উপরই ফায়সালা হতো। তাঁকে পাহাড়ের মত অবিচল থেকে মালিবাগ জামেয়ার বহু 'হাঙ্গামা' সুদক্ষ হাতে সামলাতে দেখেছি। হুজুরের অধিকাংশ ছাত্র কে তিনি "তুই" বলে সম্বোধন করতেন। এই সম্বোধনে ছাত্রের প্রতি হুজুরের যে মমত্ব ফুটে উঠতো, তা ছিল বর্ণনাতীত। তাঁর এই উদার আন্তরিকতাপূর্ণ 'জিজ্ঞাস্যে' আমরা আনন্দিতই হতাম। আপন মনে করতাম।
হুজুর মাদ্রাসার প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সত্বেও সবসময় কেন জানি ছাত্রদের পক্ষাবলম্বন করতেন। ছাত্রদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করণে হুজুর সবসময় আন্তরিক ছিলেন।
মুসলিম শরীফের শেষ সবকের দিন আমরা হুজুরের কাছ থেকে মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরলাম। হুজুর বললেন, 'হবেরে হবে! আগে 'আল্লামা'র শেষ সবকটা হুইন্যা ল।'
সবক শেষ করে হুজুর পাঞ্জাবীর দুনো পকেট উল্টে পকেটে যা ছিল সব দিয়ে দিলেন। ছাত্রদের প্রতি হুজুরের এই মায়াময় আচরণ দেখে আনন্দে আমার চোখে পানি এসেছিল।
এভাবে আমি এবং আমরা হয়তো তাঁর শত শত স্মৃতির কথা বলতে পারবো। কিন্তু আজ হুজুর আমাদের ছেড়ে যে জগতে পাড়ি দিয়েছেন, সেখান থেকে আর ফিরবেন না। তাই স্মৃতিচারণ করে কষ্টের সেই চিনচিনে ব্যথাটা আর বাড়াতে চাইনা।
আল্লাহ পাকের কাছে করজোরে প্রার্থনা করি, রহমানুর রহীম! তোমার হাবীবের এই যোগ্য ওয়ারিসকে অসহায় কবর জগতে তোমার আপন করে নিও!
(আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ: এর মত মণীষী কে মূল্যায়ন করার জন্য যে পরিমাণ জ্ঞান, মেধা ও ভাষার শক্তির প্রয়োজন, এর কোনটিই আমার নেই। তাঁর মত একজন মহৎ মানুষের নগণ্য ছাত্র হিসেবে যে শব্দে/বাক্যে কিংবা ভাষায়ই তাঁকে উপস্থাপন করেছি, এটা তাঁর প্রতি একরকম অবিচারই করলাম বলে মনে হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল। দয়ালু।)
নাজিমে তা'লিমাত: দারুল ইরশাদ ওয়াদ দা'ওয়াহ আল ইসলামিয়া হবিগঞ্জ, আহবায়ক, যুব উলামা ঐক্য পরিষদ হবিগঞ্জ।